ঢাকার একটি পত্রিকার কিছু অংশ: ‘ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। পাশের মসজিদেরে মাইকে এমন প্রচারণা চালিয়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের পিয়ার উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছিত করেছেন এমপি সেলিম ওসমানের অনুসারীরা। এতে এমপির হাত রয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। গত শুক্রবার সকালে এই লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে।’ আমেরিকায় বসে শনিবার এ সংবাদ দেখার পর থেকে মনে হচ্ছিলো মিথ্যা প্রচার ও অপমানের শিকার হলেন আর একজন সন্মানিত শিক্ষক। তাকে জনতা মারধর করেছে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভেবে পেলাম না কিভাবে একজন এমপি সর্বসমক্ষে একজন শিক্ষককে কান ধরে 'ওঠ-বস' করাতে পারেন। প্রধান শিক্ষক শ্যামলবাবু বিবিসি বাংলা ও বাংলামেইলকে তার ওপর নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, স্কুল পরিচালনা কমিটির বিরোধের জের হিসেবে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে। আমাদের দেশে আগে শিক্ষকরা ছাত্রদের মাঝেমধ্যে কানে ধরে ওঠ-বস করাতেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন এমপি'রা শিক্ষকদের কান ধরে ওঠ-বস করাচ্ছেন। আগে শিক্ষকের কথায় ছাত্র শাস্তি পেত, এখন ছাত্রের কথায় এবং এমপি'র ইচ্ছায় শিক্ষক শাস্তি পায়!
পত্রিকা আরো বলেছে: ‘এ সময় সেলিম ওসমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। জনৈকা পারভীন আক্তারকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে বসানোর জন্য বেশ ক'বছর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু শ্যামলবাবু ১৭ বছর স্কুলের হেডমাস্টার, তিনি ছাড়বেন কেন? করে আসছিলেন। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, কমিটির সদস্য ইউএনও অফিসের পিয়ন মিজানুর রহমান, মতিউর রহমান মিজু, মোবারক মিলে গুজব রটায় যে রিফাতকে মারার সময় প্রধান শিক্ষক ইসলাম বিরোধী মন্তব্য করেছেন। বুদ্ধি করে তাকে শুক্রবার মিটিংয়ের কথা বলে স্কুলে আনা হয়, অন্যদিকে পাশের মসজিদে বলা হয় তিনি আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। মসজিদের মাইকে সাধারণ মানুষকে ডেকে আনা হয় এবং তাদের উত্তেজিত করা হয়। জনতা স্কুলে ঢুকে ম্যানেজিং কমিটির সহায়তায় তাকে গণপিটুনি দেয়। মিডিয়ায় এমপি সেলিম ওসমান বলেছেন, ‘আমি জানতে পারি যে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে প্রধান শিক্ষককে মারধর করা হচ্ছে। আমি সেখানে পুলিশ পাঠাই। পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করলেও বাইরে নিয়ে আসতে পারছিল না। জনতা তাদের ঘিরে রেখেছিল। পরে আমি ওখানে গিয়ে জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে তাকে উদ্ধার করি।’
মিডিয়ায় এ সংবাদ ব্যাপক প্রচার পায়, একাধিক ভিডিওতে শ্যামলবাবুর লাঞ্ছনার চিত্র বেশ পরিষ্কার। শাস্তি শেষে এমপি সাহেবের হুকুমে জনতা বিদায় নেয়। প্রশ্নটা এখানেই, করা ছিল এই জনতা যে এমপির কথামত বিদায় নিলো? এ ঘটনায় এমপি সেলিম ওসমান কতটা দায়ী, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তার ভাই শামিম ওসমান আমায় বলেছেন, সেলিম ভাইয়ের কাছে মনে হয়েছে ওইসময় ওই শিক্ষককে রক্ষায় কান ধরে ওঠ-বস করানোটাই একমাত্র উপায় ছিল, তিনি হয়তো তাই করেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ওই শিক্ষক যদি তার বাবা বা ভাই হতেন, তবে তিনি কি করতেন? বন্দর থানার ওসি আবুল কালাম বলেছেন, জনতার রোষ থেকে বাঁচাতে ওই শিক্ষককে পুলিশ হেফাজতে নিতে বাধ্য হয়েছেন। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে কি ঘটনাকে এতোই সহজ মনে হয়? নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার এবং ওসি একসুরে কথা বললে জনতার সাধ্য আছে তা অমান্য করে? তাই মনে হয়, এখন এমপি-ওসি যা বলছেন, সব সাজানো অজুহাত। ভুলে গেলে চলবেনা যে, মাত্র ক'দিন আগে একজন ম্যাজিস্ট্রেট দু'জন শিক্ষককে তাত্ক্ষণিক বিচারে ছয়মাসের জেল দেন এবং তিনিও একই অজুহাত দিয়েছিলেন।
প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী সবিতা হালদার বলছেন, তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। এও বলেন, ‘তারা এমনভাবে গুজব রটিয়েছে যে, আমরা আবারো হামলার শিকার হতে পারি।’ রোববার শ্যামলবাবু'র সাথে আমার কথা হয়েছে। শিক্ষক শ্যামলবাবু একেবারে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বললেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। আমি তাকে বলেছি, ‘দাদা, এ লজ্জা-অপমান আপনার নয়, আমাদের সবার, পুরো জাতির।’ মানিক চন্দ্র সরকার নামে একজন সাংবাদিক তখন তার সাথে ছিলেন, তিনিও আমার সাথে কথা বলেন, তার বক্তব্য হলো- ‘আমরা সাহায্য করতে চাইলেও পারছি না, সরকার এগিয়ে এলে ভালো হয়।’ ঢাকার আইউবিএটি'র অধ্যাপক চন্দন সরকার এরআগে আমায় অনুরোধ জানিয়ে বলেছিল যে, ‘শিক্ষক শ্যামলবাবুর অবস্থা একেবারে নাজুক, বাইরে থেকে আমরা কথা বললে হয়তো তিনি বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পাবেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করেছি একথা বলে যে, আমরা তার পাশে আছি। এমপি শামীম ওসমানের সাথেও আমার কথা হয়েছে। তাকেও আমি ওই শিক্ষকের পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করেছি।’
যে জাতি একজন শিক্ষককে এভাবে অপমান করতে পারে, সেজাতি নিজেদের সভ্য বলে দাবী করতে পারে কি? আমার কিছু সাংবাদিক বন্ধু জানায় যে, বাইরের লোক তেমন হেডমাস্টার শ্যামলবাবুর সাথে যোগাযোগ করতে সাহস পাচ্ছে না। আমি তাই ভ্রাতৃ যুগলের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি! এমপি সেলিম ওসমানকে আমি কখনই চিনতাম না, শামীম ওসমান বিএনপির তাণ্ডবে পালিয়ে থাকা অবস্থায় একবার ভারত থেকে আমেরিকা এসেছিলেন, তখন আমরা তাকে সঙ্গ দিয়েছিলাম। শামীম ওসমান কথা দিয়েছেন তিনি শ্যামলবাবুর সাথে দেখা করবেন এবং বিষয়টি দেখবেন। আমি তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওসমান পরিবার সম্পর্কে উচ্চ মন্তব্যের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। এ এলাকায় প্রধান শিক্ষক নিগৃহীত হয়েছেন সেটা শামীম ওসমানের এলাকা নয়, তবু তিনি এগিয়ে এসেছেন এজন্যে তাকে ধন্যবাদ জানাই।
এ ঘটনার পর সামাজিক মাধ্যমে হাজার হাজার মন্তব্য আসছে। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, আপনি কি কোনো হিন্দুকে বা সংখ্যালঘুকে টার্গেট করতে চান? বা জমিজমা বা তর্কাতর্কি নিয়ে সাইজ করতে চান? তাহলে এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দিন যে, 'উনি ইসলামের অবমাননা করেছেন'! ব্যাস, 'গ্যারান্টেড সাকসেস'। ফেসবুকে চিত্রা পাল লিখেছেন, 'একজন শিক্ষকের কানে ধরার ছবি দেখে যতটা দুঃখ পেয়েছি, ততটা বিদ্রোহী কি হতে পারছি?' আর একজন লিখেছেন, 'এটি একটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার নীলনক্সা'। একজন বললেন, সাম্প্রতিককালে শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের হুঙ্কার এবং শিক্ষাক্ষেত্র থেকে হিন্দুদের বিদায় করার জন্যে এটি একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত। এক ভদ্রলোক লিখেছেন এক মজার মন্তব্য, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন- দেশে আইএস নাই, সেলিম ওসমানের মত এমপি থাকলে আর আইএস লাগে?’ সর্বশেষ বরিশাল বোর্ডে 'হিন্দু ধর্ম' বিষয়ে ফেল করা দুই হাজার শিক্ষার্থীকে নুতন করে পাস দেখানো হয়েছে, এরমধ্যে ৭৯ জন জিপিএ ৫ পেয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি ষড়যন্ত্র, না ভুল? যে দু'একজন ছাত্র-ছাত্রী ফেল করে আত্মহত্যা করেছেন, এর দায় কে নেবে?
বান্দরবনে বৌদ্ধ ভিক্ষু গলা কেটে জবাই; টাঙ্গাইলে দর্জি হত্যা; নড়াইল-১ এমপি'র বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ; কালিয়ায় নৌকায় ভোট দিয়ে সংখ্যালঘুরা বিপাকে; বরিশালে ব্যাপটিস্ট মিশনের জমি নিয়ে সংষর্ষ; ভালুকায় প্রতিমা ভাঙচুর; ইমাম হত্যা, সিঙ্গাপুরে ৮ বাংলাদেশি জঙ্গি গ্রেপ্তার; পাবনায় শিব মন্দিরের মুর্তি ভাঙচুর; বগুড়ায় ১১ বছরের বালিকা অপহরণ, সংখ্যালঘু শিশু ধর্ষণ, যুবলীগ নেতা আটক; শত বছরের বুড়িতলা কালীমন্দিরে ভাঙচুর; জঙ্গিরা অচিরেই দেশের গ্রামগুলো দখল করবে বা সর্বশেষ শিক্ষকের কান ধরে ওঠ-বস নিশ্চিতভাবে একটি দেশ বা জনগোষ্ঠীর জন্যে কোনো শুভ সংবাদ নয়। আমরা তো এই বাংলাদেশ চাইনি, বাংলাদেশের চেহারা যদি পাকিস্তান বা ইরানের মত হয় তবে কি দরকার ছিল দেশ স্বাধীনের? ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান আর বাংলাদেশের চেহারাটা তো এখন একই। যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লম্বা লম্বা বুলি আওড়াতে পছন্দ করেন, তাদের আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখার অনুরোধ রইলো। তবে এ সম্পর্কে ভালো কথা বলেছেন গণজাগরণের ইমরান সরকার, তিনি বলেছেন- মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খই ফোটাবেন, আর মুর্তি-মন্দির ভাঙবেন তা তো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের নমুনা হতে পারে না!
ধর্মের নামে একজন শিক্ষকের লাঞ্ছনা বা মানবতার অপমানের শেষ কোথায়? টার্গেটেড কিলিং আমরা দেখছি, এখন ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে অন্যদের টার্গেট করে হয়রানিও আমরা হামেশাই দেখছি। এতে ব্যক্তিগতভাবে কিছু লোকের কিছু সময়ের জন্য লাভ হলেও ধর্ম বা সমাজের কোনো লাভ হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্র তাই এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার। দু:খের বিষয়, আমরা তাও দেখছি না। ওই অপমানিত প্রধান শিক্ষক শ্যামল ভক্তের কাহিল অবস্থা শুনে আমার সিরাজদ্দৌলা নাটকের ডায়লগের মতোই বলতে ইচ্ছে করেছিল, 'জাতির এই দুর্যোগে কে দেবে তারে আশা, কে দেবে তারে ভরসা।’ এই শিক্ষক শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি নন, তিনি শিক্ষক সমাজের একজন প্রতিনিধি, এই অপমান পুরো শিক্ষক সমাজের। শিক্ষকরা যদি এর প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হন, তবে কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘অপমানে হতে হবে তাদের সবারই সমান...’।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক। ১৫ মে ২০১৬।
// বাংলামেইল২৪ডটকম//সোমবার, ১৬ মে ২০১৬ ১৬:৩৪ ঘণ্টা