১।
লুব্ধক বাসে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে যতটুকু দেখা যায় দেখছে। আজকে সে একটা অনাথালয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এটাই প্রথমবার নয়। এই একই অনাথালয়ে সে প্রতিবছর যায়। একটা দু'টো দিন থেকে আসে।
আজকে সাথে কিছু কাপড়-চোপড় আর বই খাতা আছে। অনাথদের দেবে ঠিক করেছে। প্রতিবারই দেয়।
বাসে বসে বসে নানা রকম চিন্তা করতে করতে গন্তব্যে এগোচ্ছে লুব্ধক।
২।
পৌঁছে গেল গন্তব্যে। অনাথলয়ের গেট রাস্তার পাশেই দেয়া। নতুন করে বানানো হয়েছে এটা। আগে ছিল না। লুব্ধক সব পোটলা-পুটলি নিয়ে বাস থেকে নেমে গেট পেরোলো। একটা বড় আম গাছ আছে ওখানটায়। একটু দাঁড়ালো। মৃদু ঠান্ডা বাতাস গা জুড়িয়ে দিল ওর। গাছের পাতাগুলো ঝিরঝির শব্দ করছে। লুব্ধক তাকায় ওপরে। ওর বারবার মনে হয় এই গাছটা ওকে প্রতিবার আসার সময় অভ্যর্থনা দেয় এভাবে। একটা আরাম আর শান্তির লম্বা শ্বাস টেনে আবার হাঁটে লুব্ধক।
পেছনে পাতাগুলো তখনও ঝিরঝির শব্দ করছিল।
৩।
অনেক পথ হাঁটতে হয় এখানে। গেট থেকে অনাথালয়টা অনেক দূরে। পাহাড়ের ভেতর। একেবারে পাহাড়ের গা ঘেষে গোড়ায় একতলা অনেকগুলো টিনের চালা দেয়া ঘর। সাথে একটা প্রাইমারী স্কুল। যাতে আগে ছিল একজন মাত্র শিক্ষক। এখন সরকারের দৃষ্টিতে অবস্থাতে কিছুটা বদলেছে। কয়েকজন বাড়তি শিক্ষক পাওয়া গেছে। তবে নিয়মিত আসে না। আসলে একজন সন্ন্যাসী এই জায়গাটাতে অনাথালয়টার গোড়া পত্তন করেছেন।
লুব্ধক পাহাড় কেটে করা রাস্তাটায় হাঁটছে। চারপাশটা দেখে দেখে রোদের তীব্রতা ভুলতে চাইছে। রাস্তা দেখে ওর মনে পড়ে অনেক আগে এমনটা ছিল না। পাহাড় দিয়ে চলাফেরা করতে হত। নানা রকম প্রাণীদের সাথে নিত্য বসবাস ছিল এখানকার মানুষের।
এভাবেই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেল সে। দেখলো অনাথালয়ের ছোট্ট মাঠটাতে অল্পবয়ক ছেলে মেয়েরা খেলছে। ওকে দেখেই এক দৌড়ে চলে এল।
সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো লুব্ধক। এই আলয়ের তত্বাবধায়ক যোগেন বাবু
লুব্ধককে দেখে একটা স্নেহময় হাসি।
-- আসলি আয় ঠান্ডা পানি খা।
বসে পানি খেয়ে লুব্ধক প্যাকেটগুলো যোগেন বাবুকে দিয়ে দিলেন। যোগেন বাবু ও'কে তুই করেই বলে প্রথম থেকে।
দুপুরের খাবার খেয়ে লুব্ধক ঘুমোতে গেল। ভাঙ্গলো কিছু আলাপচারিতা শুনে।
নতুন একটা অনাথ শিশু এসেছে। যোগেন বাবু সাদরে বাচ্চাটাকে নিয়ে নিলেন। কিন্তু বাচ্চাটার সাথে আসা মানুষগুলোর দেয়া অর্থসাহায্য নিতে চাইছেন না। লুব্ধক মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এল। যোগেন বাবুকে বলতে শুনল
-আহা বলছি তো লাগবে না। এখানে বিভিন্ন সংস্থা আমাদের সাহায্য করছে। আমরা বাচ্চাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে কিচ্ছু নিই না। আপনি নিশ্চিন্ত মনে যান।
অভিভাবকগুলোও কুশল বিনিময় করে চলে গেল। লুব্ধক যোগেন বাবুর কাছে জানতে চাইল
- টাকাটা নিলেও পারতে ।
- ও উঠেছিস তুই! না না তা কেন এখানে তো আমাদের আছে। আর আমার নিজের কোনো টাকা দরকার তো নেই। বেতন যা পাই তাতেই চলে।
বাড়তি কিছু তো আর লাগে না।
লুব্ধক জানে যোগেন বাবু নিজেও অনাথ। বিয়ে টিয়েও করেন নি আর। তাই ও আর কিছু বলল না।
বাচ্চাদের থাকার ঘরটাতে চলে এল। ওখানে ছোট বড় অনেথা ছেলে মেয়েরা বই খাতা কাপড় পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। লুব্ধকের এটাই দেখতে ইচ্ছে করে। তাই বারবার আনন্দের ভাগি হতে চলে আসে এখানে। এই শিশুগুলোর হাসিটা একেবারেই অকৃত্রিম। ভাবতে ভাবতে সে নিজেও মনের অজান্তেই ওই হাসিতে যোগ দিল।
রাতে খাবার সময় যোগেন বাবুকে জানাল সে কালকেই চলে যাবে। যোগেন বাবু একটু চুপ থেকে বলল
- বুঝতে পারছিলাম বেশিদিনের জন্য আসিস নি। অফিসের চাপ থাকলে যা। জোর করছি না। তবে যাওয়ার সময় মনে করে সব ব্যাগে নিয়ে নিস।
এই সাবধান বাণী প্রতিবার শোনে সে। যদিও কখনই কিছু ফেলে যায় না। খেয়ে দেয়ে সামনের খোলা ছোট্ট মাঠে পেতে রাখা চেয়ারে একটু বসল। আজকে পূর্ণিমা। খুব সুন্দর হয়ে গেছে চারপাশ। রহস্যময় আলো ঘেরা। যোগেন বাবুও এল একটু পরে।
- দেখছিস, তোর পছন্দের পূর্ণিমা আজকে জেগেছে।
- হ্যাঁ। তুমি বসে আছ! ঘুমোবে না?
যোগেন বাবু কিছুক্ষণ লুব্ধকের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল,
- হুম একটু পরে যাবো। বয়স তো বেড়ে গেল অনেক। এখন এই দৃশ্যগুলো দেখে নিই। পরে তো হয়তো সময় পাব না আর।
লুব্ধক কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পেরে আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ চারপয়াশ দেখতে থাকলো।
সবুজ পাহাড়গুলো রাতের আঁধারে যেমন কালো দেখা যায় আজকে তেমন না। মায়াময় একটা সবুজ জড়ানো আছে।
আস্তে আস্তে চোখে ভারী হয়ে এলো লুব্ধকের। যোগেন বাবু ওকে শুয়ে যেতে বললেন।
৪।
পরদিন সকালে বেশ ভোরেই ঘুম ভাঙল লুব্ধকের। মুখ ধুয়ে দেখে যোগেন বাবু খাওয়ার ঘরে ওর জন্য অপেক্ষা করছে।
- আয় আয়। খেয়ে নে তাড়াতাড়ি। রওনা হতে হবে না তোকে।
চুপচাপ খেয়ে নিল। কোনো কথা বলল না কেউ।
এরপর ব্যাগ নিয়ে আবার পাহাড় কাটা রাস্তা ধরে হাঁটা ধরল। যোগেন বাবু খানিকটা এগিয়ে দিল ওকে।
এরপর রাস্তার বাঁকে যোগেনবাবুও হারিয়ে গেল।
পাহাড়ি রাস্তা শেষ করে অনাথালয়ের গেইটে লুব্ধক বাসের অপেক্ষায় আছে। সাথে মাথায় গতকালের সব কথা স্মৃতির মত করে ঘুরছে। মন খুব খারাপ হয়ে আছে। আসলে তার নিজের একসময়ের আবাসস্থল, একসময়ের খুব কাছের মানুষ যোগেনবাবুকে ছেড়ে যেতে ভাল লাগার কথাও নয়।
হঠাত শহরের একটা বাস পেয়ে গেল। চলে যাচ্ছে লুব্ধক। শুধু মনে এই আশা পরের বছর আবার আসবে।
৫।
ওদিকে আম গাছটা গেইটের গোঁড়ায় ঠাই দাঁড়ানো। যেন প্রিয় সন্তানকে বিদায় দিচ্ছে।
আর মৃদু হাওয়ায় গাছাটার পাতাগুলো তখন আগের মতো ঝিরঝির করছিল।