কোন কিছু হারিয়ে গেলে যেখানে হারিয়েছে সেখানে না খোঁজে আমরা যেখানে হারানোর কোন কথাই না সেখানেই খোঁজতে থাকি ।
রাত চারটার দিকে আমি আমার একটা সীম হারিয়ে ফেললাম । আমার বিছানার চাদরে এত কারুকাজ যে কোনটা সীম আর কোনটা কারুকাজ বুঝে উঠতে পারলাম না ।
দুইটা লাইট ধরালাম । কাজ হল না । আমি অন্ধের মতো হাত দিয়ে আলতো করে বিছানা বুলিয়ে খুজলাম কিন্তু পেলাম না ।
যতদূর মনে পড়ছে বিছানায়ই রেখেছিলাম । এর মাঝে বেশ কিছু চিন্তা মাথায় আসছে । এর তালিকা করলে এমন দাঁড়ায় -
১ । আচ্ছা, মানুষ কিভাবে পাগল হয় । সীমটা খোঁজতে খোঁজতে আমি কি পাগল হয়ে যাব । আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি । মাথাটা টেস্ট করা দরকার । পাঁচ বারো ষাট । হ্যাঁ , ষাটই তো । নাকি ক্যালকুলেটর এ দেখব ।
২ । আমি যখন সীমটা রেখে টয়েলেটে গেলাম । তখন কি সীমটার কিছু হয়েছে । কোন প্রেত আত্না সীমটা সড়িয়ে আমার সাথে মজা করছে । আমি তো ভূত প্রেত বিশ্বাস করি না । তাহলে এসব কি ভাবছি !
৩ । ঘরে কিছু ইঁদুর আছে । তবে , তারা ভদ্র । তারা তাদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকে । বাইরের কোন রেস্টুরেন্ট থেকে খাওয়া দাওয়া করে আসে । ঘরের কোন ক্ষতি করে না । নাকি সীমটা ইঁদুর তার মুখে করে নিয়ে তার গর্তে চলে গেছে ।
৪ । আচ্ছা ,সীমটা কি আমার শরীরের কোথাও রেখেছি । কানের পেছনে ? চেক করলাম । মাথার চুল ছোট করেছি তারপরেও মাথা হাতালাম কিছুক্ষণ । লুঙ্গি খুলে ঝাড়া দিলাম কিছুক্ষন । চেয়ারের ভেতর হাত ঢুকালাম । ধুলাবালি ছাড়া কিছু নেই। আরো যেখানে যেখানে খোজার কথা না সেখানেও খোজলাম । মোবাইলে ব্যাটারিতে কোন ফাঁকা আছে কিনা তা দেখলাম । বালিশের কভার খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ । নাহ , পেলাম না ।
৫ । আচ্ছা এমন তো হতে পারে পাঁচ দশ মিনিট আমার মাথা কাজ করছিল না ।সীমটা নিয়ে আমি নিজেই টয়েলেটে ফেলে দিয়ে এসেছি । টয়েলেটে গেলাম । সাবানের উপরে নিচে সব জায়গায় দেখলাম । সাবানেও লেগে থাকতে পারে । সীমটা গেল কই । নাকি চিবিয়ে খেয়ে ফেললাম !
আচ্ছা, সীমটা কি এতো জরুরী যে খুঁজতে হবে ? আমি তো কাউকে কল দেই না বা কেউ আমাকে । একবার ভাবলাম বাদ দেই । যা বাদ দেই ভাবি তা আমি আরো বেশি আগ্রহবোধ করি । কারন এখন আমার কাছে সীমটা পাওয়ার চাইতে সিমটা গেল কোথায় আর কিভাবে গেল তা খুঁজে বের করতে বেশি আগ্রহবোধ করছি ।
সেদিন পড়া মানিক বন্দোপাধ্যায়ের বিপত্নীক গল্পটা মনে পড়ল । সেখানে গল্পের নায়কের স্ত্রী গলায় ফাঁসি দেয় । গল্পের শেষে দেখানো হল লোকটা তার স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে তেমন ভাবছে না বরং ঘরের এত উপরে কিভাবে দড়ি লটকানো হল তা নিয়েই ভেবে অস্তির হচ্ছে ।
আমি কিছুই ভেবে পেলাম না । আমার খুঁটিনাটি শব্দ শুনে ভোর পাঁচটা বাজে বাবা মা এল আমার রুমে । কিরে বাবা কি খুঁজছিস । আমি যেন প্রান ফিরে পেলাম । যেকোন জিনিস বাবা ভালো খুঁজে পায় । তাই কিছু হারালে বাবাকে আগে বলি । বাবা বলল , বইয়ের ভেতর দেখ । আমি একত্রিশ পৃষ্ঠায় ছিলাম । পাতা উলটে দেখলাম । ঝাড়া দিলাম । নাহ , নেই ।
মা বলল , বাবা , অস্থির হইস না ।আমি পরে খোঁজে দিব । ঘরেই তো আছে । আমি এটা শুনে যেন আরো অস্থির হলাম । আরে , ঘরেই আছে তাহলে গেল কোথায় ।
ব্যাপারটা কেমন হল । ভোর পাঁচটা দিকে আমাদের পরিবারের সবাই আমার হারিয়ে যাওয়া সীম খোঁজছে ।
কিছুক্ষণ পর ভাবলাম তাদের কষ্ট দিয়ে লাভ নেই । বললাম ,থাক, ঘরেই আছে ,পাবো, সমস্যা নেই ।
মা বলল , ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহির রাজিউন পড়, পেয়ে যাবি । বাবা মা চলে গেল । আমি দুই একবার পড়লাম ।
লাইট দিয়ে খোঁজতে লাগলাম । খাটের নিচে ঢুকলাম । এই ঘরে আছি অনেকদিন কিন্তু আমার খাটের নিচে যে আরেক পৃথিবী পড়ে আছে তা আজ টের পেলাম । একটা জিনিস খোঁজলে আরেকটা জিনিস পাওয়া যায় ।
একটা পুরানো চিরুনি , একটা পুরানো পেন্সিল খুঁজে পেলাম । তার একটু ভেতরে তাকিয়ে দেখি সীমটা আমার দিকে তাকিয়ে মজা করে হাসছে । আমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকালাম । চোখে আগুন টের পেলাম ।
সীমটা হাতে নিয়েই আমার প্রথম ইচ্ছা হল সীমটা ভেঙ্গে দুই টুকরা করে ফেলি । একটা অকথ্য গালি দিলাম সীমটার দিকে তাকিয়ে যা কখনো কাউকে দেই না ।
নাহ , সীমটাকে বকে লাভ নেই । ওর তো আর পাখা গজায় নি যে নিজে নিজে উড়ে গেছে । দোষটা আমার । এই একটা সীম আমাকে কতগুলো অনুভূতি দিয়ে গেল তার হিসাব করলাম । একটু হাঁসি আসল তা ভেবে ।
ততক্ষনে সূর্য উঠে গেছে । নতুন দিনের শুরু ,যে দিনে আমি বা আমরা কিছুই হারাতে চাই না . . .
.
- পাভেল রইস
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:১১