somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

১৯ শে জুলাই বলে কোনো তারিখ নেই

২০ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের যুগান্তরের টঙ্গী প্রতিনিধি ছিলেন মাহবুবুল আলম।
টঙ্গী এলাকার খুবই প্রতিথযশা সাংবাদিক। সবার প্রিয়, শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ। মাথায় টাক, বয়সে মোটামুটি প্রবীণ।
আমি উনাকে পছন্দ করতাম অন্য কারণে। দারুন গদ্য লিখতেন, শিউলি ফুলের মতো স্বচ্ছ প্রতিটি শব্দ। পুরো লেখা পড়ে মনে হতো, এটা লেখা নয়, শিউলি ফুলের মালা।

আমার চোখের সামনে মাহবুব ভাই আউলা হয়ে গেলেন।
উনি ঠিক করলেন হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা করবেন। কে যেন বুদ্ধি দিলো, ধানমন্ডির পার্কে সকালবেলায় হুমায়ূন আহমেদে হাঁটাহাটি করেন।

কেউ মাহবুব ভাইয়ের সাথে 'প্রাকটিক্যাল জোক' করেছিলো কিনা জানি না, সকালবেলায় হুমায়ূন আহমেদ আসলেই পার্কে হাঁটতেন কিনা এমন কোনো তথ্যও আমার জানা নেই। তবু মাহবুব ভাই প্রায় সকালে ধানমন্ডি পার্কে যাওয়া শুরু করলেন। হুমায়ূন আহমেদের সাথে তার দেখা হলো না। দেখা হয়ে গেল আরেক সুপার স্টারের সাথে, জুয়েল আইচ।

জুয়েল আইচকে দেখে মাহবুব এগিয়ে গেলেন। সালাম দিয়ে কিছু বলতে যাবেন, এর আগেই জুয়েল আইচ বলে উঠলেন, কী খবর? কেমন আছেন? অনেকদিন পরে দেখলাম।

মাহবুব পুরো তব্দা লেগে গেলেন। জুয়েল আইচের সাথে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখা, অথচ কত আপন করে নিলেন, যেন কত দিনের চেনা।

এই গল্প করতে করতে মাহবুব আমাকে বলেছিলেন, ভদ্রলোকদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। কি অমায়িক ব্যবহার।

মাহবুব ভাইকে বলতে গিয়েও বললাম না, ''ভদ্রলোক সেলিব্রেটিরা'' এমন প্রায়ই করেন। তাদের ভক্ত, পরিচিত এবং শত্রু সংখ্যা অসীম। সবার চেহারা মনে রাখা মুশকিল। কাজেই এই কান্ড করা ছাড়া তাদের অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না। সেলিব্রেটিদের ব্যবহার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মতো: সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়।

ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হয়ে যাচ্ছে। বলছিলাম, মাহবুব ভাইয়ের কথা, সেখান দেখে আলোচনা পররাষ্ট্রনীতিতে চলে যাচ্ছে। মাহবুব ভাইতে ফিরে আসি।

বিস্তর কাঠখড় পোড়ানোর পর মাহবুব ভাইয়ের সাথে হুমায়ূন আহমেদের দেখা হয়। তারপর থেকে মাহবুব ভাই আর লেখাটেখা পাঠান না। তিনি মোবাইল ব্যবহার করতেন না, তার বাসায় একটি ল্যান্ডফোন ছিল। সেই নম্বরে ফোন দিলে তার পরিবারের কেউ না কেউ ধরে বলে, উনি এখন নুহাশ পল্লীতে।

একদিন টিভিতে মাহবুব ভাইকে দেখে চমকে উঠলাম। উনি হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করছেন। কেউ একজন চটকানা মেরে মাহবুব ভাইকে ফেলে দিচ্ছেন, এমন একটা দৃশ্যে তাকে বিমল আনন্দের সাথে অভিনয় করতে দেখা গেল। মনে হলো, শুটিংটা ধানমন্ডি লেকের পাড়ে করা। লেকের পারটি খুব সুন্দর। ধুর, আলোচনা আবার লেকের পারে চলে যাচ্ছে। মাহবুব ভাইতে ফেরত আসি।

মাহবুব ভাইয়ের সাথে এরও ছয়মাস পরে আমার দেখা হয়। তার দেখা পেতে আমাকে যে পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তার এক দশমাংশ কোনো তরুণীর পেছনে ব্যয় করলে, অঘটন একটা ঘটেই যেতো। বিসিএস পরীক্ষা এবং প্রেম- দুটোতেই ধৈর্য্য লাগে। যাই হোক, আবার আসি মাহবুব ভাইয়ের আলোচনায়। তরুণী প্রসঙ্গ থাকুক।

মাহবুব ভাইকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। ঘোর লাগা চোখ। পাগল পাগল চেহারা। প্রতিটা বাক্যের শুরুতে বলেন, স্যার বলছেন। প্রতিটা বাক্য শেষ হয়, এই হচ্ছে স্যারের অভিমত।

স্যার মানে হুমায়ূন আহমেদ।

মাহবুব ভাইয়ের নিজের আর কোনো কথা নেই। সব কথা স্যারের, হুমায়ূন আহমেদের।

আমি বললাম, মাহবুব ভাই, অনেক দিন কোনো লেখা দেন না, একটা লেখা দেন।
মাহবুব ভাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, স্যারকে নিয়া আমি সিরিজ লিখমু। স্যারকে যেমন দেখেছি।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার আগেই মাহবুব ভাই বললেন, গত সপ্তাহে স্যার বললেন কাউনের চালের খিঁচুরি খাবো। আমি ডেকচি ভরে খিঁচুরি নিয়ে নুহাশ পল্লীতে গেলাম। স্যার তো অবাক।

আমি বললাম, স্যার আপনার কাছে খিঁচুরি খেতে চেয়েছিলেন?

মাহবুব ভাই বললেন, জ্বী, নুহাশ পল্লী থেকে ফিরে এসে নিদ্রা গেছি। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে উনাকে স্বপ্ন দেখলাম। উনি বললেন, মাহবুব আমার কাউনের চালের খিঁচুরি খেতে মন চাচ্ছে। ঘুম থেকেই উঠেই আমি আয়োজন শুরু করলাম। ডেকচি ভরে খিঁচুরি পাক করা হলো। তারপর ট্রাকে করে ... সে এক বিরাট ইতিহাস।

মাহবুব ভাই বলেই যাচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে শুনছি। যে অপার আনন্দ নিয়ে উনি কথা বলছেন, সেই আনন্দ অলৌকিক সৌরভের মতো কিংবা মাদকের মতো আমাকেও অবশ করে দিচ্ছিল।

হুমায়ূন আহমেদের একটা লেখায় আমি পড়েছিলাম, সরকার থেকে যখন তাকে গানম্যান দেয়া হলো, সেই গানম্যানকে পরবর্তীতে শুটিংয়ের ক্যামেরার লেন্সের বাক্স নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। এক জাপানি দল এসেছিলো হুমায়ূন আহমেদের উপর ডকুমেন্টারি বানাতে। তারা এসে দেখে নুহাশ পল্লীর জনৈক বাবুর্চি রান্না করছেন, পায়ে শিকল বাঁধা। বাবুর্চি তাতেই নাকি মহাখুশি, স্যার ভালোবেসে বেঁধে রাখছেন। সেই জাপানি দলও ডকুমেন্টারির কাজ ফেলে নুহাশ পল্লীর পুকুর ঘাট পরিষ্কার করছেন এমন ছবিও দেখেছি আমি।

হুমায়ূন আহমেদ নিছক লেখক ছিলেন নাকি আমাদের সময়ের এক অলৌকিক মানুষ ছিলেন- এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি দিচ্ছি না।

১৯ জুলাই একটা অপরিসীম বেদনার দিন। এই তারিখটির আমাদের কোনো প্রয়োজন ছিল না। একমাত্র জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব ছিল, ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ১৯ জুলাই তারিখটি মুছে দেয়ার। সেটা হলো না, এই দিনেই তো তিনি চলে গিয়ে অনেক সম্ভাবনাকে মাটি করে গেলেন।

আবার প্রসঙ্গ বদল হয়ে গেল। মাহবুব ভাই থেকে হুমায়ূন আহমেদে এসে ঠেকলো বিষয়টা। মাহবুব ভাইয়ের গল্পে ফিরে যাবো, সেই উপায়ও নেই। মাহবুব ভাইয়ের বাকি গল্পেও হুমায়ূন আহমেদ এসে যাবেন।

আমাদের জীবনের বাকি গল্পে হুমায়ূন আহমেদ ফিরে ফিরে আসবেন। এটাই নিয়তি।

আজ থেকে কয়েক বছর পরের একটি ঘটনা।
বাচ্চাদের বাংলার ক্লাস হচ্ছে।
স্যার প্রশ্ন করলেন, হুমায়ূন আহমেদ কবে মারা গেছেন।
এক ছাত্র হাত তুললো। বললো, ১৯ শে জুলাই।
স্যার বললেন, বেঞ্চের উপর কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। লেখকের মৃত্যু নেই।

এই গল্পটাও হুমায়ূন আহমেদের কোনো এক টিভি নাটকের দৃশ্যের। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে এই কথাটি এসেছিলো।

এজন্য আজ ২০ জুলাই আমি এই গল্প বললাম। মোরালটাও গল্পে বলা আছে।

লেখকের মৃত্যু নেই।
নেই তো।


৬টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×