somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই খবরটা আমায় নিয়েই

১৭ ই মে, ২০১৪ রাত ১১:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছোট্ট একটা নিউজ এজেন্সিতে বরাতজোরে চাকুরি মিলে গেছে আমার সম্প্রতি। কাজকর্মের চাপ প্রচণ্ড। দিনে আট ঘন্টা প্রায় বিরতিহীন কাজ করতে হয়। বেতন সে তুলনায় সামান্যই। তারপরেও একটা ঠাঁট বজায় রেখে চলতে পারি এই যা ভালো দিক! কেউ প্রশ্ন করলে গম্ভীরভাবে পকেট থেকে আইডি কার্ডটা বের করে দিয়ে বলি, সাংবাদিকতা পেশায় আছি। কথাটায় একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায়, খবরের খোঁজে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘোরাঘুরি, অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে খবরের ভেতরের খবরের ব্যাপক তত্ত্বতালাশ, সেরকম কিছুই আমাকে করতে হয় না। আমার কাজটা নিউজ প্রেজেন্টারের নয়, নিউজ পাবলিশারের। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সাংবাদিকেরা মেইল করে খবর পাঠায়, সেগুলো পরিমার্জন করে প্রকাশ করি। অবশ্য আমার মূল কাজ এটা না। মূল কাজ হলো অন্যান্য জাতীয়, স্থানীয় সংবাদপত্র, বিবিধ অনলাইন নিউজ এজেন্সি প্রভৃতি থেকে খবর একটু এদিক ওদিক করে পাবলিশ করা। বেশিরভাগ সময়ই পারলে কপি পেস্ট করে দিই। আমার বসের কাছে খবরের কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ানটিটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই আট ঘন্টায় শতাধিক খবর প্রকাশ করে তাকে খুশি করতে পারলেই সেদিনটা একদম বৃথা যায় নি বলে মনে করি। অবশ্য মাঝেমধ্যে কিছু খবর আমি নিজেই লিখি। স্পোর্টস বা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড এর আমার পরিচিত তারকা বা দল উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করলে আবেগাপ্লুত হয়ে নিজেই লিখি মনের মতো করে। যেমন সেদিন মোহামেডান স্বাধীনতা দিবস গোল্ডকাপ এর শিরোপা জেতার পর এমনভাবে সংবাদটি পরিবেশন করেছিলাম, যেন আমি নিজেই উপস্থিত ছিলাম মাঠে। সাথে ছোটবেলার স্মৃতিচারণা, ফুটবল ঐতিহ্যের বিলীন দশা নিয়ে হাপিত্যেশ; সব মিলিয়ে বেশ মনগ্রাহী খবর হয়েছিলো একটা। এসব খবর যখন নিজের নামে প্রকাশ করি এবং পাঠকের প্রশংসা পাই, বেশ ভালো লাগে। অপেক্ষা করি, কবে এই পরিমাণকে মানের মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা বাজে নিউজ এজেন্সিটা থেকে চলে গিয়ে ভালো জায়গায় নিজের স্থান পোক্ত করতে পারবো। তবে তার আগে এই মেছোবাজারের হল্লাময় অফিসরুমে বসে কাট-কপি-পেস্ট এর মাঝে নিজের নামের সুলিখিত কিছু খবর প্রকাশ করতে হবে রেফারেন্স হিসেবে। এসব খবরের স্বত্ত্ব শুধুই আমার। ভবিষ্যতের হিসেবী পরিকল্পনার সাথে যাতে জড়িয়ে রয়েছে বিশুদ্ধ আবেগ।

এমনিতে কী ধরণের খবর বেশি চাউর হয়, পঠনের শীর্ষে থাকে তা অবশ্য আপনারা জানেন, কারণ আপনারাই তো পাঠক! এত গুরুত্বপূর্ণ সব খবর আমার মাধ্যমে পাবলিশড হয়, অথচ পাঠের শীর্ষে থাকে পর্ন তারকার অন্তর্বাস বিচ্ছেদ, কী করিলে যৌন স্বাস্থ্যের উন্নতি হইবে, কার উলঙ্গ ছবি বা ভিডিও বের হয়েছে, কোন তারকা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করেছে এসব। আর আছে খুন, অপঘাতে মৃত্যু, দুর্ঘটনা ইত্যাদি। মৃত্যু যে এমন মারমুখো হয়ে চতুর্মুখে ধেয়ে আসছে, এত রকমভাবে, ভাবতেই কেমন একটা ভয়ার্ত অনুভূতি হয়। হবিগঞ্জে কেউ ব্রিজের দেয়াল ধ্বসে পড়ে গেলো তো ধানমণ্ডিতে ইলেক্ট্রিক মিস্তিরি হাই ভোল্টের শক খেয়ে মরলো। চরফ্যাশনে জমির দখল নিয়ে মারামারি করতে গিয়ে কেউ কোপ খেলো তো দামুড়হুদায় কারো মাথায় গাছের ডাল ভেঙে পড়লো। সারাদিনে যতরকম সংবাদ পাবলিশ করি তার বেশিরভাগই এমন মৃত্যু সম্পর্কিত। কিছু কিছু মৃত্যু খুব করুণ, কিছু মৃত্যু অদ্ভুত, কিছু নৃশংস। আমার অবশ্য অতসব যাচাই করে সমব্যথী হবার ফুরসৎ নেই। তার চেয়ে ভাবা ভালো কোন মৃত্যুটির খবর মানুষে বেশি পড়বে। আমি বেশিরভাগ সময় কপি-পেস্টে কাজ সারতে চাইলেও আমার বস তুহিন ভাইয়ের তাগাদায় মাঝেমধ্যে মর্মস্পর্শী বা আহাজারিমূলক লাইন, যেমন "এখন কে দেবে অনাথ সন্তানদুটোকে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা?" অথবা "আমাদের দেশ আজ পরিণত হয়েছে নরখাদকদের ভোজসভায়" এমন কিছু যুক্ত করে দিতে হয়। এতে করে তিনি বেশ সন্তুষ্ট হন।

আজকে একটার পর একটা অদ্ভুত আর বিষণ্ণ মৃত্যুর খবর আসছে।
ময়মনসিংহে বয়লার বিস্ফোরণে ৩ শ্রমিকের মৃত্যু ,বগুড়ার সোনাতলায় পুকুরে ডুবে ভাইবোনের মৃত্যু, বালাগঞ্জে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক নিহত, কুড়িগ্রামে বিদ্যুতায়ীত হয়ে মেকানিকের মৃত্যু ,সিলেটে ২ ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ, চালক নিহত ,হবিগঞ্জে নৌকাডুবিতে মা-ছেলেসহ নিহত...

দম ফেলবার জো নেই। একটানা কাজ করে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যখন ভাবছি তুহিন ভাইকে বলে একটু চা খেতে যাবো নীচে, ঠিক তখনই আশীর্বাদের মতো আমাদের অফিসের নেট সংযোগ গেলো বিচ্ছিন্ন হয়ে। খবর পেলাম, আগামী আধা ঘন্টার মধ্যে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। খোশমেজাজে আমার খুপড়ি রুমটা থেকে বের হয়ে তুহিন ভাইয়ের অপ্রসন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সহকর্মী শফিককে নিয়ে চা খেতে বেড়ুলাম। শফিক ছেলেটা চা খাবার সঙ্গী হিসেবে বেশ ভালো। বয়স কম, কল্পনাপ্রবণ। নানারকম আজগুবী কথা বলে পরিবেশটাকে হালকা রাখে। যেমন আজকেই চা খেতে খেতে বলছিলো,
-বুঝলেন ববি ভাই, খবরের কাজ করতে গিয়া মাঝখান থিকা মনে হয় নিজেই খবর হয়া যাই।
-কেমনে খবর হইবা?
-আরে খবর হওয়া কোন বিষয় নাকি! রাস্তা দিয়া হাঁটতে গিয়া একটা ট্রাকের লগে ধাক্কা খায়া অক্কা তুললেন, আপনি হয়া গেলেন খবর!
এই হলো শফিক! অম্লানবদনে এমন সব নির্মম কথা বলে যেগুলো বাস্তবে রূপদান করা কঠিন!
-কিংবা মনে করেন বাসার কাজের মেয়েটারে ধর্ষণ কইরা তার চোখ দুইটা উপড়ায়া দু... স্যরি বড়ভাই আই মিন ব্রেস্ট কাইটা কাবাব বানায়া খাইলেন, আপনি তো টক অফ দ্যা কান্ট্রি হয়া যাবেন ভাই!
আমি বেশ বিরক্ত হবার ভান করি ওর এসব নির্মম রসিকতায়। তবে অংশগ্রহণের লোভটাও সামলাতে পারি না,
-তুমি না বড্ড বেশি ফাল পাড়ো। সাইকো জাতীয় চিন্তা ভাবনা সব। এর চেয়ে এক কাজ করি আসো, তুহিন ভাইকে গুম কইরা ফালাই। হালার কাছে দুই মাসের বেতন বাকি।
-এইটা একটা ভালো আইডিয়া দিছেন বড় ভাই। গাধার মতো খাটাইবো, সাপ্তাহিক ছুটি বইলা কিছু নাই, কইলে আবার বড় বড় কথা, "সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। সাংবাদিক আর ডাক্তারদের কোন ছুটি নেই। ভালো সাংবাদিক হতে হলে তোমাকে সর্বক্ষণ সৃজনশীল চিন্তা করতে হবে। ইভেন আমি যখন কমোডে বসি, তখনও ট্যাবটা সাথে নিয়ে যাই নিউজ সম্পর্কে আপডেটেড থাকার জন্যে"
নিখুঁতভাবে তুহিন ভাইয়ের বাচনভঙ্গি নকল করে বেশ একটা হাস্যমুখর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায় সে। আমিও ফোড়ন কাটি,
-হ! সে ট্যাব নিয়া ইয়ে করতে যায়, আর আমগো আদ্যিকালের মোবাইলে নেটের কানেকশনই নাই। বড় বড় কথা কয় খালি, বাল!
এভাবে চা খেতে খেতে আমরা তুহিন ভাইয়ের বড় বড় কথা বলার নিন্দে করি, এবং তাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায় তা নিয়ে বিশাল সব পরিকল্পনা আঁটি। ইতিমধ্যে খবর এসে যায় যে নেটের লাইন ঠিকঠাক হয়েছে। কাজে নেমে পড়তে হবে। চাপান এবং কথার বাণে আমরা বেশ সতেজ অনুভব করে কাজ করতে বসে যাই ফের।

কাজে মন বসে না আমার। নানারকম ভুল করতে থাকি। শফিক ছেলেটার প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা প্রবল। ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেই তার বাকপটুতার সাথে এক ধরণের সন্ধি সৃষ্টি হয়। মনে হয় যে তার কথাটাই সঠিক, এবং এমনটাই হওয়া উচিত। এই যেমন গত আধা ঘন্টার চা-পানকালীন সময়ে সে তুহিন ভাইকে গুম করার কথা হাস্যচ্ছলে বলেও জাগিয়ে তুলেছে আমার অপরাধী স্বত্ত্বা। ধর্ষণের পর বিকৃত খাদ্যরূচি চারিতার্থ করার কথা বলে জাগ্রত করেছে আমার ভেতরের পশুটাকে। আমার বারবার ইচ্ছে করে এমন কোন খবর লিখতে, "প্রভাবশালী সংবাদব্যক্তিত্ব তুহিন আহমেদ গুমঃ নেপথ্যে বেতন নিয়ে কর্মচারীদের সাথে গোলযোগ"। শফিকের যে কথাটি আমাকে সবচেয়ে আলোড়িত করেছিলো, তা হলো খবর করতে গিয়ে নিজেরই খবর হয়ে যাওয়া। যেকোন ভাবে! গুম, খুন, ধর্ষণ...উপায়ের তো অভাব নেই। নিজে মরো, অথবা অন্যকে মারো। কোথাকার কোন কুলিয়ারচড়ের শ্রমিক ট্রাকের ধাক্কায়, সাতকানিয়ার গৃহবধু গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে, কুলাউড়ার কিশোরী প্রেমে বঞ্চিত হয়ে সারাদেশের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় নিউজ আইটেম হিসেবে পৌঁছে যাচ্ছে, আর আমি! আমি কবে এই কপি-পেস্টের অসৃজনশীল চৌখুপি থেকে বেরুতে পারবো? নাহ, যেসব উপায়ের কথা ভাবছি সেসব করার মতো হিম্মত নেই আমার। নিজের নাম প্রকাশের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজে নিজে কোন আর্টিক্যাল লেখা। বার্সেলোনা-এ্যাটলেটিকোর মহারণ আজকে। এই খেলা নিয়ে আমার কত আগ্রহ! কিন্তু মনমতো লিখতে হলে তো সময় দরকার কিছু। তুহিন ভাইয়ের বেঁধে দেয়া প্রতিদিন কমপক্ষে একশটা নিউজ পাবলিশ করতে গেলে সে সময় কদাচিৎ পাওয়া যায়। ঠিক আছে, আমিও দেখে নেবো... সময় তো আর ফুরিয়ে যায় নি। একদিন নিজেই একটা নিউজ এজেন্সি খুলে বসবো। তখন দেখা যাবে...

-ববি!
তুহিন ভাইয়ের রাগত স্বর ফোনে। হকচকিয়ে গেলাম। আমি আবার কী দোষ করলাম!
-জ্বী তুহিন ভাই বলেন!
-গত তিনদিনে তোমার কাজের রেকর্ড শোনো, সোমবার কাজ করেছো সাত ঘন্টা উনপঞ্চাশ মিনিট, নিউজ দিয়েছো ৮৭ টা। মঙ্গলবার সাত ঘন্টা সাতান্ন মিনিটে ৮১ টা, বুধবার আট ঘন্টায় ৯৮ টা। অর্থাৎ মোট চৌদ্দ মিনিট কম কাজ করেছো, নিউজের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৪ টা দূরে। একটা মিনিট বেশি কাজ করতে চাও না তোমরা। তোমাদের দিয়ে হবেটা কী?
-তুহিন ভাই, নেটের লাইন স্লো থাকে, তারপর ধরেন যাচাই বাছাই করতে গিয়ে...
আমি মিনমিনিয়ে অস্পষ্ট স্বরে কথা অসম্পূর্ণ রাখি।
-নেটের লাইন ঠিকই আছে। আর যাচাই বাছাই করার জন্যে যে স্পিড সেটা তোমাকে অর্জন করেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছুতে হবে। তোমাদের আসল সমস্যা হলো গিয়ে মোটিভেশনের অভাব। এমন মহৎ একটা পেশায় নিয়োজিত হবার সুযোগ পেয়েছো আমার মাধ্যমে অথচ এই যে লেইজি বোনস...

শুরু করে দিয়েছে আবারও জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা! আমার ইচ্ছে করে তাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলি, "মিস্টার তুহিন, দু মাসের টাকা বাকি রাখলে মোটিভেশনটা আসবে কোথা থেকে শুনি?" কিন্তু সবেধন নীলমনি চাকুরিটা হারাবার শঙ্কায় আমার কিছু বলা হয়ে ওঠে না। আমি ফোন রেখে দ্রুত কাজ করতে থাকি।

যা হয় হোক! পঞ্চগড়ে দু মাথা অলা বাছুর হোক, ঠাকুরগাঁওয়ে ধর্ষিত তরুণী কে দোররা মারা হোক, ময়মনসিংহের মার্কেটে চাঁদাবাজী, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বজ্রপাতে মৃত্যু, তামাবিল সীমান্তে মৃত্যু, পর্নস্টারের সাবানের ব্র্যান্ড পরিবর্তন, পাঁচতারা হোটেলে পাঁচমিশালী মানুষ মিলে দেশের উন্নয়নের অলীক প্রবন্ধ পাঠ, হোক! আমার তাতে কী! আমি অর্ধযন্ত্র অর্ধমানবের মতো কাজ না করতে পারলে আমাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দেয়া হবে। তখন শালা ফকিরারপুল থেকে লিভারপুল কোথাও একটা শোর উঠবে না। আমার কী! ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে কাজ করতে করতে খেয়াল করি ১০০টা খবর পাবলিশ হয়ে গেছে! আরো আধাঘন্টা বাকি আমার কর্মঘন্টার। আহ! এই সময়টা শুধুই আমার। এখন আর তুহিন ভাইয়ের রোষকষায়িত লোচনের ভয়ে তটস্থ থাকতে হবে না। এবার আমি লিখবো খবর আমার মনের মতন করে। অন্তর্জালের কোন এক ক্ষুদ্র পরিসরে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে আমার নাম। এই তো আমার স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি দেখতে পাচ্ছি। যদিও এটা কেবল একটামাত্র ধাপ, তবে শুরু করলেই শেষ করা যাবে, একদিন পৌঁছে যাব স্বপ্নসিঁড়ির শীর্ষে। কী নিয়ে লেখা যায়!

ভাবছি আমি। ভাবতে গিয়ে বেশি সময় যেন নষ্ট না হয় আবার সে চিন্তাও অবশ্য ধর্তব্যের মধ্যে রাখতে হচ্ছে। জ্যাম ঠেলে বাসায় গিয়ে আবার রান্না করা... সে যাক। কী নিয়ে লেখা যায়? আজকের বার্সা এ্যাটলেটিকোর মহারণ? কে হবে চাম্পিয়্যান? আমার প্রিয় গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে কোথাও কোন লেখা দেখলাম না। তাকে নিয়ে অবশ্যই লেখা যায়। ওহ...না, সেদিন একটা সিনেমা দেখে খুব উদ্বেলিত হয়েছিলাম। ডাস্টিন হফম্যানের রোমান্টিক কমেডি, টুটসি। এটা নিয়ে চমৎকার একটা মুভি রিভিউ হতে পারে। আর এই লেখাটা যদি সুধীমহলে প্রশংসিত হয় তাহলে তো কথাই নেই! দুই মাসের বেতন গচ্চা দিয়ে তুহিন মিয়ার সামনে দিয়ে গটগট করে হেঁটে যাবো সৃজনোন্নত কোন প্রতিষ্ঠানে।

হঠাৎ...

তীব্র তাপে আমার শরীর শিউরে উঠলো। প্রচণ্ড শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে আমি যেন এক টুকরো নরকে নিক্ষিপ্ত হলাম। আমার কাপড় পুড়ছে, শরীর পুড়ছে, ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে, সাহায্য করার মতো কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। পাশের ঘর থেকে শফিকের ব্যাকুল চিৎকার শুনতে পাচ্ছি,
-ববি ভাই, আপনে কই? ঠিক আছেন?
ঠিক থাকি কীভাবে যখন শরীরের চামড়া পুড়ে বারুদে গন্ধ বেরোয়? আমার চামড়া যেন গলে গেছে, এখন হাড্ডির ভেতর ঢুকছে আগুন। কী কষ্ট! কী কষ্ট! হাড্ডিও যেন গলিয়ে ফেলবে। শরীরের সবখানে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট ছোট অগ্নিমিছিল মৃত্যুর শ্লোগান নিয়ে অগ্রসর হয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে জীবনের স্থাপনাসমূহ। ভেঙে পড়ছি আমি, এতক্ষণ ছোটাছুটি করছিলাম নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, বুঝে গেছি ও পাওয়া সম্ভব হবে না আমার আর। নেতিয়ে পড়ছি, শুনতে পারছি মৃত্যুর বারতা।

ফোনটা বাজছে। আগুন নিভে গেছে। আমি পুড়ে গেছি। হয়তো বা মারা গেছি, বা যাবো। ফোনটা কী করে বেঁচে থাকলো কে জানে!
-ববি! তুমি নাকি শর্ট সার্কিটের আগুনে পুড়ে মারা গেছো?
ওহ তাহলে ওটা শর্ট সার্কিটের আগুন ছিলো? ওহ, আমি মারা গেছি শেষ অবধি!
-জ্বী তুহিন ভাই।
-নিউজ কই? আরে এমন একটা নিউজ হাতের কাছে পেয়ে তুমি কভার করতে পারলা না? নিজের মৃত্যু, নিজে সংঘটিত হতে দেখলা অথচ একটা নিউজ বানাইতে পারলা না? তোমাদের দিয়ে হবে টা কী? খামোখা আইডি কার্ড দিছিলাম। আর তোমরা কোন কিছু ঘটতে দেখো না, খালি কপি পেস্ট করতে হবে বলে হাহাকার করো, এখন কী! শিগগীর নিউজ করো! রাখি।

তুহিন ভাই ফোন রেখে দেয়। পোড়াকাঠের মত হাতটা নিয়ে জীবিত অথবা মৃত অথবা জীবন্মৃত আমি কম্পিউটারের কিবোর্ডটা খুঁজে ফিরি। আমি সম্ভবত মৃতই। তুহিন ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া খবর, নির্ভরযোগ্য নিঃসন্দেহে। এতদিনে তুহিন ভাইয়ের কথার সাথে আমার মনোভাব মিলে যায়। নিজের সামনে নিজেকে মরতে দেখলাম, আর এত বড় খবরটা পাবলিশ না করেই চলে যাবো! আমার ফোনের ক্যামেরাটা ছাই নষ্ট। না হয় একটা সেলফি তোলা যেতো বেশ। খবরের সাথে ছবি এ্যাটাচ করলে তা বিকোয় ভালো। আর আমার এখনকার যা চেহারা, নিঃসন্দেহে বিভৎস। মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে সহজেই। আমার ছবি ছাপা হবে, আমার নাম ছাপা হবে, আমি নিজে থেকে সৃজনশীল কিছু করতে পারবো, কিন্তু সে সুযোগ কোথায়! কাঠপোড়া হাত দিয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া কম্পিউটারের নাগাল পাওয়া কঠিন ব্যাপার। ওদিকে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি চলে এসেছে আমায় বাঁচাবে বলে। আমার জীবনপাত্রে জোর চুমুক দিচ্ছে কারা? আমি নেই আমি নেই আমি নেই। চলে যাও ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, চলে যাও শব সংকীর্তণকারী, জীবন মৃত্যুর মত বড় বড় ব্যাপার একজন পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মানুষের কাছে কোন অর্থ বহন করে না। তবে জীবন থেকে মরণে চলে যাবার পরের মুহূর্তের রিফ্লেক্সে কারো শরীর যদি নড়ে উঠে নিজের মৃত্যুসংবাদকে পণ্য হিসেবে বিকোনোর, নিজের নাম এবং ছবি প্রচারের সুযোগ পায়, তবে তোমরা বাধা দাও কেন?

ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সাইরেন উপেক্ষা করে কর্কশ শব্দে আবার আমার ফোন বেজে ওঠে।

তুহিন ভাই।
৬৬টি মন্তব্য ৬৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×