আমাদের গ্রামের নামটি বেশ সুন্দর।কৃষ্ণকলি।সবুজ শ্যামল এই গ্রামটি আমার খুব পছন্দ।এই গ্রামকে ঘিরে আমার যত স্মৃতি যত কথা।এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক শান্ত টলটলে জলের নদ।নদের নামটিও বেশ মিষ্টি কপোতাক্ষ।কপোতাক্ষের জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। কি যে স্বচ্ছ!নদীর তলদেশ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায় আমার যখন খুব মন খারাপ লাগে তখন একমনে এই জলের দিকে তাকিয়ে থাকি আর কথা বলি। মনে মনে নিজের কষ্ট নিজের দুঃখ নদীর সাথে ভাগ করে নেই।
আমার নামও কিন্তু কৃষ্ণকলি । শুনেছি এই নাম নিয়ে অনেক যুদ্ধ হয়েছে আমদের রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে । সে লড়াই বাবা একাই লড়েছিলেন ।মা নিপাট ভালো মানুষ একটু বেশী মাত্রায় ভালো।সাতেও নেই পাঁচেও নেই। যা হোক আমাদের পরিবারের সকল মেয়েদের নামগুলো আরবী শব্দে রাখা শুধু আমার নামটি বাদে ।এইজন্য আমাকে কম টিটকারি শুনতে হয়নি বা হয়না।ছোটবেলায় আরবী পড়তে গেছি মক্তবে হুজুর আমাকে ডেকে বলল, এই হিন্দুয়ানী নাম কে রাখছে? এই নাম এখানে চলবেনা । আজ থেকে তোর নাম হইলো খাদিজা। বিবি খাদিজার নামে নাম।কি? নাম পছন্দ হইছে? আমি শুকনো মুখে মাথা নাড়ালাম।
এখন ও কেউ কেউ আমায় খাদিজা বলে ডাকে। কিন্তু কেন জানি আমার কৃষ্ণকলি নামটাই বেশী পছন্দ হয়।বাবা রেখেছিলেন বলে হয়তো এই নামের প্রতি আমার ভালো লাগাটা অন্যখানে।
আমার বাবা ছিলেন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত উদার মনের মানুষ।দাদাজানের সবচেয়ে স্নেহভাজন পুত্র।তিনি নাম ধাম নিয়ে অহেতুক প্যাঁচাল পছন্দ করতেন না।অবশ্য তিনি কোন বিয়য়ে কোন ঝামেলায় জড়াতেন না। আমার দূভাগ্য তার সাথে মনে রাখার মতো কোন স্মৃতি আমার খুব একটা নেই।আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন তিনি ট্রেনে নিচে পড়েন । সাত দিন বেঁচে ছিলেন এরপর।সাত দিনের মাথায় এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাকে আর মাকে একলা রেখে বাবা চলে গেলেন অজানার উদ্দ্যেশে আর শুরু হলো আমাদের মা ও মেয়ের অনন্ত কষ্টের জীবন।
বাবা ছিলেন কাব্য প্রেমি । অবসর সময়ে তিনি হয় কবিতা পড়তেন, নয়তো লিখতেন আমার সহজ সরল মা লুকিয়ে লুকিয়ে এখন ও সেই কবিতা পড়েন আর কাঁদেন। আমি জিজ্ঞাস করলে চুপচাপ চোখ মোছেন, কোন কথা বলেন না । মায়ের এজীবনে অনেক কষ্ট ,সেই উথাল পাতাল কষ্টের ভাগ তিনি কাউকে দিতে চান না।একা একা বয়ে বেড়ান অতীত স্মৃতির যন্ত্রণা ।
আমাদের যৌথ পরিবার। নিজেরা বাদেও অনেকগুলো আশ্রিত মুখ এই সংসারে আছেন ।তবে যাই বলি না,কেন একটা যৌথ পরিবারে কিন্তু সব কিছুই একটু বেশী বেশী। এখানে বিভিন্ন সাংসারিক কাজ, নানান ঝামেলা, অথবা আজাইরা ক্যাচাল যেমন বেশী তেমনি আবার একে অপরকে সাপোর্ট করার প্রবনতা কিংবা একে অপরের প্রতি আদর ভালোবাসা সহমর্মিতা, সহানুভূতি সবই কিন্তু এখানে অনেক বেশী বেশী ।যদিও আমি ও আমার মা এই হিসাবের মধ্যে পড়িনা।প্রয়োজনের বেলায় শুধু সবাই আমাদের খোঁজে ।কাজ ফুরালে অথবা প্রয়োজন ফুরালে কেউ আমাদের কথা মনে রাখে না।
বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর মা এই পরিবারে এক রকম আশ্রিতার মতো থাকছি, কাজের বেলায় সবাই খোঁঁজে, ওরে কলি তোর মাকে দেখছিনা যে ,শরীর খারাপ করেনিতো আহারে !!!
তোর মুখ এতো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?কিছু খেয়েছিস?
এসব বাক্যে আমি ভুলিনা। এই লোকগুলোকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি ।আমি শুধু মনে মনে হাসি মানুষের বিচিত্র চরিত্র দেখে।কত অভিনয় যে জানে এরা, তা এরাও মনে হয় নিজেরাই জানে না।
চলবে.....
#চলতে চলতে জীবনের পথে দেখা কতজনের সাথে
সময় কেটে যায় একে একে হিসাব মেলাতে ।।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:৪৪