কতক্ষণ অন্ধকারে ডুবে ছিলাম বলতে পারব না, দরজায় আলতো টোকার শব্দে আবার বাস্তবে ফিরে এলাম। অনুমান করলাম ঘন্টাখানেক আগে ইথারে পাওয়া দুঃসংবাদ কেউ সশরীরে দেয়ার জন্য এসেছে। চরম অবসাদ ও অনিচ্ছার সাথে দরজা খুললা্ম: মিজারিয়া ও মোমোস- এই যমজ ভাই-বোনের সাথে পরিচয় এক বছরের কিছু বেশি সময়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আইনি পরামর্শ আর সহায়তা দেয়াই এদের কাজ। এই যুগে যখন ঐশ্বরিক ত্রানকর্তাদের হাতে বিচার ব্যবস্থার একচেটিয়া অধিকার তখন মিজারিয়া ও মোমোসের মত অপশক্তির দালালদের হাল নিচু স্তরের বীমা কোম্পানির এজেন্টের মত হয়েছে। মোমোসের মুখের অসন্তোষের কালো মেঘ ও মিজারিয়ার চোখের বারমাসি শ্রাবণের অশ্রুধারা পরিস্কার করে বলে দেয় যে তারা কতখানি ব্যর্থ। তাছাড়া এদের উপরওয়ালা একজন বিতর্কিত ব্যাক্তিত্ব, সাধারণ মানুষ এদের ছায়া পারলে এড়িয়ে চলে।
এরা আবার আমার দরজায় হাজির হবে তা আশা করিনি। অবশ্য এদের আগমনে তেমন কিছু এসে যায় না, কারণ গতবারের মত এবারও আমি তাদের খালি হাতেই ফিরিয়ে দিব।
“ভেতরেও কি আসতে দেবে না?” মোমোসের কন্ঠ দিয়ে যেন এক রাশ তিক্ততা ঝড়ে পরল।
“আমার মনে হয় না তোমাদের ভেতরে আসার কোন দরকার আছে”।
“প্লিজ্ কাই, একবার শুধু পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করার সময় দাও…”, মিজারিয়াকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “তোমরা কি চাও আমি জানি, কিন্তু আমি আগ্রহী না,” আমি তাদের মুখের উপর প্রায় দরজা লাগিয়ে দিছিলাম এমন সময় মিজারিয়া বলল, “এটা তো গতবারের মত সাধারণ মৃত্যু না, কাই। এটা তো রীতিমত গণহত্যা”।
মিজারিয়ার কথায় এবার আমাকে মাঝপথে থেমে যেতে হল। গণহত্যা? এই শব্দ বর্তমানে কেউ ব্যবহার করে না, আসলে যাদের বিরুদ্ধে সে এই শব্দ ব্যবহার করছে তাদের ক্ষেত্রে এই শব্দটা ব্যবহার করা রীতিমত পাপ। মিজারিয়া বা মোমোস এই শব্দ ব্যবহার করে পার পেয়ে যেতে পারে কারণ তাদের উপরওয়ালা রাখ-ঢাক না রেখেই তাদের বিরুদ্ধে কাজ করে। আবার এক সময় তারা তাদের সহকর্মীও ছিল। পূর্বের দ্বন্দ্বের কারণে ঘৃণা বা অভিমান যাই থাকুক না কেন এরা একে অপরকে সমঝে চলে। ফেঁসে গেলাম আমরা যাদেরকে কেন্দ্র করে এই দুই পক্ষের মন কষাকষি। বিজয়ী দল পরিস্কার করে জানিয়ে দিল তারা আমাদের রক্ষাকর্তা, অদূর ভবিষ্যতের জন্য সেই ঠেকাটাও তাদের। ফ্রি উইল, যা ঈশ্বর নিজে মানুষকে উপহার দিয়েছেন, মহাযুদ্ধ পরবর্তী যুগে তা মানানসই নয়। এই ফ্রি উইলই মানুষকে শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হতে সাহায্য করেছে। সুতরাং ঈশ্বরের প্রতিনিধিদের কথাতেই ঈশ্বরের দানকে ছুড়ে ফেলে আমরা তাদের হাতে নিজেদের সপে দিয়েছি। সেই সমর্পণের প্রতিদান আমি আজ বিশেষ কিছু হারিয়ে দিলাম।
“এসো”।
উলটো দিকের ফ্ল্যাটের বুড়ো মানুষটার হতবিহবল দৃষ্টি ও করিডোরের সিসি ক্যামের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অবাঞ্চিত অতিথিদের ভেতরে ঢুকতে দিলাম। আমার ঘর-দোর যথেষ্ট পরিস্কার তবুও মোমোস কেন জানি নাক কুচকালো। লিভিং রুমকে ডানে রেখে আমরা স্টাডিতে প্রবেশ করলাম। ফ্ল্যাটের অন্যান্য ঘরের তুলনায় স্টাডিটা পেছনের দিকে ও অন্ধকার। আমি আমার ডেস্কের পিছনে বসে টেবিল ল্যাম্পটা অন করলাম। মিজারিয়া আর মোমোস বসল উলটো দিকের সোফাতে অন্ধকারে। টেবিলের পেছন থেকে আমি তাদের চোখের কালো তারা জ্বলজ্বল করতে দেখলাম।
মোমোস তার ব্যাগ থেকে একটা টালি খাতা বের করে সামনে রাখল, “দেখ, গত কয়েক মাসের তালিকা। এরা সবাই প্রশাসনের গাফিলতির কারণে মারা গেছে। অথচ দোষারোপ করা হয়েছে আমাদের। সেটাতে আমাদের কোন সমস্যা নেই, কিন্তু এই মিথ্যা দোষারোপ তো সমাধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ারই সামিল, তাই না?”
“কাই, যদিও এই কথা বলা আমাদের সাজে না তবুও না বলে পারছি না, তোমাদের নিয়তির কারিগর কি এই শাসন ব্যবস্থা? তাই যদি হয় তাহলে সেটা এত দুর্দশাগ্রস্ত কেন? নাকি ঈশ্বর আগে থেকেই তোমাদের নিয়তি ঠিক করে রেখেছে? আজকের এই পরিস্থিতি কেবল সেই পরিকল্পনার অংশ? তোমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি কেবল তোমাদের দমিয়ে রাখা? দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত রাখা? তোমরা যদি সৃষ্টির সেরা-ই হও তাহলে তোমাদের নিয়তি এমন কেন?”
নিয়তি?
“দুই পাতা ফিলোসফি পড়ে অনেক বড় তাত্ত্বিক হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে”, খুব প্রিয় একজন মানুষের বলা কথাগুলো আবার মনে পড়ল।
“সব কিছু cause and effect এর নিয়মে চলে। আমি যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি না হতাম, or vice versa, তাহলে তোদের সাথে কোনদিনই পরিচয় হত না। এটাই লজিক্যাল, Fate ব্যাপারটা খুবই abstract আর vague”, আমার উত্তরটা খুবই জোরালো ছিল।
“কিন্তু fate এর কনসেপ্টটা খুবই রোমান্টিক না? নিয়তিই আমাদের একসাথে করেছে, তুই যে কন্ডিশনগুলোর কথা বললি সেগুলো ভিন্ন হলেও আমরা বন্ধু হতাম, এটা ভাবতে কি বেশি ভাল লাগেনা?”
হয়ত তার কথাই ঠিক ছিল, মানুষের জীবন নিয়তি-তাড়িত। কিন্তু সেই কথা আমি সেদিনও মেনে নিতে পারিনি, আজ তার মৃত্যুর পর আজ মেনে নেয়া আরো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মিজারিয়ার কথাই ঠিক, এটা পরিস্কার হত্যা। রাস্তা থেকে অ্যাম্বুলেন্সের একটানা আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে, অ্যাম্বুলেন্সের লাল আলোর ছটা রাস্তাকে রক্তাক্ত করে তুলেছে। মিজারিয়া-মোমোসের আরেক ভাই, ক্যারন, যে কিনা দল বদল করেছে, রাস্তা থেকে মৃতদেহগুলো তুলে অ্যাম্বুলেন্সে ভরছে। তার দায়িত্ব শাসকগোষ্ঠীর তৈরি করা জঞ্জাল পরিস্কার করা। তাছাড়া মহামারির মৃতদেহের ব্যবসাও বেশ লাভজনক। বর্তমান শাসনযন্ত্র বিপক্ষ দলের আত্মসমর্পণকৃত কিছু লোককে সেই দায়িত্ব দিয়েছে। লাভ দুই পক্ষ ভাগাভাগি করে নেয়। হয়ত আমার প্রিয় মানুষটিও একই নিয়তি বরণ করেছে। নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণকারীর নিয়তি… আমার নিয়তি হয়ত একই, কিন্তু আজকের পর লড়াই ছাড়া সেই নিয়তি মেনে নিতে আমি নারাজ। মৃত্যুর পরই হোক না কেন প্রিয় মানুষটি যেন জানে নিয়তিই আমাদের পরিচালনা করে না, নিয়তির কারিগর আমরা নিজেরাই। সেটা প্রমাণ করতে যদি অভিশপ্তদের দলে নাম লেখাতে হয় তাহলে তাই সই। মোমোসের দিকে হাত বাড়িয়ে বললাম, “কোথায় সই করতে হবে?”
মিজারিয়া ও মোমোস চলে যাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কখন থেকে এমন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে জানি না। আমার অ্যাপার্টমেন্টের আশে-পাশে কোন গাড়ি-ঘোড়াও দেখা যাচ্ছেনা। নিজের অজান্তেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম- বুড়ো ও সিসি ক্যামেরা তাদের দায়িত্ব ভালভাবেই পালন করেছে। হয়ত অ্যাপার্টমেন্টে বাগও থাকতে পারে। বের হবার পর অ্যাপার্টমেন্টে আর তালা লাগালাম না, ফিরতে পারব কি না কে জানে। নিয়তি কি সেটা ঠিক করে দিবে? আমি বিশ্বাস করি না…