১৯৭১ এর ২৫ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে করুন এক দিন।সে রাতে মানবতার ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম উপায়ে নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাপুরুষোচিত নির্মম গনহত্যা চালায় বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনি।
৭০ এর নির্বাচনে হেরে গিয়ে বাঙ্গালির উপর এমনিতেই ক্ষ্যাপা ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।যত রাগ ক্ষোভ ছিল তার পুরোটাই উগরে দেয়ার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আঁটঘাট বেঁধেই তারা হামলা চালিয়েছে ঘুমন্ত বাঙ্গালির উপর।এদেশের রাজনৈতিক নেতা,সচেতন তরুন প্রজন্ম আর প্রতিবাদী মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য বিশেষ বিশেষ স্থানে(যেমন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,ইপিয়ার,রাজারবাগ পুলিশ লাইন) হামলা চালায়।ইতিহাসের জঘন্যতম এই হামলার একটা গালভরা নামও দেয় তারা যা অপারেশন সার্চলাইট নামে অভিহিত।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন।পাকিস্তানী পরিকল্পনাকারিদের গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন অংশ এবং স্বশস্ত্র বাহিনীর যারা সামরিক শাষনকালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। অপারেশনের সর্বোচ্চ সার্থকতার জন্য ধুর্ততা, চমকে দেয়া, প্রবঞ্চনা, এবং দ্রুতগতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয়। নির্বাধ এবং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সাধারণ জনবসতি এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান এবং আক্রমণের কর্তৃত্বও প্রদান করা হয়।সেই পরিকল্পিত হামলার সাফল্যের জন্য হানাদারদের নেয়া পদক্ষেপগুলো......
১. সারা পূর্বপাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করতে হবে।
২. সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে।
৩. ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হওয়া বাধ্যতামূলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশী করতে হবে।
৪.সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অস্ত্র ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়।
৫.টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে।
৬.সকল পূর্বপাকিস্তানী (বাঙালি) সৈন্যদলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিস্ক্রিয় করে দিতে হবে।
৭.আওয়ামী লীগের মনে ভূল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্থাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন।
পরিকল্পনায় পূর্ব নির্ধারিত আক্রমণাত্মক অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থানগুলো ছিল- ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সমাবেশ বেশি ছিল। পূর্বপাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত সৈন্যদল এবং প্যরা মিলিটারি বাহিনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রয়ে যাবে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য স্থানে প্রাথমিক অপারেশনের সময় শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যোগ দেবে। ঢাকা সম্পুর্ন নিরাপদ হলে পাকিস্তানের ৯ম এবং ১৬তম ডিভিশনের সৈন্যরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য বিমান যোগে ঢাকা চলে আসবে।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীকে একটা মেসেজ দিয়েই রেখেছিলেন যার মর্মকথা ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই মুক্তি ছিনিয়ে আনতে হবে,আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করতে হবে।বীরের জাতি,অত্যাচার হামলায় দমে যাওয়ার পাত্র নয়।সেই ভয়াল রাতের আক্রমন-হত্যা বাঙ্গালিকে আরও ক্রুদ্ধ করে তোলে যার ফলে তারা প্রবল প্রতিরোধ তৈরী করে যা হানাদাররা ভাবতেও পারেনি।
এই ভয়াবহ গণহত্যা ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং বাঙালিরা দখলদারী পাকিস্তানী বাহিনীকে বিতারিত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয়।সকল শ্রেনী-পেশার মানুষ নিজের মাতৃভূমিকে শত্রমুক্ত করার মরনপন লড়াইয়ে অবতীর্ন হয় কিন্তু এদেশের কিছু কুলাঙ্গার পাকিস্তানীদের সাথে হাত মিলিয়ে দেশের মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ-লুন্ঠন চালায়,বিশেষ করে এদেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়।
দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের ফলে,অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ কিংবা তারও বেশি মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় কাংখিত স্বাধীনতা।আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড এবং লাল সবুজের পতাকা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৩:৩৮