আমার বুকের মধ্যে প্রতিদিন গোখরা সাপের বিষ জমে। রক্ত হয়ে যায় জমাট বাধা কালো বরফির মতো পিণ্ড। এত বিষ আমি উগড়ে দেবো কোথায়? শিরায় শিরায় রক্তের বদলে বিষ, সিনায় সিনায় পলাতক সাহসের চোরাটান। আমার অক্ষম সাহস শরীর ও মন থেকে বের হয়ে গিয়ে ভীতমুখে জানায়, সে আসতে চায় আমার কাছে। কত দূরের সেই ডাক...আবছা হতে হতে আমার কাছে আসতে গিয়ে মিলিয়েই যায় প্রায়। আমি শুনি কী শুনি না...বড় ইচ্ছে করে সকল দ্বিধা ছুড়ে ফেলে তার সাথে সাথে পথ চলতে। কিন্তু আমি পারি না। দেহের ভেতর বিষ জমে জমে আমাকে জীবন্মৃত করে ফেলেছে। এই বিষ দৃশ্যমান নয়। আমি জানি না তার আকার, রঙ। তাতে কী! বিষাদ এবং অক্ষম ক্রোধের উপজাত এই বিষ যেন পণ করেছে আমাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বেই। এই বিষে মিশে আছে ধর্ষিতা তরুণীর রক্ত, তার বাবা মার কান্না। এই বিষে মিশে আছে কলেজপড়ুয়া উচ্ছল প্রাণবন্ত সেই কিশোরের হাহাকার, যার বিকেল বেলায় মাঠ দাপিয়ে ফুটবল খেলার কথা ছিলো, অথচ এখন হাসপাতালে শুয়ে আছে দুর্বৃত্তদের আঘাতে হারানো পায়ের স্মৃতি নিয়ে। অথবা সেই লোকটি, ব্যাংক থেকে নিজের সঞ্চয় নিয়ে ফেরার পথে ছুরিকাহত, তার সর্বস্ব হারানোর চিৎকারে বেড়ে চলে আমার বিষের কাঁটা। এত ভার আমি বইবো কী করে? আমি যে আর পারি না! অন্তস্থ গরলের বুদবুদ পেট-বুক হয়ে আমার গলার কাছে এসে থমকে গিয়ে চেপে ধরে। এত বিষ আমি উগড়াবো কোথায়?
গত কয়েকমাস ধরে আমি প্রবল মানসিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমার চোখের সামনে একজনকে খুন হতে দেখেছিলাম। ব্যাপারটা খবরের কাগজে পড়লে স্রেফ একটা সংখ্যাই পড়তাম আমি হয়তো, যেমন "পান্থপথে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে একজন নিহত"। এ তো কোনো ব্যাপারই না! মাত্র একজন নিহত। আমি হয়তো সকালের নাস্তার সাথে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে খেলা আর বিনোদনের পাতায় চলে যেতাম পরমুহূর্তেই। ডিমের কুসুমটা আয়েশ করে পাউরুটির সাথে মাখাতে গিয়ে "কাওরানবাজারে জোড়া খুন" দেখে হয়তো বা ইশ বা আহা উহু জাতীয় কোন শব্দ করে টিভির চ্যানেল পাল্টাতাম। কিন্তু সেদিন আমি চোখের সামনে একজনকে খুন হতে দেখে, তার যন্ত্রণাকাতর মুখ, হাত দিয়ে পেট চেপে রেখে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার ব্যর্থ চেষ্টা, সর্বোপরি চোখের সেই নীরব আকুতি, তার নিঃশ্বাসেরা বিশ্বাস ভঙ্গ করে চলে যাচ্ছিলো, এমন অবস্থায় খুব কাছে থেকে কাউকে দেখলে মানসিক বিপর্যয় ঘটা অস্বাভাবিক কিছু না। এখন পত্রিকায় এরকম কোনো খবর দেখলে, যা মানবিকতার পরিপন্থী;খুন,জখম, ধর্ষণ, ইত্যাদি চোখে পড়লেই আমার নিঃশ্বাস ঘন হতে থাকে, মুষ্টিবদ্ধ হয় হাত, আমার ইচ্ছে করে খুনী, ধর্ষক; এমন গুরুতর অপরাধীদের নিজের হাতে শাস্তি দিতে। সেইদিনের প্রত্যক্ষ করা ঘটনাটি আমার জীবন আমূল বদলে দিয়েছে। আমরা যারা নিরীহ মানুষ, যাদের জীবনে তেমন কিছু ঘটে না কখনো, তাদের ওপর মানুষরূপী দানবদের এই সহিংসতা মেনে নিতে পারি না কোনভাবেই। খবরের কাগজে এমন ঘটনাগুলোর শিরোনামে ব্যবহৃত সংখ্যাগুলোকে শুধুই সংখ্যা হিসেবে দেখি না এখন আর। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে রয়েছে প্রাণবন্ত একটি জীবন। আমি খবরের কাগজে শুধু সংখ্যা না, জীবন পাঠ করি। মৃত্যু আমার কাছে জীবনের স্মারক হিসেবে ধরা দেয়। আমাদের তিলেতিলে গোছানো জীবনকে অনাকাঙ্খিত মৃত্যু এসে এক লহমায় নেই করে দিবে, এতই সহজ ব্যাপারটা? আমি মেনে নিতে পারি না কোনোভাবেই। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, বৃদ্ধি হয় রক্তচাপ, কপালের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।
-তুই খবরের কাগজ পড়া বাদ দে। এসব পড়ে কোনো লাভ নেই। খামোখা নিজের ওপর প্রেসার নেয়া।
আমার অগ্রজ 'তুতো ভাই শাহীন আমাকে পরামর্শ দিলেন।
-না, আমি খবরের কাগজ পড়া বাদ দেবো না। এসব এড়িয়ে চলা মানে অস্বীকার করে চলা। আমি কিন্তু খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই খবরগুলি পড়ি। এ থেকে সৃষ্ট শারিরীক এবং মানসিক সমস্যার কথা জেনেও। কেন জানো?
-কেন?
-আমি একবারের জন্যে হলেও প্রতিশোধ নিতে চাই। আমাদের ঢিমেতালে চলা করাপ্টেড বিচার ব্যবস্থার কথা তো জানাই আছে। ওরা কখনই সুবিচার এনে দিতে পারবে না। তাই আমি অন্তত একবার প্রতিশোধ নিতে চাই, নিগৃহতদের হয়ে।
-এর সাথে খুঁটিয়ে পড়ার কী সম্পর্ক?
-আমি দেখি এমন কোন ঘটনা আমার আশেপাশে ঘটছে কী না। অপরাধীর কাছে কোনভাবে যাওয়া যায় কী না। যদি আমার আয়ত্তের মধ্যে থাকে তবে আমি প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বো।
-কীভাবে প্রতিশোধ নিবি? খুন করবি?
-খুন-অঙ্গহানি-আহত যেকোন একটা করবোই।
-খারাপ না ব্যাপারটা। এটার সঙ্গে আমিও যুক্ত হতে চাই।
-সত্যি? তাহলে তো খুব ভালো হয়। আসলেই, বুঝেছো এভাবে আর কতকাল নতজানু হয়ে থাকবো? তোমার সমর্থন পেয়ে বেশ চাঙা অনুভব করছি। এখন থেকে তাহলে তুমিও খবরের কাগজে খুন-ধর্ষণ বা এরকম অন্যান্য সংবাদগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ো। খেয়াল রাখবে, আমাদের আশেপাশে এমন কিছু ঘটছে কী না।
-খেয়াল রাখবো।
তার এই আশ্বাসে আমি সাহস পাই। শরীরে জমে থাকা বিষ আক্রান্ত রক্তপিণ্ডগুলো যেন একটা তরলতা পায়। আমি বেশ হালকা অনুভব করি।
এক মাস পার...
আমাদের মধ্যে কিছুটা অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে। এখন আর ওই ধরণের কোন খবর পড়লে আমি অসুস্থ বোধ করি না। ওরকম কোনো খবরের শিরোনাম দেখলে উত্তেজিত হই বরঙ। কোথায় খুন হলো বা কে মারা গেলো এসবের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোথায় ঘটলো ঘটনাটি। আমাদের কাছেপিঠে কিছু ঘটে না বলে মনমরা হয়ে থাকি। আর হাতের মুঠো আরো শক্ত হতে থাকে প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তায়। আমাদের এই ছোট্ট সবুজ দেশটায় এত বেশি অনাচার, অবিচার, সহিংসতা...বিচারব্যবস্থার কম্ম নয় সবগুলোর সুরাহা করা। তাই আইন নিজের হাতে তুলে নিবো আমরা। মুছে দেবো অকালপ্রয়াত ছেলের জন্যে ক্রন্দনে বেদনাবিহবল মায়ের অশ্রূ। ধর্ষিতা কন্যার বাবাকে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ উপহার দিয়ে উচিত বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবো। এসব চিন্তা আমাকে উদ্দীপ্ত করে। ফলে আমার মানসিক সমস্যাটা অনেকটাই কেটে যায়। শরীরের ভেতর মওকা পেয়ে জাঁকিয়ে বসা বিষটুকু নেমে যায়। আমি এবং শাহীন ভাই এসব নিয়ে আলোচনা করি।
-নিখোঁজের চারদিন পর স্কুলছাত্রের লাশ উদ্ধার।
-কোথায়?
-ঢাকাতেই। তবে ধামরাইয়ে।
-বাদ। মিরপুর স্পেসিফিক্যালি মিরপুর এক নংয়ে কিছু পাও কী না দেখো। আর আমাদের এলাকায় হলে তো কথাই নেই!
-ফটিকছড়িতে সিএনজি চালক খুন। ধুর!
-ফটিকছড়িটা কোথায়?
-চট্টগ্রাম।
-শিক্ষকদের মারপিটও ভৎর্সনায় স্কুল ছাত্রের আত্মহত্যা। বাগেরহাটে।
-ধুর! ধুর!
হঠাৎ করে আমি আমাদের এই কর্মপ্রক্রিয়া এবং পরিকল্পনার মাঝে একটা গলদ আবিষ্কার করি। এর আগে এসব খবর পড়লে আমি যন্ত্রণা অনুভব করতাম। মানুষ কেন এত নিষ্ঠুর, মানুষ কেন মানুষের ওপর এত নিষ্ঠুরতা দেখায় এসব ভাবনা আমার মনটাকে তিক্ত করে দিয়ে বিষের মত প্রতিক্রিয়া দেখাতো। আমি চাইতাম পৃথিবীতে মমতার মেঘ থেকে বৃষ্টি নামুক, তাতে স্নাত হই আমরা সবাই। কিন্তু এখন,অবচেতন মনেও কি আমি চাইছি না,আমার এলাকায় খুন-ধর্ষণ বা এরকম ভয়াবহ কোন অপরাধ সংঘটিত হোক? ব্যাপারটা আসলে এভাবে দেখা উচিত ছিলো, ওসব অপরাধ কমে আসুক, আমাদের এলাকাতেও না আসুক। কিন্তু আমরা এখন যেন নিজেদের বীরত্ব এবং শক্তিমত্তা পরখ করে দেখতে এতটাই উৎসুক, কোন অপরাধকর্মের বিবরণ পড়ে ওটা আমাদের এলাকার মধ্যে না পড়লে ক্ষেপে যাই।
-সাতক্ষীরায় কিশোরীকে গণধর্ষণ।
শাহীন ভাই বিরক্ত মুখে পড়ে শোনালেন।
-বাড্ডায় ট্যাক্সিক্যাব চালক খুন। কাম অন ম্যান! সব অপরাধীরা অন্য এলাকায় থাকে কেন? এটা কেমন কথা! আমাদের এলাকাতেও কিছু থাকতে পারতো।
নিজেকে আমার এ্যাকশন সিনেমার দুর্ধর্ষ নায়কের মতো লাগে। যে অপেক্ষা করছে ভিলেনের আগমনের।
-আমাদের এলাকায় একবার ঘটুক না এরকম কিছু! একদম সাইজ করে দেবো!
-খুনের বদলা খুন। ধর্ষণের বদলে লিঙ্গ কর্তন। নো মার্সি।
চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা আমাদের।
আমি আবারও আমাদের গলদটা দেখতে পাই। আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতি এখন কাজ করছে না সেরকম। গলা অবধি জমে থাকা বিষ উগরানোর অপেক্ষায় নেই। আমরা চরমতম ভায়োলেন্স দ্বারা অবসেসড হয়ে আছি। কবে এরকম ঘটবে আমাদের এখানে, কবে? কবে আমরা সবার সামনে উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবো? দূর ছাই, এটা কোনো গলদ না। গলায় বিষের থলি নিয়ে কোঁকানোর চেয়ে এই নায়ক হবার পরিকল্পনা হাজার গুণ ভালো। দিনে দিনে জমেছে অনেক চর্বি আর মাংস আমাদের শরীরে। ওগুলো টগবগ করে ফুটছে। শরীর থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। মানুষমাত্রই কি সুযোগের অভাবে নিরীহ? আমরা ন্যায়বিচার কায়েমের জন্যে বেশি উৎসুক নাকি সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের অতৃপ্ত খুনে স্বভাবকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছি? একবার কোথায় যেন পড়েছিলাম, প্রতিটি মানুষেরই ভায়োলেন্সের চাহিদা রয়েছে। ছোটবেলায় সে চাহিদা পূরণ করা হয় খেলনা অস্ত্রাবলী দ্বারা, আর বয়স হলে সাইকো অথবা এ্যাকশান জাতীয় সিনেমা দেখে। এইভাবে কামার্ত ভায়োলেন্সকে পাচার করে শরীরের ভার লাঘব করার পদ্ধতিকে বলা হয় ভায়োলেন্স ড্রেইন! আমরা কি তবে আমাদের ভায়োলেন্সের চাহিদাকে পূরণ করার জন্যে মিছে ন্যায়বিচারক সাজছি? গোল্লায় যাক ওসব চিন্তা ভাবনা। আমি উত্তেজিত হয়ে রহিত করে দেই ভাবনাগুলো।
হঠাৎ একদিন আমাদের চাহিদামতো একটি খবরের সন্ধান পাই। "মিরপুরের পাইকপাড়ায় খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে কিশোর খুন"। আমি উত্তেজনায় প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ি! আরে, এ তো আমাদেরই এলাকা! শাহীন ভাইকে ডেকে বিস্তারিত পড়ে শোনাই খবরটা। নিহত কিশোরের বয়স চৌদ্দ। খুনীর বয়স সতেরো। খুন করা হয়েছে পিস্তল দিয়ে। খুনীর বাবা প্রভাবশালী লোক হওয়ায় পুলিশ না কি কোনরকম ট্যাঁ ফো করছেন না। সে না করাই ভালো। আমরা আছি কেন তাহলে? ভয়ানক পৈশাচিকতা অনুভব করি আমি নিজের ভেতর।
-কাজ শুরু করে দেয়া দরকার।
গম্ভীর মুখে শাহীন ভাইকে বলি।
-হ্যাঁ। জিনিসপাতি যোগাড় করতে হবে আজকের মধ্যেই।
কী কী জিনিস লাগবে তার একটা লিস্ট করি আমরা। কীভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে তার পরিকল্পনা করি।
যথাসময়ে শাহীন ভাই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে আসেন। সবকিছু ঠিকঠাক। একটু পরেই কাজে নেমে পড়বো। শাহীন ভাই অর্ডার দিয়ে বেশ চমৎকার একটা কাকতারুয়া বানিয়েছেন। সাথে দুটো খেলনা পিস্তলও কিনে এনেছেন। একদম আসল পিস্তলের মত শব্দ হয়। ফটাস ফটাস! ঢিশিয়া ঢিশিয়া! কাকতারুয়াটিকে দশ মিটার দূরে রেখে আমরা গুলিবর্ষণ করি তার ওপর। ঢিসা ঢিসা! খুনের বদলে খুন। এটাই তোর প্রাপ্তি। ঢিশিয়া!
দেখুন, আপনারা আবার ভাববেন না যে আমরা ভয় পেয়েছি বা আমাদের মুরোদ নেই বাস্তব জীবনের সত্যিকারের ভিলেইন এলাকার প্রভাবশালী নেতার সন্তানকে খুন করার। অবশ্য ভাবতেও পারেন সেরকম, ভাবতে তো আর বাধা নেই! কী আর করা! আমি কাকতারুয়াটিকে আবার মারতে গিয়ে দেখি গুলি শেষ হয়ে গেছে!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:৫৮