সিয়াম প্রচুর কথা বলে । এরকম প্রচুর কথা বলা মানুষ কুসুম পৃথিবীতে আরেকজনকেই শুধু দেখেছে । সামি । লেকচার ক্লাসে এই কথা বলার কারণে স্যারদের চকের ঢিল খেয়েছে বহুবার । শিক্ষা হয়নি । কথা বলা বেড়েছে বরং । কিন্তু ছাত্র হিসাবে সে ছিল অসাধারণ । কেমিস্ট্রির মোল্লা স্যার তো একবার এই কথা বলার কারণেই রেগে গিয়ে ওকে ডায়াসে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, “ক্লাসটা তাহলে তুই-ই নে, কেমন ?” ক্লাসসুদ্ধু ছেলেমেয়ে হেসেই গড়াগড়ি । সামি মোটেই ভড়কে গেল না । সেদিনের টপিক ছিল ‘ক্লোরোফরম’ । সামি দারুণ আত্মবিশ্বাসে এবং অনেকটা চাপার জোরে মোল্লা স্যারের চেয়েও ইন্টারেস্টিংভাবে ক্লাসটা শেষ করল । তুমুল হর্ষধ্ধনি এবং করতালিতে ক্লাস শেষ করে সবাই যখন বের হয়ে আসছিল, কুসুম উপলব্ধি করলো সে সামির প্রেমে পড়ে গেছে ।
দুপুর এখন মাথার উপরে । ছাতাটা আনা হয়নি । রোদের তীব্রতা বাহির ছাপিয়ে কখন শরীরের ভিতরেও প্রবেশ করেছে বোঝেনি কুসুম । ৫ টার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে । রাহেলা হয়তো এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে । ওকে না জাগালে ঘুমিয়েই থাকবে ।
মিনু জেগেই ছিলেন । কুসুমকে দেখে উঠে বসলেন ।
“মা আইসস, এত দেরি করলি ? রাহেলারে জাগা, ঘুমাইতাসে ক্যামনে দেখ ?”
কুসুম কিছু না বলে হাসল । রাহেলার মায়াময় মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ । কেন যেন ঘুমটা ভাঙ্গাতে ইচ্ছা করলো না ।
“থাক না আম্মা, ঘুমাক ।”
“কি কস, ভাত খাইবো না ? আমার কথা তো কিছু শুনে না । তুই না কইলে ঘুমাইয়াই থাকবো ।”
“জাগাইতে মায়া লাগে, আম্মা ।
কথাটা বলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল কুসুম । কুসুমের গলার আওয়াজ পেয়েই মনে হয় রাহেলা একটু একটু চোখ খোলে ।
“আমার আঙ্গুর এনেছ আপা ?”
“আনব রে, আগে হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসি । তুই উঠে মুখটা ধুয়ে নে, আমি ভাত আনছি ।”
বৃহস্পতিবার । প্রচণ্ড ভিড় । হাসপাতালে গিজগিজ করছে রোগী । এরই মধ্যে কোনোমতে ডাঃ হাসিবের রুমে ঢুকল কুসুম । চল্লিশ পেরোনোর পরেও হাসিবকে দেখে বছর ত্রিশের যুবক বলে ভুল হয় । কুসুমকে দেখে এগিয়ে এলো হাসিব ।
“রিপোর্ট এনেছ ?”
“হুম ।”
রিপোর্ট হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইল হাসিব । কুসুমের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমা হচ্ছে । একেকটা সেকেন্ড যেন ঘণ্টা হয়ে কাঁপাচ্ছে । হঠাৎ তার মনে পড়ল রাহেলাকে খাওয়াতে গিয়ে সে আজকে দুপুরে ভাত খেতে ভুলে গেছে ।
“কুসুম তুমি কিছু আন্দাজ করতে পারছ রিপোর্টটা ?”
হাসিব ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল ।
“তুমি কি এখন বেরোবে ?” কুসুম উঠে দাঁড়াল ।
“হুম তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাব ।”
“হাসিব, আমি ডাক্তার নই । তবু আমি মনে হয় বুঝেছি ব্যাপারটা ।”
হাসিব ঠোঁট কামড়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “দুটো কিডনিই শেষ প্রায় ।”
অনেকদিন থেকে আন্দাজ করতে থাকা বিষয়টা এতটা সত্যি চেহারা নিয়ে এসে হঠাৎ করে হাজির হবে বোঝেনি কুসুম । চমকাবার সুযোগও যেন দিল না । ঘন কুয়াশার মাঝে হাতড়ে চলা নৌকার মত যেন সে হারিয়ে গেছে ।
হাসিব কুসুমের মাথায় হাত রাখল ।
“কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থাতো আছেই । এতটা ভেঙ্গে পড়ছ কেন ?”
বাইরে অন্ধকার ততক্ষণে জাঁকিয়ে বসেছে । শীতকালের সন্ধ্যা অনেক তাড়াতাড়ি চলে আসে। কুসুম ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ।
“আমি এখন যাব, হাসিব।”
“আমি তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে যাব ।” হাসিব মানিব্যাগ পকেটে ভরতে ভরতে বলল ।
“লাগবে না, আমি একাই যেতে পারব ।”
“জীবনের পথে একা হাঁটবে বলে আমার হাতটা ধরলে না । এটুকু পথ অন্তত তোমার সাথে হাঁটার অনুমতি দাও ।”
কুসুম কিছুই বলল না । টেবিলের উপর হাসিবের হাস্যোজল স্ত্রী আর মেয়ের ছবি । ওটার দিকে এক পলক তাকিয়ে সে বেড়িয়ে গেল হাসিবের রুম থেকে ।
(চলবে)