(ক)
ফরহাদ গাড় নীল রঙের পাঞ্জাবী গায়ে টিএসসি’র সামনে অপেক্ষা করছে । সুমি আসবে । আজ তাদের সু-বিশাল প্ল্যান । আজ তারা কি কি করবে তার তালিকা সুমির কাছে আছে । কাল রাতে মোবাইলে তালিকা তৈরি করা হয়েছে । আজ বাস্তবায়ন ।
তালিকার শুরুতে আছে “ দে হাঁটা “ কার্যক্রম । সুমি একটা ম্যাগাজিনে পড়েছে যে- “ একজন মানুষ তার স্বাভাবিক আয়ষ্কালে যে পরিমান হাঁটে তাতে সমগ্র পৃথিবীকে সাড়ে তিনবার ঘুরে আসা সম্ভব “ সেই কথার সূত্র ধরে সুমির ইচ্ছা আজ থেকে যখনই তারা দুজন অনুরাগ ( তারা ডেটকে অনুরাগ বলে ) করতে বের হবে , তারা হাঁটবে । স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে হাঁটবে । এতে করে তারা স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ বেশী হেঁটে সমগ্র পৃথিবী সাড়ে তিনবারের জায়গায় ৭ বার ঘুরে আসবে । কারণ ৭ সৌভাগ্যের সংখ্যা । এই “ দে হাঁটা “ কার্যক্রমের মধ্যবর্তী সময়ে তারা রাস্তার পাশে যে কোন আল ছালা দিয়া হোটেলে ভাত খাবে । তারপর আবার শুরু হবে কার্যক্রম । হাঁটতে হাঁটতে একসময় সন্ধ্যা গড়াবে । সন্ধ্যায় আসমান উতলা করে অকূল বৃষ্টি নামবে । বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফরহাদ সুমির খোঁপায় বেলি ফুল গুঁজে দিবে । এরপর তারা চোখে চোখে রেখে কিছুক্ষন দৃষ্টি বিনিময় শেষে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আবার হাঁটবে । এই হচ্ছে আজকের প্ল্যান ।
প্ল্যানদাত্রী সুমির বিশ্বাস আজ সন্ধ্যায় বৃষ্টি হবে । রাতে জোর দিয়ে সে ফরহাদকে তাই বুঝিয়েছে । সুমির বেশ কিছু পাগলামির মধ্যে এইটা একটা । সে যা বিশ্বাস করে সেটাই করতে চায় । ফরহাদ মেনে নেয় । কারণ তার মেনে নিতে ভালো লাগে । তবে আজ ফরহাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে । সকালে উঠে সে আজকের খবরের কাগজ দেখেছে । আজ বৃষ্টিপাতের কোন সম্ভাবনাই নেই । শুধু আজ না আবহাওয়া অফিস বলছে আগামী তিন দিন আকাশ থাকবে সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত , ঝকঝকে পরিস্কার ! সকালে সে সুমিকে ফোনে সংবাদটি পড়ে শুনিয়েছে । সুমি পাত্তা না দিয়ে তাকে গাড় নীল রঙের পাঞ্জাবী পড়ে আসতে বলে লাইন কেটে দিয়েছে । ফরহাদের সন্দেহ থাকলেও সুমির দৃঢ় বিশ্বাস আজ সন্ধ্যায় অবশ্যই বৃষ্টি হবে । কারন আজ তাদের অনুরাগের দুই বছর পূর্তি হবে । দুই বছর আগে এমনইএক তুমুল বৃষ্টি ঝরা দিনে সুমি ফরহাদকে প্রপোজ করে এবং ফরহাদ চশমা খুলে চরম নার্ভাস ভঙ্গিতে তাতে সম্মতি জানায় । আবহাওয়া অফিস আবহাওয়ার খবর নিয়ন্ত্রন করলেও আজ সন্ধ্যার বৃষ্টি তারা কোনমতেই আটকাতে পারবে না । এতোসব কথার দরকার নেই তারচেয়ে বরং তাদের প্রপোজের ঘটনাটা বলা যাক ।
ঘটনাটা বেশ মজার । ফরহাদ আর সুমি দুজনই DU বোটানি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট । মুখচোরা ফরহাদ ভার্সিটি লাইফের প্রথমদিন সুমিকে দেখেই ভালোবেসে ফেলে । লাভ এট ফাস্ট কয়েক সেকেন্ড । কিন্তু ফরহাদ সে কথা কক্ষনো বলতে পারেনি । শুধু তাই না সুমির সামনে দাঁড়াতেও সে ভয়ানক লজ্জা পেত । দূর থেকে সুমিকে দেখতো । ক্লাসে সুমির থেকে কয়েক বেঞ্চ পিছনে আড়াআড়ি বসতো যেন সারাক্ষন তাকে ফলো করা যায় । অপরদিকে সুমি গোবেচারা ফরহাদকে পাত্তা দিত না । ফরহাদ না । শুধু মূলত কোন ছেলেকেই তেমন পাত্তা দিতে চাইতো না । একটু বেশী মাত্রায় সুন্দরী হওয়াতে তার আশেপাশে সবসময় ভিড় লেগে থাকতো । এমনকি বড়ভাইদের নজরেও সে ছিল প্রথম সারিতে । তাই ফরহাদ জানতো সুমির ব্যাপারে তার “ নো চান্স “ কপাল । ফরহাদের ধারণা ফরহাদ নামে ক্লাসে যে একটা লম্বা মতো শুকনা ছেলে সুমির সাথে গত পাঁচ মাস যাবত পড়ছে সুমি সেটা জানেই না ।
দুবছর আগে এক তুলুম বৃষ্টি দিনে ফরহাদ যাত্রী ছাউনিতে । বাসের জন্য অপেক্ষা করছে । সে দেখতে পায় লাল ছাতা হাতে সুমি সোজা তার দিকে হেঁটে আসচ্ছে । ফরহাদ আশেপাশে তাকালো । সে ছাড়া ডান পাশের কোনায় এক মুচি বসে আছে । কাজ নেই । মুচি বেটা ঘুমোচ্ছে । ফরহাদ আবার তাকালো । হুম সুমি ঠিক এইদিকেই আসচ্ছে । সুমির কি জুতো ছিড়ে গেছে ? জুতা ছিঁড়ে গেলে সে এতো হনহনিইয়ে হাটচ্ছে কিভাবে ! ফরহাদের ভাবনার জগত আরও শাখা ছড়াবার আগেই সুমি ফরহাদের সামনে দাড়িয়ে বলল – “ তুমি যদি চাও আমার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে পারো । আসবে ? “ হতবিহবল ফরহাদ কাঁপা কাঁপা হাতে চশমা খুলে গ্লাস মুছলো । ভেজা শার্টে অনর্থক চশামা মোছার চেষ্টা করে গ্লাস আরও ঘোলা বানালো । তারপর চোখে ঘোলা চশমা এঁটে সুমির হাত ধরে নেমে এলো রাস্তায় পড়লো । বৃষ্টিতে । সেইযে সুমির হাত ধরেছিল আজ দু বছর সেই হাত তার হাতের তালুতে আরও গভীরভাবে বসে রয়েছে ।
( খ )
সুমি আসচ্ছে । সে আজ সাদা শাড়ি পড়েছে । চুল খোঁপা করা , কানে গোঁজা একটি লাল ফুল। ফরহাদ দাদীর কাছে হুর পরীদের অনেক গল্প শুনেছে । সুমিকে স্বর্গের পরীদের চেয়ে সুন্দরী লাগছে । সাদা শাড়িতে সুমিকে ভালো মানায় । আচ্ছা সুমিকে কোন রঙের শাড়িতে মানায় না ? এই পর্যন্ত সে লাল , সাদা , কালো , মেজেন্ডা রঙের শাড়িতে সুমিকে দেখেছে । সবগুলোতেই তাকে স্বর্গের পরীদের চেয়ে সুন্দরী লেগেছে ।
- “ এই আমাকে কেমন লাগছে , অনেক কষ্ট করে সেজেছি ! প্রশংসা করতে হবে “ সুমির প্রথম কথা ।
- কিছু কিছু সুন্দর বর্ণনা করা যায় না , শুধু উপলন্ধি করতে হয় , তোমারটা ঠিক তেমন । ফরহাদের স্বীকারোক্তি । সরল স্বীকারোক্তি ।
-এই সব ধানাই পানাই শুনবো না । ডাইরেক্ট কিছু বলো ।
সুমি বরাবরের মতোই নাছোড়বান্দা । ফরহাদ হাসচ্ছে ।
– “তোমার খোঁপায় গোঁজা ফুল কিন্তু শুকিয়ে গেছে “
– আরে এইটা তো সন্ধ্যামালতি !
সন্ধ্যায় ফুটে , ভোরের আগেই কুঁকড়ে যায় । কাল রাতে জোগাড় করে রেখেছিলাম । সকালে কুঁকড়ে গেছে ! এখন কোঁকড়া ফুল খোঁপায় দিয়েই এসেছি । সন্ধ্যা পর্যন্ত সন্ধ্যামালতি আমার খোঁপায় থাকবে ।
- এইটা সন্ধ্যামালতি ? আরে !
বোটানির স্টুডেন্ট হয়ে সন্ধ্যামালতি চিনতে পারছ না !! মরণ । সন্ধ্যামালতির বৈজ্ঞানিক নাম বোলো তাড়াতাড়ি ? সুমি হাসচ্ছে । -- “Mirabilis jalapa“ পাশ ! এইবার চলেন কার্যক্রম শুরু করি । দেরী হয়ে যাচ্ছে । চলো চলো । সুমি আর ফরহাদ আস্তে আস্তে হাটা শুরু করলো । হাঁটতে হাটতেই সুমি অনর্গল মাথা দুলিয়ে , হাত নেড়ে কথা বলে যাচ্ছে । ফরহাদ শুনছে । সুমির কাছে আসলে সে কোন কথাই বলতে পারে না । শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখে , তার কথা শুনে । তারা অনেকক্ষণ হাঁটল , দুপুরের পর তেজগাঁও এর দক্ষিণ দিকে একটা “ আল ছালা “ হোটেল পেয়ে সেখানে ভাত খেল । রিক্সার ড্রাইভার ভাইসব অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেও সুমি এইসব কক্ষনো ভ্রূক্ষেপ করলো না । সে দিব্যি শাড়ি পড়ে রাস্তার পাশে টেবিলে বসে কাঁচামরিচ কামড়েভাত খেয়ে যাচ্ছে । খাওয়া শেষে দুজনে মুখে দু খিলি পান দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো । ফরহাদ সুমিকে বলল
– আচ্ছা যদি আজ বৃষ্টি না হয় তবে ?
“ সুমি পানের পিক ফেলে বলে – “ আজ বৃষ্টি হবেই , আমি সাদা শাড়ি কি এমনেই পড়েছি । বৃষ্টিতে মেয়েদের সাদা শাড়ি পড়তে হয় ।
ফরহাদ নাছোড়বান্দা হয়ে বলল -- “ ধর , আজ হল না । তখন ?
সুমি রেগে গিয়ে বলল – “ তখন আবার কি ! তুমি কৃত্রিম বৃষ্টির ব্যবস্থা করবে ।
ফরহাদ অবাক -– মানে ?
-– মানে হচ্ছে কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টি তৈরি করা যায় । যদি আজ বৃষ্টি না হয় । তুমি বৃষ্টি বানাবে । বৃষ্টি বানায় কিভাবে ? কারেন্ট এফেয়ারসে পড়েছি বৃষ্টি বানানো যায় । মার্কিন বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট শায়েফার নামক এক লোক এই পদ্ধতি আবিস্কার করেছেন । আর চীনে নাকি এইভাবে এখন হরহামেশা বৃষ্টি নামানো হচ্ছে । প্রক্রিয়াটাও খুব সহজ । প্রথমে দ্রুতগতির বড় পাখা দিয়ে কোনো জলক্ষেত্রের পানিকে বাষ্পীভূত করা লাগবে । হালকা সেই বাষ্প উপরে উঠে গিয়ে বাতাসের ধূলিকণার সাথে মিলেমিশে জমাট বাঁধবে । তবে এই জমাট বাঁধানোর ব্যাপারটিও কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সিলভার আয়োডাইডের কণা ছুঁড়ে দিয়ে । যাই হোক , একসময় জমাট বাঁধা মেঘ ভারী আঁকার ধারণ করে বৃষ্টি হয়ে আমাদের গায়ে ঝড়ে পড়বে । ব্যাস , মামলা শেষ । “ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে সুমি গা দুলিয়ে হাসতে শুরু করলো । ফরহাদ অপলক চোখে সুমির হাঁসি দেখে । তার সত্যি সত্যি বৃষ্টি বানাতে ইচ্ছা করছে ।
(গ)
সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসচ্ছে । সুমি বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে । বৃষ্টির দেখা নেই । তার মন অসম্ভব খারাপ । বৃষ্টি না আসলেও সুমির চোখে যেকোন মুহূর্তে জল এসে যাবে । ফরহাদ চুপ করে বসে আছে । সে একবার সুমি , আরেকবার আকাশ দেখছে । একটু বৃষ্টি পড়ুক । একটু খানি । প্লীজ একটু বৃষ্টি হোক না আজ ।
বৃষ্টি শুনবে না তাদের কথা ? এক সরল বিশ্বাসী ছেলেমেয়ের কথা ?
চারিদিকে আধার নেমে আসচ্ছে হু হু করে । সন্ধ্যার কর্ম বাস্ততায় সবাই বাড়ির উদ্দেশে ছুটছে । শুধু তারা ফুটপাতে ঠায় বসে বৃষ্টির অপেক্ষায় ।
আকাশ জুড়ে গর্জন । ফরহাদ আকাশের দিকে তাকালো । লালচে আকাশ কালো হচ্ছে । মেঘ ধমকিয়ে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে । সুমি ফরহাদের হাত মুঠোতে শক্ত করে ধরে রাখলো ।
এক ফোটা দুই ফোটা করে পানি ঝরছে । সুমির বৃষ্টি অকৃতজ্ঞ হয়নি । বৃষ্টি অকৃতজ্ঞ হয় না । ফরহাদ দৌড়ে গেল বেলি ফুল কিনে আনতে । তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে । ফরহাদ যত্ন করে সুমির খোঁপায় বেলিফুল পড়িয়ে দিল । বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আজ অনেক বড় । তারা একে অপরের হাতে হাত রেখে আবার রাস্তায় নামলো ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:১৮