মালা, এই ১২ই মে আমার তুমি জীবন থেকে চলে গিয়েছিলে। কাজটা ভালা করো নাই। রেব্যান দিয়ে চোখ ঢেকে লাভ কী? মৌলালির মোড়ের সেই মালাকে অস্বীকার করতে পারবে? আজ তোমার বিয়ের দিন। জন্মদিন থেকে তোড়া তোড়া ফুল আসছে। আমার ফুল দেয়ার টাকা ছিলো না। আমি তোমাকে দিতাম চিনাবাদাম। তুমি এখন হোম থিয়েটার লাগিয়েছো বাসায়। অথচ আগে আমরা একসাথে এন্ট্রালি সিনেমার ছেড়া সিটে ছারপোকার কামড় খেতে খেতে ছবি দেখতাম।
তুমি মধুবালা হও,সোফিয়া লোরেন হও, আমি পরীমনির ছবি দেখে সময় কাটাই। আলিয়ঁস ফ্রাসেতে যাওয়ার সুযোগ হয় নাই কখনও। তুমি কি মার্গারিটা খাও? আমার কেরুই চলে। মৌলালির মোড় আর মিরপুর এক নাম্বার একাকার হয়ে যায় যখন তুমি রোজ রাত্তিরে ঘুমের ঘোরে চলে আসো অঞ্জনের কণ্ঠ ধরে।
আলিয়স ফ্রসেতে যাও ভালো কথা, তোমার বাসায় ইমরান খানকে কফি খাওয়ার দাওয়াত দিও না দয়া করে! ঐ ব্যাটা একটা আস্ত হিপোক্রেট। ওর সবই শো অফ। সানন্দা কি এখনও পড়ো? আমি আগে তোমাকে চিত্রালী কিনে দিতাম। তুমি কত খুশি হতে!
দেখো মালা, কলকাতা, ঢাকা একাকার হয়ে যাচ্ছে। অঞ্জন আর আমি গলাগলি করে তোমার জন্যে কাঁদছি। অঞ্জনকে আজকাল খুব হতাশ মনে হয়। বয়স হয়েছে তার ৬৭। খালি কথায় কথায় মৃত্যুর কথা বলে। সেদিন এক লাইভে দেখলাম এক ঘন্টায় তিনবার সিগারেট ধরালো। এই বয়সে কি এসব মানায় বলো?
ভাবতে খুব ভালো লাগে, অঞ্জনটা তোমার জন্যেই ছন্নছাড়া রয়ে গেলো এমন। ও অবশ্য এখন আর রুবি রায়ের গান শোনাবে না তোমাকে। তার এখনকার গানগুলি শুনে দেখবে, বিশ্বশান্তি, সমকামীদের অধিকার, রেসিজম, এইসব বড় বড় ব্যাপার নিয়ে। এখন আর স্কুলের টিফিনের ফাঁকে চ্যাপ্টা গোলাপ নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করার দিনগুলির কথা বলে না। অঞ্জন কি শেষমেষ বুড়োই হয়ে গেলো?
মালা, ডাক্তার বলছে আমার ক্যালসিয়ামটা কম। আর জীবনের অংক মেলাতে তো আমি সবসময়ই কমজোরী ছিলাম। তাই এই চল্লিশে এসে চালশে না ধরলেও ক্ষয়াটে স্মৃতির পলেস্তারা ক্রমশ ধূসরিত করে আমার মন। চলে যাচ্ছে জীবন। নচিকেতার ভাষায় বলতে হয়, “এই বেশ ভালো আছি”। কিন্তু মাঝে মাঝে এই ভালো থাকাটা ভীষণ মেদবহুল আর স্থবির মনে হয়। নড়তে চড়তে কষ্ট হয়। তখন আমি নতজানু হয়ে থাকি ঈশ্বর অথবা প্রেমিকাদের দিকে।
তখন তোমার কথা মনে পড়ে। বুকের ভেতর আশালতা ল্যাগব্যাগ করে ওঠে । আমাকে কখনও কোন মেয়ে ছেড়ে যায় নি। আর তাই হয়তো বা আমি প্রকৃত প্রেমিক, শিল্পী বা মাতাল কোনটাই হয়ে উঠতে পারি নি। তুমি অঞ্জনকে ছেড়ে গিয়ে খুব ভালো করেছো। অঞ্জনকে আমি ভালোবাসি। ওর বিরহ ব্যথাটা প্রায় নিজের মত করেই অনুরণিত হয়।
তারপরেও, ভালোবাসায় কোন ফেয়ার প্লে নেই। অঞ্জন বরং নিমা রহমানের সাথে গানে গানে ভালোবাসা করুক, কিংবা কালো সাহেবের মেয়ের জন্যে হাপিত্যেশ করে মরুক। তুমি ঢাকায় এসে একবার আমার সাথে দেখা করে যাও। আমরা মোহাম্মদপুরে চাপ খাবো, সুজুকি কফিশপে কফি খাবো, সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখবো। কিন্তু কেউ কারো হাত ধরবো না। কেউ কাউকে স্পর্শ করবো না। অতঃপর আমাকে এই স্পর্শহীনতার আক্ষেপটুকু সম্বল হিসেবে সঁপে দিয়ে তুমি চলে যাও কলকাতায় তোমার আলিশান প্রাসাদে। জংলা পাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি আর পিসি চন্দ্রের ঝুমকো কানের দুল পরে রঙিন করো দিনটাকে।
আজ ১২ই মে। তোমার চলে যাবার দিন। ঈদের ছুটি কাটিয়ে এলাম গ্রামে। কিনেছিলাম নতুন জামা, খেয়েছিলাম মাংস এবং মিষ্টি। এসব কিছু ভালো লাগছে না। কখনও না যাওয়া কলকাতার গড়ের মাঠে গিয়ে চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।
মালা, তোমাকে ধন্যবাদ দুঃখকে এমন সার্বজনীন রূপ দেয়ার জন্যে। তোমার বিয়ের দিন ভালো কাটুক। ভালো থেকো। আর আমাকে নিয়মিত এমন তরতাজা দুঃখ দিও। শৈশবের সেই অদ্ভুত বেসুরো সুর আর শুনতে পাই না। বয়স বাড়ছে। রাত নামছে। এখন আর এই দুঃখটুকু ছাড়া সম্বল কী আছে বলো?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২২ রাত ১০:৫২