আমি জানি না সুইসাইডাল মানুষকে মোটিভেশনাল স্পিচ দিয়ে ফেরানো যায় কি না। আমি জানি না এমপ্যাথি দিয়ে ফেরানো যায় কি না। আমি জানি না কীভাবে এমন একজনকে ফেরানো যায়। কিন্তু ফেরাতে তো হবেই! ক্রিকেটে যেমন রান আউট মেনে নেয়া যায় না, কারো জীবনের শেষ সুইসাইডের মাধ্যমে হলেও মেনে নেয়া যায় না। শুধু জানি যে আমি একসময় সুইসাইডাল ছিলাম, এবং শেষ পর্যন্ত করি নি সাহসের অভাবে। ভাগ্যিস করি নি! অফিসের তিন তলার বারান্দায় গিয়ে বসে থাকতাম। লোভী চোখে তাকিয়ে থাকতাম নিচের দিকে। ঝুঁকে পড়তাম। মাঝে মাঝে মনে হত যে ঘটনা মনে হয় ঘটেই যাচ্ছে! এখুনি! কিন্তু কোন এক অজানা ভয়ে লাফ দেই নি কখনও। ধানমন্ডি লেকের পাড়ে বসে থাকতাম। মনে হত বারান্দা থেকে লাফিয়ে মরার চেয়ে পানিতে ডুবে মরাতে মনে হয় কষ্ট কম। তারপরেও শেষ পর্যন্ত লাফ দেই নি। ৫০টা ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম দুইবার। আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে না অবশ্য। ঘুমের উদ্দেশ্যে। একবার স্টোমাক ওয়াশ করতে হয়েছিলো, আরেকবার এমনিই ঘুমিয়েছিলাম কয়দিন। আমি ১টা, ২টা, ৫টা, ১০টা ২০টা এভাবে ডোজ বাড়িয়ে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করেছিলাম। এজন্যে হয়তো হারিয়ে যাই নি।
এসবই ঘটেছে ২০০৮ থেকে ২০১৪ এর ভেতরে। চরম হতাশার সময়।অনলাইনে এর মধ্যেই চুটিয়ে ব্লগিং করেছি, গল্প লিখেছি, সামুতে সেলিব্রেটি ব্লগার খেতাব পেয়েছি, একেকটা লেখায় ৩০০ এর কম মন্তব্য থাকতো না। কিন্তু কেউ কি জানেন এসব কথা? না, আমার ব্যক্তিগত কষ্টের কাঁদুনি কখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করি নি। আজ কেন এসব বলছি? বলছি, যদি আত্মহত্যাপ্রবণ একটি প্রাণও অন্তত এই লেখা দেখে নিজেকে ফেরায়। একজন মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারার চেয়ে পূণ্য কর্ম আর হয় না।
কিন্তু ম্যাজিক টিপসটা কী? কী করলে আত্মহত্যাপ্রবণতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে? কোন ম্যাজিক টিপস নাই। দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সহ্য করে যেতে হবে। প্রেমে ব্যর্থতা, প্রিয়জন হারানোর কষ্ট, নিজের জীবনের গ্লানি, সবকিছুই একসময় না এক ফিকে হয়ে আসবে। সব কষ্টেরই শেষ আছে বলে বিশ্বাস করি। কেউ এসে কষ্ট কমিয়ে দিয়ে যাবে না। কিন্তু মানুষের সহ্যক্ষমতা অসীম। এক মাসে কষ্ট দূর হবে না, এক বছরে না, হয়তো পাঁচ বছরেও না। কিন্তু কষ্ট করে হলেও বেঁচে থাকলে একসময় না একসময় এর সুফল পাওয়া যাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আমার আত্মহত্যাপ্রবণতা কোন শখের বিষয় ছিলো না। আমাকে রিহ্যাবেও থাকতে হয়েছে। এতকিছুর পরেও যেহেতু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছি, আমার মনে হয় আমাকে উদাহরণ হিসেবে দেখালে ভুল হবে না। মন্ত্র ঐ একটাই, সহ্য করতে হবে, অপেক্ষা করতে হবে, সামনে হয়তো বা রূপকথার মত সুন্দর দিন আসবে না, কিন্তু কিছুটা হলেও কষ্ট লাঘব হবে। তখন আর আত্মহত্যার কথা মনে নাও হতে পারে। এখন আমি ভাবি, যদি ঝাঁপ দিতাম জলে অথবা ওপর থেকে, কিংবা যদি ঘুমের ঔষধগুলি কাজ করেই ফেলতো...তাহলে কোথায় থাকতাম আমি!
অনেকেই বলে যারা আত্মহত্যা করে, তারা বলে কয়ে করে না, তারা অত নাটক করে না। কিন্তু এটা অত্যন্ত ভুল কথা। চোখের সামনেই উদাহরণ আছে। দেখবেন? অন্তর রাজ নামে একটা ছেলের টাইমলাইনে ঘুরে আসতে পারেন। তাই কারো মধ্যে নূন্যতম আত্মহত্যাপ্রবণতা দেখলে অবহেলা করবেন না। বিশেষ করে কাছের মানুষেরা।
আমি কীভাবে ফিরে এসেছি, সেই দীর্ঘ গল্প কখনই করবো না। প্রতিটা মানুষের কষ্ট তার একান্তই ব্যক্তিগত। প্রতিটা মানুষের লড়াই তার ব্যক্তিগত। একজনের সাথে আরেকজনেরটা মেলানো যাবে না। তাই টিকে থাকার উপায় নিজেকেই বের করতে হবে। কারো হয়তো বা একটু সহানুভূতি, কারো হয়তো বা নতুন কাজ, কারো হয়তো বা লেখালেখি, কারো হয়তো বা আঁকাআঁকি, আবার কারো জন্যে প্রার্থনা, ধর্মীয় আচার, কে কীভাবে শান্তি পাবে সেটা সেই ভালো জানে। তাকেই খুঁজে নিতে হবে। তবে তার জন্যে বেঁচে থাকার নূন্যতম ইচ্ছা থাকতে হবে। এই একটু শুভইচ্ছাকে যত্ন করে রাখলেই একসময় জীবন নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে নিজেকেই রক্ষা করবে।
একটা কথা বলে রাখি। ২০১২ তে আমার বিয়ে হয়। ২০১৩ তে বাবা হই। তারপরেও ২০১৪ পর্যন্ত ভয়াবহ সময় কেটেছে। অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। এজন্যে এই কথাগুলি বলছি, আমি কিন্তু আমার স্ত্রী বা মেয়ে বা বাবা-মার জন্যে ফিরে আসি নি। আমার অবস্থা এমন ছিলো, এত কাছের মানুষেরাও আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিতে পারতো না। এজন্যে বলছি এই কথাগুলি, এমন অবস্থা থেকেও যে নিজের শক্তিতে ফিরে আসা যায়, এটা বোঝানোর জন্যে। প্লিজ, এই শক্তিটুকু ব্যবহার করো, হয়তো বা জীবনের খুব সাধারণ কিছুই একসময় অসাধারণ মনে হবে।
আবারও বলি, কোন ম্যাজিক টিপস নেই। ফিরে আসার পথ দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। কিন্তু আমার মত দুর্বল মানুষ যেহেতু এই পথ পাড়ি দিতে পেরেছে, অন্যরাও পারবে।
আমি এখনও দুর্বল, অলস, অকর্মণ্য, জীবনে খুব বিশাল কিছু করে ফেলি নি, করার সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু বেঁচে তো আছি! বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী…
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৩০