somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার ভাইয়ের মৃত্যূ ও সৌদিদের ক্ষমার অযোগ্য বর্বর আইন ও হাহাকার

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘দিপু মারা গেছে’, কথাটা কত সহজ, এর ভাষাগত অর্থটাও সহজবোধ্য কিন্তু এর মর্মার্থ আমার মাথায় ঢুকছিল না। কথাটা শোনার পর আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম, বোঝার চেষ্টা করলাম এর অর্থ কি! আমার চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়, সুস্বাস্থবান প্রানচন্ঞল একজন। এই বয়সে এভাবে মারা যাবে আমরা কেউই প্রত্যাশা করি না। দিপু ভাই আর বড় ভাই দুজনের জেদ্দায় দুটো এলুমিনিয়াম ওয়ার্কশপ আছে, নিজেরাও কাজ করত। গত শনিবার কাজের সময় দুর্ঘটনাক্রমে মই হতে পড়ে যায় আর মইটি পড়ে ওর মাথার উপর। মইয়ের চোখা কোন অংশ মাথায় লাগে, এতে ওর মাথা ফেটে যায়। ওর সাথের লোকেরা সাথে সাথে হাসপালে নেয় কিন্তু ডাক্তাররা চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে পুলিস ক্লিয়ারেন্স ও দশ হাজার রিয়াল জমা দিলে তারা চিকিৎসা শুরু করবে। বড় ভাই ও দুলাভাই তখন দুরে ছিলেন, তাদের আসতে এক ঘন্টা সময় লাগে। এই পুরোটা সময় দিপু ভাইয়ের সেন্স ছিল। ও’ ডাক্তারদের অনেক অনুরোধ করেছে চিকিৎসা শুরু করার জন্য, বলেছে টাকা নিয়ে আসছে, টাকা কোন সমস্যা না। কিন্তু ডাক্তাররা টাকা আর ক্লিয়ারেন্স ছাড়া চিকিৎসা করবে না। আঘাত যেমন ছিল তাতে হয়তো সহজেই বাচানো যেত, এমনকি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েই হয়তো রক্তপাত বন্ধ করা যেত। বড়ভাই এসে টাকা জমা দেয়ার পরপরই ভাইয়ের সামনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। প্রথমে উড়ো খবর শুনেছিলাম বিল্ডিঙের অনেক উপর হতে পড়ে মারা গেছে, এসব ক্ষেত্রে তো বাচানোর কোন উপায় থাকে না, এমন হলে কোন ক্ষোভ ছিল না। কিন্তু যখন পুরো ঘটনা শুনলাম আমার ভেতর হাহাকার করে উঠল। যেহেতু ওর সেন্স ছিল সেহেতু ও বোঝতে পারছিল ক্রমাগত রক্তপাতে ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসার সব সুযোগ থাকা সত্যেও শুধু একটা আইন আর কয়েকটা টাকা জন্য হচ্ছে না। তখন ওর অসহায় অবস্থা কল্পনা করুন, ওর মনে তখন কেমন লাগছিল তা অনুভব করলেই আমার প্রচন্ড হাহাকার আর রাগ লাগে। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে কখন ভাই আসবেন, চিকিৎসা শুরু হবে, বাচার কি আকুতি! রক্তপাতে শরীর ক্রমেই নেতিয়ে যাচ্ছিল, শেষ পর্যন্তু কি বাচার আশা ধরে রেখেছিল, মৃত্যুর আগমুহূতের্র অনুভূতি? যখনই চিকিৎসা শুরু হবে তখনই সব শেষ। গত দুদিন আমার ঘুরে ফিরে বার বার শুধু একথাই মনে আসছে। সবকিছু কেমন সাজানো গোছানো ছিল, ওর বিয়ে ঠিক ছিল। দেশে আসলেই বিয়ে হবে। মেয়েটার সাথে দিপু ভাইয়ের প্রায় প্রতিদিনই ফোনে কথা হতো। সবার কত প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু সব ধ্বসে পড়ল!

সেজো চাচার কাছে জানলাম বর্বর আইনটার কথা। সৌদি আরবে কোন ধরনের দুর্ঘটনায় কেউ আহত হলে পুলিশ যতক্ষণ না ক্লিয়ারেন্স দেবে যে এটা দুর্ঘটনা কোন হামলা বা দুর্বিত্তের কাজ কি না তখন তার চিকিৎসা করবে। তারা নাকি প্রাই দেখেন রাস্তা দুর্ঘটনায় আহত লোক পড়ে কাতরাচ্ছে, কিন্তু পুলিশ আসার আগে কারো সাহায্য করারও অধিকার নেই, মারা গেলে শুধু একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে। একজন বোকা লোকেও বোঝবে এটা কতটা ধ্বংসাত্মক, অথর্ব আর বর্বর আইন। যেসব ব্লগার সৌদি আরবে আছেন তারা ভাল জানবেন। দুর্ঘটনায় আহত মানুষের যত দ্রুততম সময়ে করা যায় তাকে বাচানোর সম্ভবনা থাকে বেশি। স্বাভাবিকই পুলিশের ক্লিয়ারেন্স দিতে এক-দুই ঘন্টা সময় লাগবে। আর এই সময়ে সাধারণ চিকিৎসায় ভাল হতে পারে এমন লোকও মারা যেতে পারে। অনেক সময় মাসের মাসের পর মাস, বছরের পর বছর লাগেএকটা তদন্ত করে সঠিক তথ্য আবিষ্কার করতে, সেখানে একটা মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর চিকিৎসা আটকে থাকবে তদন্তের অপেক্ষায়। এটা নিঃসন্দেহে ‘খুনি’ আইন। এই আইন আইনপ্রণেতাদের বিবেক-বুদ্ধিহীনতার প্রমাণ। মানুষের জীবন আগে না তদন্ত আগে? তদন্ত করতে গিয়ে তারা সবচে’ বড় ‘আলামত’ মানুষটিকে হারায়। আর টাকার ব্যাপারটা কি বলব, আমাদের দেশেই এমনটা হয়। তবু আমাদের দেশের ডাক্তারদের বোঝানো যায়, কিন্তু ওরা মানুষের জীবনের কোন গুরুত্বই দিল না!
আমি এই আইনের কথা আগে জানতাম না। এক বন্ধু রিয়াদ হতে ফোন করলে ওকে বললাম, ‘এখন হতে দশ হাজার রিয়াল আর পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পকেটে নিয়ে ঘুরবি, বলাতো যায় না কখন কি হয়ে যায়’। উত্তর দিল, ‘কি আর হইব, মরুম, তুই দেশে থাইকা এই কথা কস, তাইলে বোঝ এই দেশে আমাদের কেমন লাগে’! বাংলাদেশের দশলাখেরও বেশি মানুষ সৌদি আরবে থাকে। বলা চলে এই দশলাখ মানুষ মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়েই সেখানে কাজ করে (মৃত্যূর পরোয়ানা সব মানুষের মাথায়ই আছে কিন্তু এমন নয়)। মানুষগুলো কিরকম ঝুকিতে আছে, তা অকল্পনীয়, আহত হলে চিকিৎসা হবে না। আর বাংলাদেশীরা সেখানে ঝুকিপূর্ণ কাজগুলো বেশি করে। কল্পনা করুন একজন মানুষ রাস্তা আহত হয়ে কাতরাচ্ছে, তখন তার অধিকার চিকিৎসা তা পাচ্ছে না, দেশে তার স্বজন ঘুনাক্ষরে তা জানতে পারল না, সেই হয়তো তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এই অসহায় অবস্থার কথা মনে করলেই ওই বর্বর জানোয়ারদের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা-ক্ষোভ লাগে। যেহেতু এর সাথে আমাদের দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবন জড়িত তাই মনে করি আমাদের সরকারের এই আইনের বিরুদ্ধে সুপারিশ করার অবশ্য দায়িত্ব রয়েছে। আমার ভাইকে তো আর ফেরত পাব না, কিন্তু এই আইনটি বিশ্ববাসীর নজরে আনার প্রয়োজন রয়েছে, এটি রহিত করা প্রয়োজন। আমি এ ব্যাপারে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাথে যোগাযোগ করতে চাই, কিভাবে কি করতে পারি পরমর্শ দরকার।
দিপু ভাই আর আমি প্রায় একই সময়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছি, ওর অধিনায়কত্বে অনেক ম্যাচ খেলেছি, এক সাথে আম চুরি করতে গিয়েছি, মোটরসাইকেল চালিয়েছি, একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছি। দুই বছর চারমাস আগে ও’ যাবার আগের দিন একসাথে নদীতে গোসল করলাম, ভাটি (নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে এক ঘাট হতে আরেক ঘাটে যাওয়া) ছাড়লাম। দিপু আমার চাচাতো ভাই, জন্মগত দিক থেকে ওর পরেই আমার অবস্থান। তাই ছোটবেলা হতেই ঝগড়া-মিল, এভাবেই কাটিয়েছি। যখন নদীর পাশে রাস্তা দিয়ে হাটি ভাবতেই পারি না এই নদীতে আর একসাথে গোসল করতে পারব না, ও আর এই পথে হাটবে না। ওর মৃত্যূর সময়কার ওর অনুভূতি কেমন ছিল মনে পড়লেই, মনে পড়লেই.....। অনেক সময় মানুষ টাকার অভাবে, চিকিৎসকের অভাবে, চিকিৎসা সরন্জামের অভাবে মারা যায়, কিন্তু ওর চারপাশে সবই ছিল.....। এই লেখা যখন লেখছি, কয়েক ঘন্টা আগে ওকে জেদ্দায় দাফন করা হয়েছে। এখন হজ্বযাত্রীদের চাপ, তাই দেশে আনতে গেলে এক মাস দেরী হতো তাই সেখানেই কবর দেয়া হয়েছে। তাছাড়া মনে করব, বিদেশে গেছে, ভাল আছে, আর কোন দিন দেশে ফিরবে না এই যা, এই অনুভূতিটুকোই থাক।


আপডেট: মূল লেখা এডিট করা হয় নি
ব্লগারদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমি পুরো ঘটনা আরো বিস্তারিত খোজ নিলাম। আমার লেখার সাথে যে সব তথ্য যোগ ও পরিবর্তন দরকার-
* ওর মাথা ফেটে রক্ত বের হয় নি। রক্ত ঝরেছে কান দিয়ে।
* নিকটবর্তী হাসপাতালটিতে নিজেই হেটে গিয়েছিল।
* হাসপাতালটি বেসরকারী।
* ওর ইন্সরেন্স করা ছিল, তবে হাসপাতালটি সেই ইন্সুরেন্স একসেপ্ট করে নি।
* দুলাভাই ও বড়ভাই এসে টাকা জমা দেয়ার পর চিকিত্সা শুরু করে, এবঙ শুরুর পরপরই মারা যায়।
* দুলাভাই বললেন দুটোই কারন, তবে মূলত টাকার জন্য চিকিত্সা করে নি।

পাশাপাশি একটা বাংলাদেশী চিত্র বলি, আমাদের এলাকার আব্দুর রব চাচা তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছিলেন মেরি স্টোপস হাসপাতালে। রাতে অপারেশন করতে হবে। আপারেশনের আগে বিশ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। তার কাছে ছিল মাত্র চার হাজার টাকা, তখন টাকা দেয়ার মত কোন আত্মীয় ছিল না। হাসাপাতাল কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে বলে পরদিন সকালে বাকি টাকা জমা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে অপারেশন করে। এটা বাংলাদেশ। আর ওখানে টাকা নিয়ে আসছিল।

এমনেস্টির কাছে যাওয়ার প্রসঙ্গে অনেকেই আমার বক্তব্য বোঝতে পারেন নি, তাদের বলছি ৩১ ও ৪৫ নং মন্তব্য ও উত্তর বিশেষ দ্রষ্টব্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:১২
৬৯টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন পারাবার: শঠতা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪০


অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাশ করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।

স্কুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×