somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট গল্প: বিপদ

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

‘নাম কী?’

‘নাইমুল হাসান’

‘মোহাম্মদ নাই?’

‘জ্বী না।’

‘নাই ক্যান?’

‘আমাদের মহানবীর বংশধরদের নামে কি মোহাম্মদ আছে?’

‘সেইটা আমার জানার দরকার নাই। বাবার নাম বল।’

‘আজিজুল হাসান।’

‘কোন থানা?’

‘বাড়ির থানা? নাকি যেখান থেকে আসছি?’

‘যেখান থেকে আসছ।’

‘মোহাম্মদপুর।’

‘কী কেস?’

‘মিথ্যা কেস।

‘সত্য না মিথ্যা সেটা আদালত দেখবে। চার্জ কী?

‘চুরি।’

‘অ। তোমারে দেখলে তো চোর মনে হয় না। যাকগা, সাথে টাকা পয়সা থাকলে জমা দ্যাও। পরে ফেরত পাবা।’

‘তিনশ টাকা আছে।’

‘দ্যাও।’

‘এখান থেকে দুইশ পাইবা।’

‘ক্যান?’

‘আচ্ছা। আড়াইশ। আর কথা কইও না। যাও। ঐ! পরের জন আসো।’

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এভাবে প্রবেশ নাইমুলের। তার বয়স তেইশ। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। সদ্য বিয়ে করেছে খালাতো বোন মিতুকে। চাকরি করছিলো একটি ডেভেলপার কোম্পানিতে। মোহাম্মদপুরে তার সাইট। সেখানে আটতলা ভবন নির্মাণ কাজ চলছে। এই প্রজেক্ট তার চাকরি জীবনের প্রথম প্রজেক্ট। সাইটের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়েছে, কারণ আগের সাইট ইঞ্জিনিয়ার সাইদের চাকরি হঠাৎ চলে গেছে। অফিসের লোকজন বলছে, সাইদ টাকা মারতো, কন্ট্রাকটরের কাছ থেকে ঘুষ খেতো ইত্যাদি ইত্যাদি। নাইমুল পলিটেকনিক থেকে পাশ করে বের হয়েছে গত বছর। বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করতে করতে অবশেষে এখানে তার চাকরি হয়েছে। গত বছর প্রজেক্টের শুরু থেকে সে আছে। সৎ হিসেবে খানিকটা পরিচিতিও হয়েছে এখানে তার। তাই সাইদকে সরিয়ে এম.ডি. সাহেব বিশ্বাস করে তাকে সাইটের দায়িত্ব দিয়েছেন।

গতরাতে সাইট থেকে সব রড চুরি হয়ে গেছে। কয়েক টন রড ছিল। সে নিজের হাতে সেগুলো একটা লোহার খুঁটির সাথে লোহার শেকল দিয়ে তালাবদ্ধ করে গেছে। একটি চাবি থাকে তার কাছে। অন্যটি থাকে এম.ডি. সাহেবের কাছে। আজ সকালে সাইটে এসে সে দেখে, খুঁটির সাথে রড নেই, শেকলটা কোনো যন্ত্র দিয়ে কাটা হয়েছে! শীতল স্রোত বেয়ে গেল নাইমুলের শিরদাঁড়া বেয়ে, এরকমটা সে এত কাল বইতে পড়েছে, আজ প্রথম অনুভব করল। দারোয়ান ইসমাই কে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। দেখা গেলো, কিছুই জানে না সে। নাইমুল জানে, ইসমাইল সত্য বলছে। এই ছেলেটি তারই গ্রামের ছেলে, একে সে-ই চাকরি দিয়েছে সপ্তাহখানেক আগে।

এত সকালে এম.ডি. সাহেবকে ঘটনা জানাবে কি না, তা নিয়ে খানিকক্ষণ ইতস্তত: করছিল নাইমুল। অবশেষে ফোন করে জানালো সব। তিনি সাথে সাথে চুরির মামলা করতে নাইমুলকে পাঠালেন থানায়। থানায় ঘটলো আরেক নাটক:

ডিউটি অফিসার বললেন, ‘রড চুরি হয়েছে। কাউকে সন্দেহ হয়?’

‘জ্বী না। আপনারাই তো খুঁজে বের করবেন, কে চুরি করল। এলাকায় কারা এসব করে, তা আপনারা জানেন না?’

‘আপনি তো মিয়া বেশি কথা বলেন!’ ধমকে উঠেছিলেন তিনি।

নাইমুল অপ্রস্তুত। সে বলল, ‘দেখুন, আমাদের রড হারিয়েছে। আমরা মামলা করব। আপনারা খুঁজে বের করবেন, কে বা কারা চুরি করলো, ব্যাপারটা কি এরকম নয়?’

‘আরে ভাই, দেশে কত বড় বড় অপরাধ ঘটে চলেছে, আর আপনি আসছেন রড চুরির কেস নিয়ে!’

নাইমুল বুঝলো, এই লোক কেস না নেবার জন্যে এরকম করছেন। সে বলল, ‘ও.সি. সাহেব কোথায়? তাঁর সাথে দেখা করব।’

‘স্যার নেই। কাল হরতাল। আজ স্যার বাইরে ডিউটি করবেন।’

নাইমুলের ভাগ্যটা ভালো ছিল, নাকি খারাপ? তখনই দেখা গেলো ও.সি. সাহেব অফিসে ঢুকছেন। প্রহরীর স্যালুট ঠোকা দেখে নাইমুল সেটাই আন্দাজ করলো। থানার বারান্দায় সে ও.সি. সাহেবকে বিষয়টা বলল। তার মোবাইল ফোন দিয়ে এম.ডি. সাহবের সাথে ও.সি. সাহেবের কথা বলিয়ে দিলো।

আধঘন্টার মধ্যে এম.ডি, সাহেব এলেন থানায়। নাইমুলকে বাইরে বসিয়ে রেখে ও.সি. সাহেবের রুমে চলল আলোচনা। এম.ডি. সাহেব এবার মামলা করলেন নাইমুলের নামে। নাইমুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রেফতার হলো। একটুপর গ্রেফতার করে আনা হলো ইসমাইলকেও। দু’জনকে হাতকড়া পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো থানার ভেতরের করিডোরে। যাবার আগে এম.ডি. সাহেব বলে গেলেন, ‘আমার ৪ লাখ টাকার রড চুরি গেছে। চুরির জন্যে তোমরা দায়ী। রড যদি ফেরত না দাও...’

কথা শেষ না করে তিনি চলে গিয়েছিলেন। নাইমুল তার এই ক্ষুদ্র জীবনে এত বড় বিপদে আগে কখনও পড়েনি।





২.

সপ্তাহখানেক কেটে গেছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। গত শনিবার সে এসেছিল, আজ পরের রবিবার। নাইমুলের ঘুম ভাঙলো ভোর ছ’টায় গেইট খোলার শব্দে; সবার হুড়োহুড়ি লেগে গেল গোসলে যাবার; সারা রাত ওরা জড়াজড়ি করে শুয়েছিল গরমের ভেতর। নাইমুল নির্বিকার শুয়ে রইলো; জায়গা পেয়ে এবার একটু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমালো কিছুক্ষণ। কারাগারে আসার পরদিন বিকেলেই ‘যমুনা’ থেকে তাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে ‘মণিহার’ ভবনে। দারোয়ান ইসমাইল গেছে পদ্মায়। এখানে আসার আগে তাদের চুল কেটে দেওয়া হয়েছে, বুকে কয়েদি নাম্বার লেখা বোর্ড লাগিয়ে ছবি তোলা হয়েছে এবং আবারো নাম-ধাম, সনাক্তকারী চিহ্ন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। একটা ছোট দলের সাথে নাইমুলকে থাকতে হচ্ছে। ‘পরিবার’ বলা হয় প্রতিটি দলকে। প্রত্যেক পরিবারের থাকে একজন প্রধান। এই পরিবারের প্রধান আকরাম হোসেন, অস্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। মিতভাষী, সহজ-সরল মানুষ; মাগুরায় ভ্যানচালক ছিলেন। তার চাচাতো ভাই নাকি শত্রুতা করে তার ভ্যানের পাটাতনে অস্ত্র রেখে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছে! অপরাধ প্রমাণিত, তাই সাজা ভোগ করছেন। আরো তিন বছর তাকে জেলে থাকতে হবে।

নাইমুল এখন শুয়ে আছে মণিহারের বারান্দায়। একটু পর পর বৃষ্টি নামছে, নাকে এসে লাগছে পাশের নর্দমা থেকে আসা পঁচা খাবারের গন্ধ; অবশ্য ঢাকার রাস্তায় চলতে-ফিরতে এমন গন্ধ প্রায়ই নাকে ধাক্কা দেয়। নাইমুল ভেবে দেখলো, এখানে যাদের সাথে সে আছে, তারা কেউই মানুষ খারাপ নন। খারপর মানুষ জের যত জন আছে, তার চেয়ে জেলের বাইরে বিশ। কে বেশি খারাপ? পেটের দায়ে পকেট মারতে গিয়ে যে ছেলেটা ধরা পড়ে এখানে এসেছে সে, নাকি একজনের রড-চুরির দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপালেন যে এম.ডি., তিনি?

এই ক’দিনে নাইমুল বয়স যেন বেড়ে গেছে কয়েক বছর। শুয়ে-বসে, লোকজনের সাথে কথা বলে আর লাইব্রেরিতে বই পড়ে সময় কাটে। দিনে কয়েকবার গোসল করে ভবনের বাইরের বিশাল হাউজে। নামাজ পড়ে সময় মতো। সারাদিন দোয়া করতে থাকে মুক্তির প্রত্যাশায়। আর অপেক্ষা করি, কখন তার বাবা অথবা মিতু আসবে দেখা করতে...।

কত মানুষের সাথে পরিচয় হলো এখানে, কত বিচিত্র সব কাহিনি একেকজনের! কেউ ধরা পড়েছে মাদক মামলায়, কেউ বা জমি-সংক্রান্ত প্রতারণায়। অধিকাংশেরই দেখছি মিথ্যা মামলা। মামলা চলছে, রায় হচ্ছে না, তাই জেলখানায় কাটছে তাদের দিন-মাস-বছর। মধ্যবয়সী মকবুল চাচা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তাঁর মেয়ের সন্তান হবার দিন পুলিশ ধরেছে তাঁকে। অর্থ-আত্মসাৎ-এর অভিযোগে। সেই শিশু এখন কথা নাকি কথা বলতে শিখেছে। তিনি পড়ে আছেন জেলে, বিচারাধীন। জানতে পেলো উকিলদের নির্মমতার গল্প। তাঁরা নাকি চান না মামলার রায় হোক। রায় আসামীর পক্ষে যাক বা বিপক্ষে, তা নিয়ে উকিলদের মাথাব্যথা নেই। মামলা চললেই তাঁরা খুশি, আসামী জামিন না পেলে আরো খুশি। কারণ, প্রতিবার মামলা কোর্টে উঠবে, আর তাঁদের পকেট ভরবে। এসব গল্প শুনতে শুনতে সকাল ন’টার দিকে এলো রুটি-গুড়; সেটা খেলো সবাই বুভুক্ষের মতো।



জোহরের নামাজ পড়ছিল নাইমুল ‘পদ্মা’ ভবনের সামনের মসজিদে। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে আল্লাহর কাছে আমার মুক্তি প্রার্থনা করছিল; চকিতে মনে হলো, সে তো জীবনে কখনও কোনো অন্যায় করেনি, তাহলে আমার সাথে এমন কেন হলো? পরক্ষণেই যেন পেয়ে গেলো জবাব, হয়ত সে কারণেই বিপদটা আরো বড় আকারে আসেনি, অপরাধ স্বীকারের জন্যে রিমান্ডে নেওয়া হয়নি তাকে। রিমান্ডের কথা মনে হতেই চমকে উঠলো সে; চোখ খুললো। আর চোখ খুলেই দেখলো আকরাম দাঁড়িয়ে আছেন; জানালেন তার গেস্ট এসেছে। আকরামের পাহারায় ছুটে গেলো নাইমুল তার প্রিয়জনদের সাথে দেখা করতে। মিতু আর নাইমুলের বাবা আগেও দু’দিন এসেছে দেখা করতে। সব খবরাখবর পাচ্ছিলো সে সংক্ষেপে। তবে দেখা করার এই স্থানটি এতই সংকীর্ণ, জনবহুল আর হট্টগোলপূর্ণ যে, কারো কথা ঠিক ভাবে শুনতে পায় না কেউ। প্রচুর লোক চিৎকার করে কথা বলছে। দু’স্তরের গ্রিলের মাঝখানে হাতখানেক ব্যবধান; তার একপাশে আমি, অপর পাশে বাবা আর মিতু। ওদের দেখে নাইমুলের মনে হলো, সে এখানে যেটুকু খাওয়া-দাওয়া করছে, ওরা তাও করছে না। বাবার বয়স যেন বেড়ে গেছে কয়েক বছর। মিতু শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখ বসে গেছে, নিচে কাল ছোপ!

আজ ওদের সাথে উকিল সাহেবও এসেছেন; ওঁরা জানালেন, নাইমুলের জামিন হয়ে গেছে। শুনে খুশিতে সে আত্মহারা!! বাবা বললেন, টাকা যোগাড় হয়েছে। তিন টন রডের দাম দিলে এম.ডি. সাহেব কেস তুলে নেবেন।



হাসিমুখে মণিহারে ফিরলো নাইমুল। সে জামিন পেয়েছে শুনে মণিহারে তার ‘পরিবার’-এর সবাই খুব খুশি; এত দ্রুত নাকি কাউকে জামিন পেতে দেখেননি তাঁরা। এবার তাঁদের জন্যে ভীষণ মায়া লাগছে নাইমুলের। এঁরা প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত; জায়গামতো টাকা ঢালতে পারলে হয়ত নিরীহ লোকগুলো খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতেন আজ। সে অনুধাবন করলো, সত্যিকারের অপরাধীরা বের হবার পন্থাগুলো আগে থেকেই তৈরি রাখে; ধরা খেয়ে জেলের ভেতর পঁচে মরছে পরিস্থিতির শিকার নিরীহলোকগুলো। জেলের ভেতরেও এরা কষ্টে আছে টাকা নেই বলে। এই ক’দিনে সে দেখেছে, রাইটারকে সপ্তাহে ১৫০০ টাকার বেনসন দিলে ভালো বিছানায় ঘুমানো যায় ইলিশফালি ছাড়া, জেলারকে টাকা দিলে সেল-এ থাকা যায় পছন্দের লোকজন নিয়ে; আরো কত কী। নাইমুলের খুব ইচ্ছে হলো জেল থেকে বেরিয়ে একদিন এসে এদের পি.সি. অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা জমা দিয়ে যাব; ওরা যেন ভালো কিছু কিনে খেতে পারে।



বিকেল তিনটা থেকে মাইকিং শুরু হলো; ভবনের প্রত্যেক হলের দেয়ালে একটা ছোট মাইক স্থাপন করা আছে যেকোনো ঘোষণা প্রচারের জন্যে। সেটায় আজকের জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদিদের নাম ঘোষণা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নাইমুলের কাছে চেনা-অচেনা লোকজন আসতে শুরু করেছে, কেউ জানতে চাইছে কীভাবে জামিন পেলো, কেউ চাইছে তার উকিলের নাম, ফোন নাম্বার। কিছু লোক এসেছে সাবানের প্যাকেটে, সিগারেটের প্যাকেটে তার ভাই বা পরিবারের কারো ফোন নাম্বার লিখে নিয়ে; সবার একটাই অনুরোধ, সে যেন তাদের বাড়িতে খবর দেয় যে তারা এখানে খুব কষ্টে আছে; যেন কেউ টাকা নিয়ে আসে, দেখা করে যায়। এদের আকুতি-মিনতিতে নাইমুল আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো, তার কষ্ট হতে থাকলো। নাইমুল কথা দিলো, ওদের দেওয়া সবগুলো নম্বরে ফোন করে ওদের বার্তা পৌঁছে দেবে।



বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মাইকে শোনা গেলো সেই বহুপ্রতীক্ষিত নাম নাইমুল হাসান, সেই সাথে তার প্রিয় বাবার নাম এবং তার অপ্রিয় থানার নাম। সে তৈরিই ছিলো; আকরামের সাথে (কোনো কয়েদিকে একা ছাড়ার নিয়ম নেই এখানে) নাইমুল বেরিয়ে এলো মণিহার থেকে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারলো না সে; ওদেরকে কথা দিলো, আর কিছু না পারুক, আকরামের পি.সি. অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠাবে ওদের জন্যে। এভাবে স্বার্থপরের মতো ওদের ফেলে চলে যেতে খারাপ লাগছে নাইমুলের। মুক্তির নির্ভার নি:সীম আনন্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে ওদের বেদনার ওজন ও আয়তনে।



কয়েক দফা কারাগার অফিসের এ টেবিল ও টেবিল ঘুরে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে অবশেষে মূল গেইটের পকেট-গেইট দিয়ে আরো কয়েকজন কয়েদির সাথে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিলো নাইমুল ।

‘আহ! স্বাধীনতা, তুমি ছিলে না যখন, তখন বুঝেছি কী অমূল্য তুমি।’ মনে মনে বলল নাইমুল। সামনে তাকিয়ে দেখে বাবা, মিতু আর উকিল সাহেব দাঁড়িয়ে। এভাবে কত ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ওঁরা? নাইমুল হিসেব করে বের করতে পারে না। ছুটে গিয়ে সে মিতুকে জড়িয়ে ধরলো; লোকলজ্জা ভুলে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো মিতু।

সম্বিত ফিরে পেয়ে বাবার দিকে তাকালো নাইমুল। মিতুকে ছেড়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। দু’জনেরই কন্ঠ রুদ্ধ হলো কান্নায়। কাটলো কয়েকটি নির্বাক মুহূর্ত।

মুখ খুললেন বাবা, ‘শক্ত হ, নাইম। জীবনে বিপদ আসতেই পারে, এত ভেঙ্গে পড়লে চলে?’

উকিল সাহেব বললেন, ‘বিপদ কেটে গেছে। এবার বাড়ি যান।’

‘কিন্তু তুমি কীভাবে সব সামলালে, বাবা?’

জবাবটা দিলেন উকিল সাহেব, ‘উনি একজনকে ডিস্ট্রিক্ট জাজকে খুঁজে বের করেছেন, যিনি আপনাদের আত্মীয়।’

‘শহীদ খালু?’ নাইমুল বেশ অবাক হলো। অনেক দিন কোন যোগাযোগ নেই তাঁর সাথে।

‘হ্যাঁ। তাঁর কল্যাণে ম্যাজিস্ট্রেট আপনার জামিনাবেদন মঞ্জুর করেছেন। এখনও অবশ্য অনেক কাজ বাকি। দারোয়ানের জামিন হতে আরো সময় লাগবে, সে স্পটে ছিল।’

বাবা বললেন, ‘রডের টাকাটা শোধ করে দেবো এক মাসের মধ্যে। তারপর এম.ডি. সাহেবকে দিয়ে কেস উইথড্র করাবো।’

উকিল সাহেব তাঁর সাথে যোগ করলেন, ‘উনার কাছ থেকে লিখিত নেবেন যে, আপনার বিরুদ্ধে তার আর কোন অভিযোগ নেই। প্রয়োজনে সাক্ষী রাখবেন...।’

উকিল সাহেবের কোন কথাই আজ নাইমুলের কানে ঢুকছে না। সে তাকিয়ে আছে মিতু আর বাবার দিকে। সন্তানের জন্যে কী না করেন একজন বাবা! তাঁর সব সঞ্চয় তিনি শেষ করতে চলেছেন রডের দাম শোধ করতে গিয়ে। একবার ভাবলেন না, তাঁর বয়স হয়েছে, নিজের অসুখ-বিসুখ বা বিপদের জন্যে আর কিছু অবশিষ্ট রাখলেন না তিনি।

বাবার হাত ধরে নাইমুল বলল, ‘আমি কি তোমার মতো এত ভালো বাবা হতে পারব, বাবা?’

বাবা হেসে ফেললেন; তাঁর চোখে অশ্রু, ঠোঁটে হাসি।



৩.

ঠিক সেই সময় সবাইকে চমকে দিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা সাদা গাড়ি। এম.ডি. সাহেবের গাড়ি না? চমকে উঠলো নাইমুল। হ্যাঁ, সে ঠিকই ধরেছে। এম.ডি. সাহেব বেরিয়ে আসছেন গাড়ি থেকে। ‌‘সরি, নাইমুল!’ হাসিমুখে বললেন তিনি, ‘তোমাকে অনেক সাফারিং দিলাম। আমি কাজটা ঠিক করিনি। বলতে পারো, নিজের স্বার্থে ক্ষতির দায়টা তোমার কাঁধে চাপাতে চেয়েছিলাম।’

সবার যেন কথা বন্ধ হয়ে আছে ঘটনার আকস্মিকতায়। বাবা মুখ খুললেন, ‘আপনি এখানে কেন? আর কী বলছেন, ঠিক বুঝছি না আমরা!’

‘বলছি। চলুন, সামনের বেকারিতে বসে কথা বলি।’ সবাইকে প্রায় জোর করে রাস্তার ওপারের দোকানটায় দিয়ে বসলেন এম.ডি. সাহেব। কেক, জুস ইত্যাদি অর্ডার করলেন। মিতু কিছুই মুখে তুললো না। বাকিরা খেলো। খেতে খেতেই কথা শুরু হলো।

‘নাইমুল, আমি আজই কেসটা উইথড্র করব। রড পাওয়া গেছে।’ এম.ডি. সাহেব বললেন।

‘পাওয়া গেছে, স্যার? ’ নাইমুল যেন বিশ্বাস করতে পারছে না কথাটা। বাকিরাও অবাক।

‘হ্যা। কাল রাতে সাইটে নতুন রড এনে আমি গোপনে একটা লোককে পাহারায় বসিয়েছিলাম। আজ ভোররাতে চোরকে হাতে-নাতে ধরা হয়েছে। চোরকে তুমি চেনো।’ রহস্যময় হাসি হাসলেন এম.ডি. সাহেব।

‘কে, স্যার?’

‘সাইদ, যাকে গতমাসে আমি সাইট থেকে বের করে তোমার হাতে সাইটের দায়িত্ব দিয়েছিলাম।’

উকিল সাহেব বললেন, ‘তার মানে নাইমুল নির্দোষ প্রমাণিত।’

‘অবশ্যই!’ জোর দিয়ে বললেন এম.ডি. সাহেব। ‘নাইমুলকে আমি ওর হারানো সম্মান আর চাকরি, দুটোই ফেরত দেব।’

নাইমুল এবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। এই কান্না আনন্দের কান্না। ওর পিঠে হাত বোলাতে লাগলেন বাবা।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে সততার পুরষ্কার পাওয়ার জন্যে পরকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না।





-----------



গল্পের ৩য় অংশটুকু আমার কল্পনা। বাকি অংশ নির্জলা বাস্তব। ছেলেটার আসল নাম নাজমুল। ওর সাথে আমার পরিচয় জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ এক অধ্যায়ে (সে গল্প আমার ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন)।

ভাবতে ভাল লাগে, এই সমাজে সব মানুষ এখনও পঁচে যায়নি। মূল্যবোধের যে অবক্ষয় চারিদিকে, তা পরের প্রজন্মে কমে যাবে, এই আশা নিয়ে বেঁচে আছি...।

- কাজী মিতুল (৩/১১/২০১৩)
১৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×