প্রাককথন
২০০৮ সাল। বাসায় বসে আছি। ছাত্রজীবনে কিছু লিরিক, গল্প আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানের জন্যে নাটিকা লিখেছিলাম এই ভরসা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি কবে হুট করে বড় লেখক হয়ে যাবো। ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দুই বছর লস খেয়ে পাস করে সেই ধাক্কা তখনও সামলাতে পারি নি। নিজেকে অপদার্থ এবং অকর্মণ্য মনে হয়। কোথাও কোন দিশা খুজে পাই না। একটা প্রেম করি, সেটাও যায় যায় অবস্থা। এই গেলো বলে! কী হবে আমার, বলেন! রম্য পত্রিকা উন্মাদে মাঝেমধ্যে লেখা ছাপা হয়। পত্রিকাগুলি সযত্নে রেখে দেই। তখন বিচিত্রা ছাপা হতো। গেলাম সেখানকার একজনের কাছে হাতি ঘোড়া মারার প্রত্যাশায়। সে আমাকে কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক আর্টিকেল অনুবাদ করতে দিলো। বড়ই নীরস কাজ। ইন্টারনেট তখন সোনার হরিণ। সাইবার ক্যাফেই মূল ভরসা। মাঝেমধ্যে বাসার কম্পিউটারের জন্যে ইন্টারনেট কার্ড কিনতাম। বিচিত্র সব প্যাকেজ। এক মাসে একশ ঘন্টা ব্যবহার করা যাবে, প্রতিদিন গড়ে তিনঘন্টা, তিনশ টাকা এই রকম প্যাকেজ ব্যবহার করতাম। ইয়াহুতে চ্যাটিং করাটাই তখন মূলত ইন্টারনেট। আর আমি প্রচুর সময় কাটাতাম আইএমডিবি ডট কমে, সিনেমা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। সিনেমা দেখার জন্যে তখন টাকা দিয়ে ডিভিডি কেনা ছাড়া উপায় নেই। আর ইন্টারনেট দিয়ে ভিডিও দেখার কথা তো কল্পনাও করা যায় না। তো সেই সময় হঠাৎ করেই…
বুম!!!
পেয়ে গেলাম হাই স্পিড ইন্টারনেট লাইন। কীভাবে? আমাদের বাসার এক ভাড়াটে ফ্রিল্যান্সিং করতো। তার জন্যে হাই স্পিড ইন্টারনেট লাইন দরকার ছিলো। অনেক ঝামেলা করে, কী কী মেশিন লাগিয়ে কীভাবে যেন সে ইন্টারনেট আনলো, সাথে আমাদেরও লাইন দিয়ে দিলো। সে যে কী অবস্থা! সারাদিন পড়ে থাকি নেটে। ইউটিউবে মিউজিক ভিডিও দেখি, আর ডাউনলোড করি। এর মধ্যে আবার ফেসবুক এসে গেলো। সে আরেক মজার জিনিস! ইউটিউবে গান শুনে আর ফেসবুকে বাংলিশে বিভিন্ন মানুষের সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে দারুণ যাচ্ছিলো দিন। দারুণ মানে সেইরকম! বেকারত্বের হতাশা, ব্রেকআপের যন্ত্রণা সব বেমালুম ভুলে গিলে বসে এক স্বপ্নরাজ্যে বসবাস করছিলাম। বলা যায়, সারাক্ষণই High থাকতাম। কিন্তু ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, Which goes above, comes down. তো আমারও আকাশ থেকে মাটিতে নামতে সময় লাগলো না। একসময় ভাড়াটে তার জাদুর মেশিন খুলে বাসা বদল করে চলে গেলো। আমি পতিত হলাম অন্ধকারে।
কী করবো তখন? অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। ইউটিউব ভিডিও দেখার কোন উপায় নেই। ফেসবুক খুলতেই পাঁচ-দশ মিনিট লেগে যায়। ব্যবহার করি টিএন্ডটির কুখ্যাত ডায়াল আপ ইন্টারনেট। সেখানে সর্বোচ্চ ডাউনলোড স্পিড 3 Kbps. এ দিয়ে আমি কী করবো!
স্বাগতম ব্লগের আঙিনায়
আরে, কিছু একটা উপায় তো বের করে নিতেই হবে! নাহলে সময় কাটবে কীভাবে? কিছুদিন আগে কাজিন (গীতিকার শেখ রানা, ব্লগার নস্টালজিক) কিছু বাংলা ব্লগের ঠিকানা দিয়েছিলো। সেগুলি ঘেঁটেঘুঁটে দেখি। ভালা পাই না। তবে কিছু তো করার নেই। তাই পড়া শুরু করলাম।
হ্যাঁ, এভাবেই সামহয়্যারে যাত্রা শুরু! কিছুদিন পড়ে ভালো লেগে গেলো। এখন লিখতে ইচ্ছা করলো। পুরোনো ছোট্ট একটা পদ্য ছিলো, প্রায় আধা ঘন্টা সময় লাগিয়ে লিখে ফেললাম। লেখার কিছুক্ষণের মধ্যেই কমেন্টও পেয়ে গেলাম। ব্লগার মেঘাচ্ছন্ন লিখেছিলো,
“ভালো লাগলো...............+++++
স্বাগতম.....আপনাকে, আমাদের এই ব্লগ পরিবারে.......।”
মেঘাচ্ছন্ন ছিল এক বিশেষ ব্লগার। সবার প্রথম পোস্টে গিয়ে কমেন্ট করতো।
সামহয়্যারইন সাইটটা ছিলো দারুণ ফাস্ট! আমার দুর্বল ইন্টারনেট কানেকশন দিয়ে এই একটা সাইটই ঠিকঠাক ব্রাউজ করা যেতো। সামুতে বুঁদ হয়ে থাকার এটাও একটা কারণ।
তো আমি মজা পেয়ে গেলাম! এক সপ্তাহের মধ্যে কমেন্ট এক্সেসও পেয়ে গেলাম! ব্লগে তখন নিয়মিত গ্যাঞ্জাম চলতো। সেই সময় গ্যাঞ্জাম চলছিলো অমি রহমান পিয়ালের একটা ইস্যু নিয়ে। সে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার জন্যে হাফ পর্ন সাইট যৌবনজ্বালা ডট কমে ছেলেপুলেকে একত্রিত করছিলো। যৌবনজ্বালার ব্যানারে তারা বিজয় দিবস পালন করবে, এই ছিলো পরিকল্পনা। তা আমি প্রথম কমেন্টই করলাম আরিফ জেবতিকের ব্লগে অমি রহমান পিয়ালের ইস্যু নিয়ে। ব্যাস, জড়িয়ে গেলাম গ্যাঞ্জামে! ২০১১ সালে ৭ মাস কমেন্ট ব্যান থাকার আগ পর্যন্ত ব্লগে ক্যাচালবাজ হিসেবেই পরিচিত ছিলাম।
বিচ্ছিন্ন কিছু স্মৃতিচারণ
তো সেই সময় আমার রুটিনটা ছিলো এরকম- ভোরের দিকে ঘুমাতে যাই, শেষ দুপুরে উঠি, খাই-দাই, ব্লগিং করি। ধীরে ধীরে ব্লগিংটা নেশায় পরিণত হলো। বাইরে কোথাও যেতাম না, সারাক্ষণ ব্লগ নিয়ে ভাবতাম। একবার মনে আছে বন্ধুদের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলাম। যাওয়ার পর সারাক্ষণ খালি চিন্তা, এটা নিয়ে কী ব্লগ লেখা যায়! কারো কথায় হাসি পেলে মনে মনে প্লাস দিচ্ছিলাম, বিরক্ত হলে মাইনাস। এখনকার ব্লগাররা অনেকেই হয়তো জানেন না, সেইসময় ব্লগে মাইনাস দেয়ার উপায় ছিলো। আমি যখন ব্লগে আসি, তখন একটা পোস্ট নিয়ে খুব শোরগোল চলছিলো। আলেকজান্ডার ডেনড্রাইটের “জাফর ইকবাল বাঙালি জাতিকে কী দিয়াছেন?” শিরোনামে। সেই পোস্টের ছিলো মাইনাস খাওয়ার রেকর্ড। কিছুদিন পর পর সেই পোস্টে ‘নাড়া’ দেয়া হতো। মাইনাস সংখ্যা কত শততে গিয়ে ঠেকেছিলো মনে নেই। একসময় লেখক ব্লগটি মুছে দেয়।
সেইসময় ব্লগে কিছুদিন পরপর তীব্র আন্দোলন হতো! সেসবের বৃত্তান্ত না বলি। অনেকের জন্যে অস্বস্তিকর হতে পারে। আমি বরং কিছু ব্লগ কালচারের কথা বলি।
টুপি পরাইছে?
ধরেন কেউ একজন বেমক্কা কমেন্ট বা পোস্ট করে সেফ থেকে জেনারেল হয়ে গেলো। জেনারেল আবার একটা সেনাপদবীও! আর জেনারেলের তো বিশেষ টুপিও থাকে! তাই কেউ জেনারেল হয়ে গেলে সে প্রোফাইল পিকচার পাল্টে জেনারেলের টুপি দিয়ে দিতো। তখন সবাই বুঝতো যে মডু টুপি পরায়া দিছে!
রেসিডেন
ধারণা করা হতো যে সবসময় ব্লগের মডারেটরদের বেতনভুক্ত একজন ব্লগার থাকে, যার কাজ হচ্ছে টাকা খেয়ে মডারেটরদের পক্ষ হয়ে প্রতিবাদী ব্লগারদের দমিয়ে রাখা। এত টাকা মডারেটররা কোথায় পেত এটা একটা রহস্য বটে! রেসিডেন কারা বা আসলেই এ জিনিস আছে কি না এটা একটা অমিমাংসিত(!) বিষয়! তবে ধারণা করা হতো রহস্যময় ব্লগার ফিউশন ফাইভ একজন রেসিডেন। ব্লগিং থেকে অব্যাহতি নেয়া পুরোনো কিছু ব্লগার বন্ধু আমাকে রেসিডেন হিসেবে বক্রোক্তি করে! (সুতরাং সাবধান! হাহাহা)।
নিরাপদ পোস্ট
ব্লগারদের প্রতিবাদের একটা ধরণ ছিলো নিরাপদ পোস্ট দেয়া। যেহেতু প্রতিবাদী পোস্ট দিলে মডুরা টুপি পরিয়ে দেয়, তাই কী দিয়ে ভাত খেলেন, তরকারিতে লবণ হয়েছিলো কি না এসব পোস্ট দিয়ে ব্লগাররা প্রথম পাতা ভরিয়ে রাখতেন।
ট্রাফিক
ট্রাফিক একটা খুবই বেসিক টেকনিক্যাল টার্ম এখনকার নিরীখে। কোন ওয়েবসাইটে ভিজিটর যাওয়াটাই হলো ট্রাফিক। এ কথা এখন সবাই জানে। তবে ২০০৮-৯ এর দিকে সামুর ব্লগাররা ছাড়া বাংলাদেশে বেশি মানুষ জানতো না। বলা হয়ে থাকতো যে ট্রাফিক কম হলে নাকি ব্লগের মালিক আরিল দুলাভাইয়ের টেনশন বেড়ে যেতো। সে ঘনঘন কফি খেতো আর পায়চারি করতো। ও হ্যাঁ, আরিল ভাইকে আমরা দুলাভাই বলতাম। ব্লগমাতা জানা আপার স্বামী তিনি, এবং তারা দুজনে হলেন ব্লগের অধিকর্তা, নতুন ব্লগারদের জ্ঞাতার্থে এই তথ্য জানিয়ে দেয়া হলো।
জুতা রেটিং
মাইনাস দিয়ে মন না ভরলে জুতা রেটিং দেয়া হতো। সাধারণত রাজাকারি পোস্টে জুতা রেটিং দেয়া হতো। জুতা রেটিং দেয়ার একটা ইমেজ ডিজাইন করেছিলো কেউ, সেটা দিয়ে ফ্লাডিং করা হতো কমেন্টে।
আংরেজি পোস্টে মাইনাচ- সেই সময় অনেকেই বাংলা লিখতে পারতো না। ইংরেজি বা বাংলিশে পোস্ট দিতো। তাদেরকে এই কথা বলা হতো।
ডিজিএম- দূরে গিয়া মরেন।
সিটিএন- (প্রকাশের অযোগ্য, সিনিয়র ব্লগারদের ইনবক্স করে জেনে নেন)।
কেক্কুক্কৈ? - কারো জন্মদিন উপলক্ষ্যে পোস্ট দেয়া হলে ক্ষুধার্ত ব্লগাররা এসে জানতে চাইতো কেক এবং কোক কোথায়?
অভিনন্দনপার্ক- কাউকে অভিনন্দন জানাতে গেলে অনেক সময় নন্দন পার্ককে টেনে আনা হতো।
আথমখে হাত পা… ব্লগে নাফে মোহাম্মদ এনাম নামে একজন হরর লেখক ছিলেন। তার হরর গল্পে কথায় কথায় চলে আসতো “আতঙ্কে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো”, সেটাকে ব্যঙ্গ করে বলা হতো।
আরো অনেক অনেক কথা মনে পড়ছে, অনেক ব্লগারের কথা, অনেক ক্যাচালের কথা, অনেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী পোস্টের কথা। সেসব বলতে গেলে মোটা একটা বই লিখে ফেলতে হবে। তাই র্যান্ডম নস্টালজিয়া এখানেই সমাপ্ত!
...এবং কিছু বাটারফ্লাই এফেক্ট
কী হতো যদি আমি হাই স্পিড ইন্টারনেটের বদৌলতে পাওয়া ইউটিউব আর ফেসবুকের মজা ভোলার জন্যে ব্লগে না আসতাম? ব্লগ আমার জীবনে শুধুমাত্র ৩৭৭টি পোস্ট আর ৬ লাখ+ হিটের গল্প না। আমার জীবনসাথীকেও ব্লগ থেকেই পেয়েছি। ব্লগ থেকে ফেসবুক, সেখান থেকে ছবির হাট, বইমেলা, ধানমন্ডি লেক হয়ে এখন আমরা মিরপুরের বাসায় একসাথে আছি দশবছর ধরে। দুটি সন্তানও হয়েছে আমাদের। ব্লগে একাউন্ট না খুললে জীবনের এই গল্পটা কিভাবে বদলে যেতো সেটা ভাবতেও চাই না, শুধু ধন্যবাদ জানাই নিজেকে, ভাগ্যিস একাউন্টটা খুলেছিলাম!
আমার স্ত্রী এখন আর ব্লগিং করে না। তার ব্লগ নিক ছিলো বলতে পারবেন? পুরাতন যারা জানেন, তারা বলে দিয়েন না। নতুনরা একটু গোয়েন্দাগিরি করুক, যদি চায়!
আমার প্রথম বইও বের হয় ব্লগের সৌজন্যে। প্রকাশক বাকি বিল্লাহ ভাই একসময়কার দুঁদে ব্লগার ছিলেন। ব্লগে আমার লেখা ছোটগল্প পড়ে তিনি বই বের করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সবগুলি গল্পই ছিলো ব্লগ থেকে তুলে দেয়া। এখন আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাতটি। সামনে আট নম্বর বই আসছে। ব্লগে না থাকলে কি এটা সম্ভব হতো? জানি না!
বাটারফ্লাই এফেক্ট নামে একটা তত্ত্ব প্রচলিত আছে। মহাবিশ্বের কোনখানে যদি একটা প্রজাপতি ডানা ঝাপটায়, তার কল্যাণে না কি অন্য প্রান্তে ঘূর্ণিঝড় হতে পারে। সামহয়্যারইনব্লগ আমার কাছে তেমনই একটা প্রজাপতির খামার। যেখানে প্রজাপতিরা ডানা ঝাপটিয়ে বদলে দিয়েছে আমার জীবনের লেখচিত্র।
প্রজাপতির ডানায় যে ঝড় শুরু হয়েছিলো, তা এখনও স্তিমিত হয় নি। এই উতাল বাতাস বইবে চিরকাল আমার হৃদয়ের গহীনে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ১০:২৪