বড়দিদি আজ সকালে আমাকে ভয়ানকভাবে বকেছে । আমি নাকি অলস, কুঁড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি । কথাটা শুনে খুব মন খারাপ করেছিলাম । সারাটা দিন ওর সাথে কথা বলিনি । চুপচাপ সময় কাটিয়ে দিয়েছি । আর ঠিক খাবার সময়টাতে ছাদে উঠে বসে আছি । হঠাৎ করে খুব কান্না পেলো আমার । হাঁটু দুটোর মধ্যে মুখ গুঁজে জামা ভিজিয়ে ফেললাম । কতক্ষন কাঁদলাম জানিনা । নিজেকে খুব দুঃখী মনে হচ্ছিল । হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝলাম কেউ আসছে । তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছলাম । অবন্তী । অবন্তী আমার ছোট বোন । অবন্তী হবার সময় আমার মা মারা যান । মা মারা যাওয়ার সময় আমি ছিলাম দেড় বছরের । মায়ের কথা কথা আমার মনেই পড়েনা । অস্পষ্ট একটা কল্পনা এ্যালবামের ছবির সাথে মিলে মিশে আমার মনে একটা অন্যরকম মায়ের স্মৃতি তৈরী করে । আমি জানিনা আমার মা দেখতে কেমন ছিলেন, কিভাবে কথা বলতেন আর কিভাবেই বা আমাকে আদর করতেন । এ্যালবামে মায়ের সাথে আমার একটাই ছবি আছে । ছবিতে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আছি । মা যদিও আমাকে বেশীদিন ভালোবাসার সুযোগ পাননি, তার দায়িত্ব নেন বড়দিদি । আমার বাবা চিরদিনই উন্নাসিক প্রকৃতির মানুষ । তাঁকে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনদিনই সক্রিয় দেখিনি । স্বভাবতঃই মা মারা যাবার পর তিনি তার কর্তব্য সম্পর্কে একেবারেই নীরব হয়ে গেলেন । তিনি থাকেন তাঁর নিজের খেয়ালখুশী মত, বাড়ীতে আসেন নিজের ইচ্ছেমতো, যখন তখন ।
অবন্তী ছাদে এসে আমাকে দেখে কতক্ষন তাকিয়ে রইলো, তারপর বললো,
“বাবা এসেছে, তোকে ডাকছে ।”
আমি ওর কথাটা শুনে খুব অবাক হলাম । তবুও বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেলাম নীচে । বৈঠকখানায় গিয়ে দেখলাম ময়লা একটা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে বাবা বসে আছেন । বাবা আমাকে দেখে বললেন,
“এখানে বস, শ্রাবন্তী ।”
আমি একটা টুল নিয়ে এসে বাবার পাশে বসে পড়লাম । বাবা শুরু করলেন,
“শুনলাম তুমি নাকি আজকাল কারো কথা শুনছনা আর পড়াশোনাও কম করছ । কথাটা কি ঠিক ?”
আমি মৌনতা অবলম্বন করলাম । বুঝলাম বাবা ভয়ংকর কিছু বলার জন্যেই এখানে এসেছেন । বাবা বলতেই থাকলেন,
“তোমাকে আমি কিছু বলছিনা । আর কিই বা বলবো বলো । তবে আমি জয়ন্তীর সাথে কথা বলে ঠিক করলাম যে তোমাকে হোস্টেলে দেওয়াটাই ঠিক হবে । তোমার কি এই সম্পর্কে কিছু বলার আছে ?”
আমি প্রতুত্ত্যরে কিছুই বললাম না । বাবা বুঝে নিলেন আমার বলার কিছুই নেই । তিনি সব ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন । ১৪ই মে আমার যাওয়া ঠিকঠাক হলো । রাতে খাবার খেয়ে অনেকক্ষন ধরে ব্রাশ করলাম । শুতে গিয়ে দেখি আমার ঘরটা সুন্দর করে গোছানো । আমি অনেক অবাক চোখে কতক্ষন তাকিয়ে থেকে তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লাম । হঠাৎ করেই একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম । হাতটা অনেকক্ষন ধরে আমার বাহুর উপর স্থির হয়ে রইল । বুঝতে বাকি রইল না এই “ঠান্ডা হাতের” অধিকারীনী কে ? আমার গালদুটো অভিমানের জলে ভিজে গেল । বড়দিদি আমার মুখটা তার মুখের দিকে ফেরালেন । আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না । হঠাৎ করে ডুকরে কেঁদে উঠে আমি বড়দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
“তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা, কো-থ-থা-ও না । ”
বড়দিদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“পাগল কোথাকার, কে বলল তোকে যেতে হবে ? আমি তোকে কোথাও যেতে দিলে তো । তুই মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া কর, তোকে কোথাও যেতে হবেনা, আমি বাবাকে বুঝিয়ে বলব । ”
আমি অবিশ্বাস্য চোখে বড়দিদিকে আর একবার জড়িয়ে ধরতে ধরতে ভাবলাম, ও নিশ্চয়ই আগের জন্মে আমার মা ছিল ।