“ধ্বংস হয়ে যাবি বুঝলি, আল্লাহ্র গজব পড়বে তোদের উপর। জীবনেও শান্তি পাবিনা ।"
মারাত্মক একটা সকাল অলরেডি শুরু হয়ে গেছে, কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু যার পিলে চমকানো, কলিজা নিংড়ানো বাণীতে মহল্লার ঘুম ভাঙল তিনি বানী নিঃসৃত করে তৎক্ষণাৎ ঘুমের রাজ্যে চলে গেছেন। এই “তিনি”টি আর কেউ নন, পাড়ার মুখে অবস্থিত একটি বাড়ির স্থানীয় বাসিন্দা সদ্য প্রয়াত কাশেম সাহেবের সদ্য বিধবা স্ত্রী, পলকা বানু । পলকা বানু ছোটবেলা থেকে বড়বেলা, কোন বেলাতেই নামকরণের সার্থকতা দেখাতে পারেননি। মায়ের মুখে শুনেছিলাম শৈশব থেকেই উনি কোন গলিতে ঢুকলে সেখানকার হাওয়া বাতাস নাকি সাময়িকভাবে আটকে যেত। “রেডিমেড জামা কাপড়” কথাটা এইজন্মে উনার নিজের প্রয়োজনে উচ্চারণ করার দরকার পড়েনি। পলকা বানু তথাপি স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। উনার প্রাতঃ এবং সান্ধ্যভ্রমন মহল্লাবাসীদের ছোটখাটো হস্তি দর্শনের আমোদ যুগিয়েছে বরাবরই।
সে যাক, যা বলছিলাম। কাশেম সাহেব মারা যাওয়ার ৩ মাস পার হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎই একদিন সকাল ৫টায় বিকট আওয়াজে সবার ঘুম ভাঙল। ভূমিকম্প – টম্প হল কিনা এই গবেষণায় সবাই যখন ব্যস্ত, তখনই বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেল যে, পলকা বানু ঘুমের মধ্যে খাট থেকে ভূপাতিত হয়েছেন। কাশেম সাহেব মারা যাওয়ার পর পলকা বানু ভূতের ভয়ে ভীত থাকতেন বিধায় কাজের মেয়ে মতিয়া তার খাটের পাশে মাদুর পেতে ঘুমাত। সেইদিন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠে যাওয়ায় আচমকা পাহারধস থেকে সে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছিল। এজন্য ময়লাবাবার মাজারে গিয়ে সে ১০ টাকা দান করে শুকরিয়া আদায় করেও এসেছে। মহল্লার চায়ের দোকান এবং হোটেলে গরম গরম পরোটা, সিঙ্গারার সাথে এই গরম খবরটাও সবাই ফ্রি খেয়েছে সেদিন। জল্পনা – কল্পনার ডালপালা মেলতে মেলতে মূল ঘটনাই জিলিপির আড়াই প্যাঁচে আটকে যায় যায় অবস্থা। সবাই “ধুপুস” গল্পের মতো শুধু শব্দই শুনেছে। এর নেপথ্য ঘটনা আসলে কেউই জানেনা।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পলকা বানুর কলিজা নিংড়ানো, হাড় কাঁপানো অবিমিশ্র অমৃতবানী প্রতিদিন ঐ নির্দিষ্ট সময়ে অব্যাহত রইল। কিন্তু ব্যাপারটা ক্রমাগত মহল্লার দৈনন্দিন মানচিত্র কিভাবে আমূল বদলে দিলো দু’একটা উদাহরন দিলেই পাঠক সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।
মহল্লাবাসীর ঘুম ভাঙ্গাভাঙ্গি আগে ফজরের আজাননির্ভর ছিল। এই ঘটনার পর দেখা গেল সবার অজান্তেই সেটা আধঘণ্টা এগিয়ে গেছে। কেননা এমন বিকট আওয়াজের কাছে অ্যালার্ম তো নস্যি। তাই অফিস এবং স্কুলগামী লোকজন ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয়া বেমালুম ভুলেই গেল। বেয়াদপ বাচ্চাকাচ্চাগুলো যারা ভাত খেতে, ঘুমাতে, গোসল করতে বেসম্ভব ঝামেলা করত, মায়েরা তাদেরকে এই পিলে চমকানো আওয়াজের ভয় দেখিয়ে ক্রমান্বয়ে সরলরেখার মত সোজা করে ফেলল।
উৎকট, বিকট এই আওয়াজের নামটা শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল, “পলকা বানুর সাইরেন”। আর কাশেম সাহেবের বাড়ির সেই চিপাগলি হয়ে গেল, “সাইরেন গলি”।
এলাকার পাতিচোর জব্বার মিয়া, যার কাজই হচ্ছে জানালা খুলে মানিব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, স্কুলের ব্যাগ, কাপড়চোপড় ইত্যাদি নিখুঁতভাবে চুরি করা, চুরিচামারির সুবাদে প্রায়ই এলাকা ছাড়া থাকে। যেহেতু দিনের বেলায় তার কোন কাজই নেই, অতএব এই সময়টা সে মোটামুটি ঘুমের পিছনেই ব্যয় করে। জব্বার চোরা একবার এলাকা ছাড়া হলে ছয়সাত মাস মহল্লার লোকজন নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। আমার জন্মের পর থেকে দেখে এসেছি জব্বারের অনুপস্থিতিতে অন্য কোন চোর তার জায়গায় প্রক্সি দিতে পারেনি। বাপের ব্যাটা বলতে হবে। এমনকি তার প্রেস্টিজ জ্ঞানও সাংঘাতিক। চোর হয়েছে তো কি হয়েছে ? মান – সম্মান থাকতে নেই বুঝি ? একটা ঘটনা বললেই সেটা পরিষ্কার বোঝা যাবে।
একবার জব্বার রেইন পাইপ বেয়ে অনেক কষ্ট করে চারতলায় চুরি করতে উঠেছিল। এর চাইতেও দ্বিগুণ কষ্ট করে সে জানালার কপাট খুলে ফেলে বাঁশের কঞ্চি টাইপ কিছু একটা দিয়ে দূরে থাকা জিনিসপত্র টেনে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু এত কষ্ট করেও শেষ রক্ষা হল না। আলনা থেকে ঝুলানো ভ্যানিটি ব্যাগ আনতে গিয়ে বাঁশের কঞ্চি ভেঙ্গে একেবারে পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে অর্থাৎ গৃহকর্তার ঘুমন্ত বডির উপরেই পড়ল। জব্বার সাথে সাথে জিভে রামকামড় দিল। তার ২০ বছরের পেশাগত জীবনে এমন ফাউল কখনো হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবেই গৃহকর্তা হালকার উপর নড়াচড়া করেই ফের ঘুমিয়ে গেলেন। জব্বারও ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল। কিন্তু হলে কি হবে, রাতটা আসলেই জব্বারের ছিলনা। ঠিক সেই মুহূর্তে বেরসিকের মতো বেজে উঠল, “পলকা বানুর সাইরেন”। আর যায় কোথায় ? গৃহকর্তাসহ মহল্লাবাসী জেগে উঠল রোজকার স্টাইলে। গৃহকর্ত্রী চোখ মেলে জানালার পাশে জব্বারের ছায়াসম কৃষ্ণমূর্তি দেখে তো রীতিমত মরাকান্না জুড়ে দিল, “ওরে মা রে চোর, চোর। চোর আমার সবকিছু নিয়ে গেল রে”। বেচারা জব্বার আর কি করে। সেই রাতের রোজগার আর মান-সম্মান সবই গেল আর কি। কৃষ্ণ কালো মুখটা ততোধিক কালো করে নেমে যেতে যেতে সে তখন ডায়ালগ দিল, “চইল্লাই তো যাইতেছি, থাক আর চিল্লাইয়েন না”।
জব্বার চোরা অবশেষে যেতে যেতে প্রতিজ্ঞা করলো, সে যদি তার বাপ মায়ের কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান না হয়ে থাকে, তাহলে শহরে গিয়ে বরং ইট-ভাঙ্গার কাজ করবে তবুও এই জীবনে চুরির পেশায় কামাই করা ভাত মুখে তুলবে না।
বিষ্ণু অত্র এলাকায় সম্মানিত আদুভাইদের একজন। পড়াশোনা এখনো মাধ্যমিকের দরজায় হোঁচট খেলেও বাজনার হাত খুব ভালো। প্রতিবছর দুর্গাপুজোতে ঢাক বাজাতে বিষ্ণুকে লাগবেই। এছাড়া গানের গলাও মোটামুটি ভালো হওয়ায় সারাবছর ভজন কীর্তন অনুষ্ঠানগুলোতেও ওকে সবাই ডাকাডাকি করে। কামাই রোজগার ভালো হওয়ায় পড়াশোনায় বেজায় ঢিলে দিতে দিতে একসময় সে যে কখন আদুভাই হয়ে গেছে সে নিজেই টের পায়নি। অখিল মাষ্টার সেদিন পথের মাঝে বিষ্ণুকে পেয়ে তাই হেঁড়ে গলায় ডাকলেন,
“কে বিষ্ণু নাকি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, মাস্টারমশাই ।“
“বলি স্কুলের রাস্তাটা তো ভুলেই গেছ, শেষ কবে গিয়েছ মনে করতে পারো কি?”
বিষ্ণু কথা খুঁজে না পেয়ে অগত্যা মাথা চুলকাতে লাগল।
“থাক থাক বাবা, মাথাটাকে চুলকে ঘা বানিয়ে কাজ নেই। তার চে’ বরং লক্ষ্মণের দিকে একটু নজর দাও। সামনে ওর মাধ্যমিক পরীক্ষা। নিজে তো স্কুলের গণ্ডিটুকু পেরোতে পারলে না, ওর একটু যত্ন-টত্ন নিও যাতে বংশে কেউ মাধ্যমিক পেরিয়েছে এই গর্বটা লোকের কাছে করতে পারো ।“
কথাটা শেষ করেই অখিল মাষ্টার পান চিবুতে চিবুতে ছাতা মাথায় হেলে-দুলে স্কুলের দিকে রওয়ানা হলেন। বিষ্ণু কি আর করবে। ঠাঠা রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িমুখো হল।
রাত্তিরে এক পেগ গেলাটা বিষ্ণুর বহুদিনের অভ্যাস। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তার এসব বদভ্যাস নিয়ে কেউ ঘাটায় নি, সেও ধার ধারেনি। লক্ষ্মণ লক্ষ্মী ছেলে, মদ-সিগারেটের পথ মোটেই মাড়ায়নি। শুরু থেকে লেখাপড়া নিয়েই থেকেছে। বিষ্ণু মদ খেয়ে মাতাল না হলেও পরেরদিন অনেক বেলা অব্দি ঘুমোয়। কিন্তু সেদিন আচমকা ভোর রাতে “পলকা বানুর সাইরেন” শুনে ধড়মড় করে জেগে উঠল। এমন বিকট শব্দে ঘুম ভাঙ্গার পর এপাশ ওপাশ করে নিজেকে ঘুম আনাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বিষ্ণু বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল। মাকে সে খুঁজে পেলো বাগানে, পুজোর জন্য ফুল তুলছেন। আর লক্ষ্মণকে পাওয়া গেল পেছনের ঝুল বারান্দায়। তখনো অন্ধকার কাটেনি। লক্ষ্মণ মাদুর পেতে হারিকেন জ্বালিয়ে বই পড়ছে। বহুকাল এই দৃশ্য দেখেনি বিষ্ণু। ভোরের মানুষগুলো এত সুন্দর হয় ? সে কেন এতকাল দেখেনি এই আফসোসে তথাপি ভোর দেখতে পাওয়ার অপার্থিব সুখে তার মনটা নিমেষেই ভরে গেল। দৌড়ে পুজোর ঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বিষ্ণু তাই প্রতিজ্ঞা করল, যে করেই হোক ভাইয়ের সাথে পড়াশোনা করে এই বছরেই মাধ্যমিকটা সে দেবেই দেবে।
এভাবে চলতেই থাকল একের পর এক। মহল্লায় নীরব বিপ্লব ঘটে গেল। বিগত একশ বছরে এলাকার যা উন্নতি হয়নি তা এক মাসেই সম্ভব হল বলা যায়। কিন্তু এই রেনেসাঁ যার কারণে ঘটল তিনি এই সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানেন না। পরিবর্তনের হাওয়া বাতাসে ক্রমান্বয়ে অভ্যস্ত এলাকার জনগণও কোন এক অজানা কারণে তার এই চিৎকার চেঁচামেচির নেপথ্য কারণ জানারও প্রয়োজন বোধ করেনি।
মাস ছয়েক পরের ঘটনা। দৈনিক নবোদয় পত্রিকার সাংবাদিক পরেশ রায় হঠাৎই একদিন বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারলেন নিত্যানন্দপুরের কথা। এলাকাটি নাকি বিগত ছয় মাসে কল্পনাতীত উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু উন্নতিটা কি কারণে সেটা নাকি ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেনা। পরেশবাবুর পেশাটাই ধোঁয়া খুঁজে বেড়ানোর। তিনি আর দেরি করলেন না। এলাকার কমিশনার জাহিদ সাহেব তাঁর মোটামুটি পরিচিত। ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়েই এককালে আলাপ পরিচয়। কোন এক সকালে পরেশবাবু সরাসরি তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে উপস্থিত হলেন। জাহিদ সাহেব কাঁচা পাকা চুলের ঝালর সরিয়ে পরেশবাবুকে দেখলেন। মুখে কিছু না বললেও খুব একটা খুশি যে হননি সেটা তাঁর চেহারাতেই বোঝা গেল। যাইহোক, ভণিতা না করে পরেশবাবু তাঁর নিত্যানন্দপুরে আসার কারণ ব্যাখ্যা করলেন। জাহিদ সাহেব একটা পান মুখে পুরে ঠোঁটটাকে সূচলো করে বললেন,
“আসলে কি জানেন পরেশবাবু, আজকাল মানুষ অন্য কারো উন্নতি দেখলে ‘সর্ব অঙ্গে জ্বালাপোড়া’ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এটি নতুন নয়, অতীব পুরাতন রোগ। আমি এই এলাকার কমিশনার নিযুক্ত হয়েছি ৯ মাস হয়েছে। শুরু থেকেই একটি মহল আমার সকল কাজকর্মের মধ্যে বাগড়া দিয়ে আসছে। আর এখন আমার এলাকার উন্নতি দেখে তারা যারপরনাই ঈর্ষান্বিত। নাম বলার প্রয়োজন দেখিনা, সবাই জানে এরা কারা। কমিশনার করিৎকর্মা হলে এলাকার উন্নতি কেউ দাবায়ে রাখতে পারবেনা, যতই তারা ষড়যন্ত্র করুক।”
“আপনি একটু ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছেন। বুঝতে পারছি আপনার উপর দিয়ে অনেক ঝড় যাচ্ছে। আসলে আমি কিন্তু আমার পেশাগত দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছি। আপনার এলাকার উন্নতি মানে দেশের উন্নতি। আপনার উন্নতির এই ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে দেশ দশের উন্নতি হোক, আপনার এলাকার নাম দেশে বিদেশে, মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যাক, চাই কি আপনার নাম নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হোক, সেটা কি আপনি চান না?”
“অবশ্যই চাই। আপনি সাংবাদিক মানুষ, আমার মেহমান। কষ্ট করে অত দূর হতে আমার এলাকায় এসেছেন, অতিথিপরায়ণতায় কোন ত্রুটি হবেনা। আমার ভাগ্নে দুলাল আপনাকে এলাকা ঘুরে দেখাবে। ছবিটবি তুলতে চাইলে তুলবেন। পেপারে খবর বিশদ করে ছাপাবেন। কিন্তু ফর্মুলা কাউকে জানাতে পারবনা, সরি।”
পরেশবাবু চৈত্রের গরম এবং সিগারেটের তৃষ্ণা একই সঙ্গে অনুভব করলেন। যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। এই লোকের পেটে বোমা মারলেও কোন কথা বের হবে না। সঙ্গে করে আবার ‘ভাগ্নে’ নামক চলন্ত সিসি ক্যামেরা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় যায়।
পরেশ রায় সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখলেন বেশ হোঁদল কুতকুত চেহারা নিয়ে পাশের বারান্দা দিয়ে কে একজন হেলে-দুলে এলো। কাছে আসতেই জাহিদ সাহেব তার কানে ফুস ফুস করে কিছু একটা বলতেই সে তেরছা চোখে পরেশবাবুকে ভালোভাবে আপাদমস্তক দেখল। তারপর হঠাৎই ইয়া মোটা পেটটাকে দুলিয়ে বলল,
“চলুন বাবু, আপনাকে এলাকাটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি।”
পরেশ রায় বলামাত্রই দেরি না করে উঠে পড়লেন। বেলা পড়ে আসছে। যা ঘোরার এখনই ঘুরে না নিলে বিকেলের বাসে বাড়ি ফেরা যাবেনা।
বেশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুর। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে কোথাও। তার রেশ ধরে ঠাণ্ডা-মিষ্টি হাওয়া বইছে। মোটের উপর ভীষণ ভারী অন্যরকম একটা দিন। পরেশবাবু দুলালের দিকে তাকিয়ে একটা হাওয়াই মিঠাই হাসি দিলেন। শেষ বোধহয় ঝিলিককে ইম্প্রেস করার জন্য এই হাসি দিয়েছিলেন, তাও মেরেকেটে ১০ বছর তো হবেই। দুলাল পিটপিট করে তার দিকে তাকাচ্ছে। লক্ষণ সুবিধের মনে হচ্ছে। পরেশ রায় পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললেন,
“তুমি তো আমার অনেক ছোট, ‘তুমি’ করেই বলছি, কেমন? বেনসন চলে?”
দুলাল হাসতে গিয়ে ছন্দে ছন্দে পেট-পর্বত নাচাল,
“কেউ দিলে চলে, এই আর কি। হে হে হে।”
পরেশবাবু সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, “কেউ দিলে চলে মানে কি? নিজে কিনে খাও না?”
দুলাল আগের চেয়ে বিশ্রীভাবে পেট দুলিয়ে হেসে বলল, “কি করে খাব? রোজগার তো করি না কিছু। মামার কিছু ফাইফরমাশ খাটি, বাজার-টাজার করে দেই। তাতে করে খুচরো কিছু টাকা বের করতে পারি মাঝেমধ্যে। ওতে কি আর রোজ রোজ বেনসন খাওয়া যায়?”
পরেশ রায় চিন্তিত ভঙ্গীতে মাথা নাড়ালেন, “তা বটে। তাছাড়া শরীরটাও যা বানিয়েছ বাপু, ওর পেছনেও তো ম্যালা খরচ করতে হয়।”
“তাতো বটেই বাবু। খাওয়া দাওয়া মারফত আমার একটা খরচ তো আছেই। আমার মতন মোটা মানুষ এই এলাকায় আর একজনই আছে, নাম তার পলকা বানু। একটু সামনে গেলেই উনার বাড়ি, সাইরেন গলিতে।”
পরেশবাবু আকাশ থেকে পড়লেন, “সাইরেন গলি? এমন অদ্ভুত নাম কেন?”
“সে এক ইতিহাস বাবু, চলুন যেতে যেতে সব বলছি।”
জীর্ণশীর্ণ পলেস্তরাখসা এক ভগ্নস্তূপ যেন বাড়িটা। পরেশ রায় অনেকক্ষণ ধরে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন একটা বাড়ি এতদিন ধরে কিভাবে টিকে আছে সেটাই অবিশ্বাস্য। শুধু তাই নয় এ বাড়ির বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করতে হয়। পরেশবাবু একটুও না ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি বাড়িটিতে ঢুকবেন। দুলাল একটু ইতস্তত করলেও পরেশবাবুর এক কথা, উনি ঢুকবেনই।
পুরানো বাড়ির উঁচু উঁচু সিঁড়ি পার হয়ে ছোট্ট একটু খোলা জায়গা। তারপর দরজা। দরজার পাল্লাদুটো একটু খোলা। পরেশবাবু গলা খাঁকড়ি দিলেন। ভেতর থেকে “উ” জাতীয় একটা শব্দ ভেসে এলো।
“কেউ আছেন? একটু কথা বলতাম।”
কারো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। খুবই মুসিবতে পড়লেন তিনি। অপরিচিত একটা বাড়িতে হুট করে ঢুকে যাওয়াটা ঠিক ভদ্রোচিত নয়। তার উপর যেখানে পুরুষ মানুষ থাকেনা।
হঠাৎ করে পেছন থেকে মতিয়া চেঁচিয়ে বলল,
“কি চাই আপনাদের? আপনারা কারা? এখানে কি করছেন?”
তারপর দুলালের দিকে তাকিয়ে সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, “ওহ দুলাল ভাই, আপনি? কিন্তু উনি কে?”
দুলাল কিছু বলার আগেই পরেশ রায় বলে উঠলেন, “আমাকে তুমি চিনবে না। আমি কাশেম সাহেবের একজন দূর সম্পর্কের ভাগ্নে। অনেকদিন লন্ডনে ছিলাম। দেশে এসে শুনলাম উনি মারা গেছেন। তাই ভাবলাম মামীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে যাই। এই আর কি।”
“কিন্তু উনি তো অসুস্থ। এখন কোথাও বের হন না। কাউকে চিনতেও পারেন না। ছেলেরা দূর থেকে কিছু পাঠায় না। পেনশনের টাকা দিয়ে মাসের খরচ চলে। চিকিৎসা করাতে তো অনেক খরচ, তাতো পারিনা।”
“ডাক্তার দেখিয়েছিলে?”
“হুম, ঢাকা থেকে শুক্রবার একজন বড় ডাক্তার আসেন। তাঁর কাছে দেখিয়েছিলাম। দুলাল ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। উনি সব জানেন।”
দুলাল মাথা চুলকে বলল, “বাবু কথা সত্য। ডাক্তারবাবু দেখে বলেছিলেন মানসিক রোগ ওটা। সিজোফনিয়া না কি যেন নাম বাবু রোগটার। আমরা অশিক্ষিত লোক, অতশত তো বুঝিনা। ডাক্তারবাবু বলেছে এ রোগে মানুষ গায়েবী আওয়াজ শোনে, একা একা কথা বলে, চিৎকার করে, ভুলভাল বকে, মানুষকে সন্দেহ করে। চিকিৎসা খরচ অনেক। ছেলেরা তো উনার কোন খরচ দেয়না বাবু। কাশেম চাচার পেনশনই বা কয়টা টাকা।”
মতিয়া একটু ভেতরে যেতেই দুলাল কাঁচুমাচু ভঙ্গীতে বলল, “কি বলব বাবু, মতিয়াকে আমি অনেক ভালোবাসি। ওর কষ্টটা তো দেখলেন বাবু। দু’হাতে যত্ন নিচ্ছে। মাঝেমধ্যে আমি নাস্তার টাকা বাঁচিয়ে মতিয়াকে দিয়ে যাই। না খেয়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয় বাবু। তবুও মায়ার টান বড় টান, তাকে কি অস্বীকার করা যায়? যায় না বাবু।”
“জাহিদ সাহেব পলকা বানুর ব্যাপারে জানেন?”
দুলাল মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে মাথা ঝাঁকাল, “উনি সবই জানেন। আপনি জানেন বাবু, পলকা চাচীর এই অসুখের কারণেই নিত্যানন্দপুরের এত এত উন্নতি। কিভাবে হল কেউ জানেনা। কিন্তু জাহিদ মামা খুব চালাক লোক। উনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। চাচীর চিকিৎসার জন্য মতিয়া তাঁর কাছে অনেকবার টাকা চেয়েছে। উনি একটা টাকা দিয়েও সাহায্য করেননি।”
পরেশবাবু একটুখানি কি যেন ভাবলেন। তারপর পাল্লাখোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি কি উনাকে এক নজর দেখতে পারি? কথা বলব না, দেখেই চলে যাব।”
মতিয়া মাথাটা নিচু করে বলল, “আসুন।”
একটা তেল-চিটচিটে চাদরের উপর মোটা একজন মহিলা আধবোজা চোখে শুয়ে আছেন। নিঃশ্বাস আদৌ নিচ্ছেন কিনা বোঝা মুস্কিল। পরেশবাবু এগিয়ে গিয়ে তার হাতদুটো ধরলেন। অবাক করে দিয়ে তার চোখদুটো খুলে গেল। অপার্থিব এক দৃষ্টি। একাকীত্বের যন্ত্রনামাখানো। বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে না পেরে পরেশবাবু উঠে পড়লেন। তারপর দরজার পাশে দাঁড়ানো মতিয়ার হাতে দু’হাজার টাকা দিয়ে বললেন,
“টাকাটা রাখো, উনার যত্ন নিও, আমি আবার আসব।”
দুলাল আর মতিয়ার অবাকদৃষ্টি পেছনে পড়ে রইল।
সিজোফ্রেনিয়া রোগটা যখন ঝিলিকের ধরা পড়ল তখন পরেশবাবুর সংসারের বয়স দু’বছর। ভালোবাসার নীড় গড়তে একটা ছোটখাটো প্রেসের চাকুরী, মাসের মাইনে দিয়ে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা’। এমতাবস্থায় ডাক্তার যখন এই ঘোষণা দিলেন দুনিয়াটা মুহূর্তেই কেয়ামত হয়ে গেল তাঁর। নাহ বোধহয় সেদিন কেয়ামত হয়নি। হয়েছিল সেদিন, যেদিন দরজা ভেঙ্গে ফ্যানের সাথে ঝুলানো তিন মাসের পোয়াতি ঝিলিকের লাশটাকে পুলিশ নামিয়েছিল। ঝিলিকের ঠাণ্ডা পা দুটো এখনো পরেশবাবু তাঁর হাতে অনুভব করেন।
পরেশ রায় যখন কমিশনারের কার্যালয়ে ঢুকলেন তখন সূর্য ডুবুডুবু। জাহিদ সাহেব বোধহয় দিনের শেষ পানটা চিবুচ্ছিলেন। পরেশবাবুকে দেখে গ্লুকোজ হাসি দিয়ে বললেন,
“কাজ শেষ?”
পরেশ রায় সানগ্লাসটা পকেটে পুরতে পুরতে বললেন,
“হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। একটা কাজ নিয়ে এতো সময় নষ্ট করলে অন্য কাজ করব কখন, বলুন?”
“তা কেমন দেখলেন আমার এলাকা? আমার ৯ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম, বুঝলেন? কারো কোন অভিযোগ পাবেন না। সবার খেয়াল রাখতে গিয়ে অকালে চুল সব পাকিয়ে ফেলেছি দেখতেই পাচ্ছেন। এলাকার উন্নতি তো আর এমনি এমনি হয়নি।”
“উন্নতিটা ভালোই করেছেন জাহিদ সাহেব। ভবিষ্যতে নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেলেও আশ্চর্য হব না। আপনি ফর্মুলার কথা বলছিলেন, তাই না? স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের মত আপনি ফর্মুলার নাম ভাঙ্গিয়ে খাচ্ছেন।”
জাহিদ সাহেব কপট দৃষ্টিতে পরেশ রায়ের দিকে তাকালেন,
“কি বলতে চান আপনি? খুলে বলুন।”
“অকালে চুল পাকিয়ে আপনি যেটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন সেটাকে যদি জনগণের প্রতি খেয়াল রাখা বলেন তাহলে সেটার সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে বৈকি। আপনার উন্নতির ফর্মুলা আপনার কাছেই রাখুন আর কিছু কিছু কথা গোপনই থাকুক। আপনারও, আমারও।”
নিত্যানন্দপুর বাজারের টিমটিমে আলো পেছনে ফেলে বাস ছুটে যাচ্ছে, সেই সাথে তারা ঝলমলে রাতটাও ছুটে যাচ্ছে এক অজানা ভোরের আশায়। পরেশ রায় তৃপ্তির আনন্দে চোখ বুজলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৭