somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মা

২৩ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৮:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ওসি সাহেবের চা খাওয়ার শব্দে ঘরটা মোটামুটি কাঁপচ্ছে। চা খেতে কেউ এত শব্দ করতে পারে তা আমিন মেম্বারের ধারণা ছিল না। তার উপর যে চেয়ারটায় সে বসে আছে যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।প্রায় তিন পা বিশিষ্ট এই চেয়ারটার থাকা উচিত ছিল সার্কাসে, সেটা এই বিনোদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কি করচ্ছে আমিন মেম্বার বুঝে উঠতে পারছে না। শালার স্কুলের হেড স্যারটা একটা ছাগল।

আনমনেই তার মুখ থেকে খিস্তি বের হয়ে গেল, ‘ব্যাটা খচ্চর’
সঙ্গে সঙ্গে ওসি সাহেবের চা খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল… গলা খাকড়ি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেম্বার সাহেব কি কিছু বললেন?’
‘এ… না মানে ভাবতেছিলাম ব্যাপারটা লইয়্যা কি করন যায়’
‘এত ভাবাভাবির কি আছে? সব তো আপনাকে আমি জলবৎ তরলং করে বুঝিয়ে দিলাম’

হ … ভালই বুঝাইচ্ছস ব্যাটা খচ্চর। সবই যদি তোর অই জলবৎ তলবৎ হয় তাইলে তুই যানা খচ্চর… আমারে লইয়্যা টানস ক্যান। এমনিতেই শালার অর্শরোগটা আমারে যা পেইন দিতাছে। কাল সারারাত ঘুম হয় নাই তার উপর সকাল না হইতেই হেড ছাগুটা গিয়া ম্যাতকার শুরু কইরা দিছে। যেন তার স্কুলে ওসি আসে নাই তার শ্বশুর আসছে।

‘আপনি বড়ই জ্ঞানী মানুষ ওসি সাব… আপনি বুঝাইয়া কন। আমি কি বলতে কি বলি।’
‘ওহ মেম্বার সাহেব বেকুবের মত কথা বলবেন না… আমি আইনের লোক, আমার একটা বাইন্ডিংস আছে না।’
‘তা তো বটেই তা তো বটেই’।
পায়ুপথে আবার জ্বালাপোড়া শুরু করছে দেহি। মর জ্বালা নড়বারো তো পারুম না চেয়ারটার লাইগ্যা। আর হেড ছাগুটা কি মঙ্গল গ্রহে গেল গা নাকি। মঈন গো বাড়ি স্কুলের থন ১০ মিনিটের হাঁটা পথ।বড়জোর ৩০ মিনিট লাগনের কথা কিন্তু এরিমধ্যে ঘন্টা পার হইয়্যা গ্যাছে গা। তাইলে কি মঈনের মা ……

আমিন মেম্বারের কপাল বেয়ে ঘামের চিকন ধারা নেমে আসছে। বিষয়টা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। এ সব অজ পাড়া গায়ের প্রভাবশালী কেউ হওয়া যেমন মজার আবার তেমনি এরকম হাঙ্গামায় নাকালের এক শেষ হতে হয়।

‘মেম্বার সাহেব আমি নিজেই যখন এখানে এসেছি বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ’
‘তা আর কইতে স্যার, আপনি চিন্তা কইরেন না’

‘ওসি স্যার … মেম্বার সাহেব আমি দুঃখিত… দেরী করার জন্য, রিয়েলি সরি’

ব্যাটা হেড হনুমান দেহি সাধু আর ইংরেজী ভাষার ঝড় চালাইতাছে। ‘এতক্ষণ কি করলা মাষ্টার?’
‘আর বইলেন না মেম্বার সাব… মহিলাটারে কোনভাবেই আনবার পারতেছিলাম না’
ওসি সাহেব নড়চড়ে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘উনি আসছেন?’
‘আসবে না মানে … আমি নিজে গেছি শুধু ও ক্যান ওর চৌদ্দগুষ্ঠি আসবে’
ব্যাটা আবার ম্যাতকার শুরু করছে দেহি; ‘মাষ্টর বেশি কথা বলবা না… যাও ওরে ভিতরে পাঠায় দাও আর তুমি বাইরেই থাইকো। ওসি সাহেব আর আমি অর লগে নিরালায় কথা কমু বুঝছো?’

দিলে বড় দাগা লাগল। এই এলাকায় তার মত শিক্ষিত লোক আর কেউ নাই। আর অই মূর্খ মেম্বার তারে কই সে থাকলে কিনা সমস্যা হইবো!! এই দেশটার এজন্যই কিচ্চু হইবোনা। মানীর মান নাই।

‘মঈনের মা ভিতরে যাও। ওসি সাব তুমার লগে কথা কইবো। আর ফুলিরে বাইরে রাঈখ্যা যাও। পুলাপান লইয়্যা এই ঝামেলায় আসো ক্যান?’
কে শুনে কার কথা… মঈনের মা যেন এ জগতে নেই। তার ঝাপ্সা চোখ দুটো স্কুলের মাঠ পেড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

‘অই কি হইলো? মর জ্বালা… আরে তোর এসব ন্যাকামো বন্ধ কইরা ভিত্রে গিয়া শোন কি বলে… যা… ফুলি তোর মার আচল ছাইড়্যা দে’

‘আসো আসো মঈনের মা… আছো কেমুন? ঈশ রে তোমারে তো একদম জিন্দা লাশের মতন লাগতাছে’, আমিন মেম্বার ওসি সাহেবের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার তাইলে শুরু করি।’
ওসি সাহেব কিছু না বলে মাথা নাড়লেন। তার খুব অস্থির লাগছে। কেন লাগছে বুঝতে পারছেন না। এরকম ব্যাপার পুলিশি জীবনে ঘটতেই পারে। কিন্তু মহিলাটার চোখের দৃষ্টিটা এমন কেন? ঊফ!! একটা সিগারেট ধরালেন।

‘মঈনের মা তুমার উপর দিয়া যে কি যাইতাছে আমরা সবাই জানি। এরম একখান ঘটনা যে ঘটবার পারে কেউ কি ভাবছিল কও। এমন একটা তরতাজা পোলা হঠাৎ চইল্যা গেল’
ওহ খোদা… একখান লাশের লগে কি কথা কওন যায়… কিন্তু
‘শোন সব কিছুই ঐ উপরওয়ালার অছিলা। নইলে তুমি কও ঐ চায়ের দোকানে কত্ত মানুষ আছিল… গাড়িটা ক্যান তুমার পোলার গায়েই উঠবে? ইউ, এন,ও সাহেবের পোলা কি আর ইচ্ছা কইরা এইটা করছে। হঠাৎ বেরেক ফেইল হইছে। কি আর করবা কও আল্লার মাল আল্লা নিছে। যা হওনের তা তো হইয়্যায় গেছে তাই না। তুমি যদি এখন থানায় যাও তাহলে তোমার পোলার বয়সী আরেকজনের ঝামেলা হবে… কও তুমি কি তা চাও’

মঈনের মা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে… কার দিকে কে জানে…

‘শোন ইউ,এন,ও সাব একটা প্রস্তাব পাঠাইছেন… তোমারে প্রতিমাসে ২০০০ টাকা কইরা দিবেন আর তোমার ঘরটাও ঠিকঠাক কইরা দিবেন। তুমি চিন্তা কর কি দয়ার শরীর উনার। তোমার ফুলির কথাটাওতো ভাবা দরকার তাই না। ও মঈনের মা কি বলছি বুঝতে পারছো’

আবার সেই খালি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।

‘শুনুন আপনি চাইলে মামলা করতে পারেন। কিন্তু মামলার খরচ চালাবেন কেমন করে? আর ঘটনাটাতো হঠাৎ করেই ঘটে গেছে তাই না… আদালতেও আপনার অভিযোগ ধোপে টিকবে না। খুব বেশি হলে জরিমানা করবে। উনারা মানী লোক অহেতুক ঝামেলায় যেতে চায়ছেন না দেখেই এই প্রস্তাব। এখনি কিছু বলার দরকার নেই আজকের দিন ভাবুন কালকে মেম্বার সাহেবকে জানালেই হবে। এখন আপনি আসতে পারেন।’

মঈনের মা ধীরে ধীরে বাইরে বের হয়ে আসলো। ফুলিকে যে জায়গায় বসিয়ে রেখে গিয়েছিল ঠিক সে জায়গায় বসে আছে। আসলে তার ৬ বছরের মেয়েটির পক্ষে একই জায়গায় বসে থাকাটাই স্বাভাবিক। এখনো সে মা ছাড়া আর কিছু ডাকতে পারে না। মা আর তার প্রিয় ভাইটাকে ছাড়া কাউকে সে চিনেও না। ভাই বোন দুটা ছিল মানিকজোড়।
এখনো অবুঝ চোখ দুটা ভায়কে খুঁজে ফেরে…

স্কুলের মাঠের শেষে এঁদো ডোবাটার পিছনে সূর্য্যটা ডুবতে শুরু করেছে। মঈনের মা ফুলিকে কোলে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেই সূর্য্যের পানে। হঠাৎ সায়াহ্নের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি বাচ্চা মেয়ে ডেকে উঠলো ‘মা…’


সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৮:৪৪
৪১টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×