মধ্য দুপুরের গনগনে সূর্যটা ঠিক মাথার উপর, রোদের তেজ এখন ভীষণ কড়া।
নীরব নিস্তব্দতাপূর্ণ এই শুষ্ক আবহাওয়ায় মেঘহীন তৃষিত আকাশ যেন থরথরিয়ে কাঁপছে প্রবল তৃষ্ণায়।
অপার্থিব শুনশান নীরবতায় বাতাসের মৃদু মন্দ দোলায় গাছের পাতার শনশন আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই কোথাও।এই অবসরে সকল প্রাণিকুল বুঝি বিশ্রামে গেছে উতপ্ত আবহাওয়ার খরতাপ হতে খানিকটা নিস্তার পেতে।
এমন প্রখর রোদের দুপূর যে কী ভয়ংকর নিঃসঙ্গতা বয়ে আনতে পারে তা এরকম সময়ের মুখোমুখি না হলে বোঝার উপায় নাই।মেঠো পথটির দু পাশেই দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু প্রান্তর।কোথাও কোন জনমনিষ্যি চিহ্ন নেই। এরকম বিরাণ ভূমিতে গা ছমছমে একটা ভাব নিজের অজান্তে তৈরি হয় পথিকের মনজগত জুড়ে।
মধ্য ফাল্গুনের এই সময়ে এসে গ্রাম্য পথটি এখন প্রচন্ড রকমের ধুলিময়।গত দীর্ঘ ক’মাসের টানা খরায় গ্রাম্য পথে বর্ষায় পানিতে যে জমাট বাঁধা কাঁদার তাল জমেছিল তা ক্রমে ক্রমে শুকিয়ে শক্ত ঢেলায় পরিণত হয় মধ্য কার্তিকে। তারপর ধীরে ধীরে শক্ত কাঁদার তাল ভাঙে গরুর গাড়ি,হাটুরে আর পথচারী চলাচলে একটু একটু করে।
দিনে দিনে বেলে দোঁ আশ মাটির কাঁদার ঢেলা ভেঙেচুরে মিহি ধূলায় পরিণত হয় সময়ের পরিক্রমায় । যা পথচারীদের চলাচলের ক্ষেত্রে বেশ অস্বস্তিকর বটে।
নতুন বর্ষার ভারি বর্ষণ ছাড়া এ ধুলোর হতে পরিত্রাণের উপায় নাই কোন ক্রমেই তা এই এলাকার সকলেই কম বেশি জানে।এই সীমাছাড়া ধুলোর পথ ভেঙে এক পথচারী সাইকেলের নানান কসরত করতে করতে রাস্তা চলেছে নিদারুণ বিরক্তিতে।
এ রাস্তার যে এতটা করুন পরিণতি তা তার জানা ছিল না সম্ভবত জানলে সে নির্ঘাত এ পথ মাড়াতো না কিছুতেই।এখন অবশ্য ফিরে যাবার উপায়ও নেই। বিকল্প পথ যে এর থেকে দূরবস্থায় নেই তা কে বলবে তাকে? তার চেয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া ভালো মনে হলো তার কাছে, যেহেতু সে অর্ধেকের বেশি পথ চলে এসেছে তাই এমন যুক্তি।
এতো ধুলোবালি সাধারণত এ পথটাতে হয় না বলেই তার জানা ছিল, অপেক্ষাকৃত নির্জন এ রাস্তায় লোক চলাচল নিতান্তই কম। বলা যায় সপ্তাহের দুইদিন শনি ও বুধ, হাঁটবার ছাড়া দুপুরের এই সময়টাতে লোক চলাচল নেই বললেই চলে।
পথচারিটির কাছে লোক সমাগম কম এমন নির্জন পথই বেশি পছন্দের। যত বেশি লোকের মুখোমুখি তত বেশি জবাবদিহিতা। সে বর্তমান বাস্তবতায় জবাবদিহিতা বা কোন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না আর।
পথচারী লোকটির পরণে তেল চিটচিটে লুঙ্গি আর পিঠ ছেড়া জামা, সাথে মরিচা পড়া সাইকেল। তার সাজপোশাকে বোঝা যায় যে সে আর্থিক অনটনে ভুগছে। বহু কষ্টে প্যাডেল ঘুরিয়ে এই পড়ে কি সেই পড়ে অবস্থার মধ্য দিয়ে টেনে টেনে এগিয়ে চলছে সে নিরন্তর গতিতে।
গরমে তার শরীর ঘামে ভিজে জবজবে, পানি পিপাসাও পেয়েছে তার খুব কিন্তু এই ধুধু প্রান্তরে পানীয় জল পাওয়া যাবে না দুরের লোকালয় ছাড়া, এ এক মহা বিড়ম্বনাময় পরিস্থিতি তার জন্য।
ইতিমধ্যে তার সমস্ত গা মাথা বালিতে বালুময় হয়ে গেছে উলট পালট দখিনা বাতাসে। তার উপর এক মোটরসাইকেল আরোহী ধূলি ঝড়ের সৃষ্টি করে ভটভটিয়ে পার হয়ে গেল সবেমাত্র।
বেশ খানিকটা বাদে কৃত্রিম ধুলিঝড় কিছুটা কমতে এক দলা থুথু ফেলার বৃথা চেষ্টা করলো সে, বৃথা চেষ্টা বলার কারণ ততক্ষণে তার সারা গাল মুখ সূক্ষ্ম বালুকণায় পরিপূর্ণ এবং মুখের ভেতরটা আঠালো হয়ে গেছে।
রাগে দুঃখে মুখ খিস্তি করে গালি দিতে দিতে সাইকেল থেকে নেমে হাতে করে সাইকেল ঠেলে নিতে লাগলো সাইকেলের আরোহী।এ পথটা এতোটা খারাপ কে জানতো, আগে জানলে সাইকেল নিয়ে কস্মিনকালেও এ পথ মাড়াতো না সে,সাইকেল বাদে সোজা মেঠো পথ ধরে কোনাকুনি মারতো। নিজে নিজে স্বগোতক্তি করলো সে। অসহায় এ পথচারীর নাম আনন্দমোহন। গ্রাম সঞ্চাডাঙ্গা,পোস্ট উত্তর পাড়া।
চন্দ্রাবতীর দিনগুলি আজকাল প্রচন্ড ব্যস্ততায় কাটছে।স্নেহলতার যত্নআত্তিতে দেখাশোনায় দিনও রাতের প্রহরগুলো কি করে কখন কখন পার হয়ে যায় সে টেরই পায় না সে ঠিক মত।
আহ এখন বড্ড নিশ্চিন্ত জীবন। কত দিন বাদে নিশ্চিন্ত জীবন কাটাচ্ছে সে।
এইতো কিছু কাল আগেও তার ছিল অখণ্ড অবসর আর নিঃসঙ্গ একাকী জীবন।কাজ থেকে ফিরলেই সীমাহীন একাকীত্ব তাকে ঘিরে ধরতো সবসময়।
মনে হতো এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে আসবে তার।বেঁচে থাকা অনেক কষ্টকর ছিল তার কাছে। সে জীবনে মাঝে মাঝে আনন্দমোহন নামের লোকটি এসে উদয় হলেও সে আসা যাওয়ায় সুখ স্বস্তি তো দুরের কথা তার বদলে নানা অশান্তি ও বিপত্তি লেগেই থাকতো। নাই নাই হায় হায় করে জীবন হয়ে যেতো অতিষ্ট।
নানা রকমের অত্যাচার সয়ে সয়ে সেটাকেই সে ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল একসময়।
সেই সময় যদিও তার কখনো কখনো কষ্টের এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে হত না তা কিন্তু নয়। যাহোক সে দিনগুলোর কথা চন্দ্রাবতী আর মনে করতে চায় না।যা গেছে তা যাক।
এখন তার জগত জুড়ে স্নেহলতা আর স্নেহলতা, স্নেহলতার যত্ন আত্তিতে সে কোন রকম ক্রুটি রাখে না। সদা চোখে চোখে রাখে সে তাকে।
এখন আর কাজে যায় না সে,কাজ ছেড়ে দিয়েছে সিকদার সাহেবের কথা মত।তার এখন ধ্যান জ্ঞান স্নেহলতা। এমন ঘরোয়া জীবনই সে চেয়েছিল বহুকাল ধরে।
ঘরকন্না, সন্তান পালন এসবে যে এত সুখ মিশে আছে। কে জানতো! শুধু যদি আনন্দমোহন একটু শুধরাতো তাহলে জীবনটা অন্য রকম হয়ে যেত তার।
রওনক সিকদারের সাথে চুক্তির প্রধান শর্ত হলো সবকিছুর আগে স্নেহলতার মৌলিক অধিকার যেন সমুন্নত থাকে। আর তাই চন্দ্রাবতীর একমাত্র লক্ষ হবে স্নেহলতার দেখা শোনা করা,তার খেয়াল রাখা, তাকে মানুষের নত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। পেছন থেকে সব দায়িত্ব রওনক সিকদারের।
ফুটফুটে চাঁদের মত মেয়ে স্নেহলতা। সে দিনে বা রাতে কখনোই বেশি একটা জ্বালায় না চন্দ্রাবতীকে।বেশির ভাগ সময় সে শান্তই থাকে,খিদে পেলে একটু কাঁদে, আবার খাবার দিলে একদম ঠান্ডা ,মনের আনন্দে খেলা করে কখনোবা ঘুমিয়ে পড়ে।
যখন সে চন্দ্রাবতীর কোল জুড়ে থাকে তখন চন্দ্রাবতীর বুকটা জুড়িয়ে যায়। মাতৃত্ত্ব জনিত অতৃপ্তিগুলো মুহুর্তে উধাও হয়ে যায় তার।নিজের না হোক,হোক সে অন্য কারো সন্তান।তবুও নিজেকে মহাসুখী মনে হয় তার।ভাগ্যবান ও মনে হয়।
এখন তো স্নেহলতা তার একান্ত আপনার। সে এই দেব শিশুটিকে নিয়ে সারাদিন আদর আহ্লাদ করে। গান গায়, ছন্দ কাটে। কত কথা কয় একা একা, না হলে যে তার নয়নের মণি কথা শিখবে না। এ জীবনে বেঁচে থাকার স্বাচ্ছন্দ্য সে স্নেহলতার মাধ্যমে পেয়েছে। স্নেহ তার লক্ষী ঠাকুরুণ।
যে মেয়ে তার দূর্ভাগ্যের জীবনে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হয়ে এসেছে সে দেবী ছাড়া আর কোন উপমায় ভূষিত হতে পারে?
যেহেতু এখন আর তাকে নিত্য আয় রোজগারের চিন্তা করতে হয় না।তাই সে ঘরের বাহিরে যায় না খুব একটা।তাই বলে একাকী থাকার জ্বালা পোহাতে হয় না কখনোই ।
সংসার তার এ জীবনে গুছিয়ে করা হয়নি ঠিকই ।বিয়ে হয়েছিল নিতান্ত অল্প বয়সে ওয়ার্ড বয় আনন্দমোহনের সাথে।প্রথম প্রথম সে বুঝতে পারেনি আনন্দমোহনের আসল রূপ তবে দিন গড়াতে ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারলো লোকটি হাড়ে হারামজাদা। চরম ছন্ন ছাড়া।
তাস আর জুয়ার নেশায় ভয়ংকর আসক্তি ছিল তার ,সেই সাথে চলত মদ আর গাঁজার নেশা সমানতালে।
বিয়ের কাল রাত্রি পেরোতে না পেরোতে টের পেয়েছিল চন্দ্রাবতী কিছুটা কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিল না তার।আনন্দমোহনের সাথে জনমের মত বাঁধা পড়ে নিয়তিকে মেনে নিতে বাধ্য হলো সে।
নিরন্তর জ্বালা সয়ে সয়ে কখনো কখনো চন্দ্রাবতীর মনে হতো এর চাইতে তার মৃত্যুই শ্রেয়।
কিন্তু বিধাতা বুঝি তার অকালমৃত্যু কপালে লেখেনি। মানুষ চাইলেই সবকিছু নিজের মত করে করতে পারে না। চন্দ্রাবতী নিজে একদিন জাগতিক দুঃখ কষ্ট থেকে পালাতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে জ্বালা জুড়াবে বলে ঠিক করলো তখনই খবর এলো চুরির দায়ে আনন্দমোহন ধরা পড়েছে,এখন সে থানা হাজতে আছে।
মুহুর্তে চন্দ্রাবতী ঠিক করলো সে আত্মহত্যা করবে না। এখন আত্মহত্যা করলে মানুষ মনে করবে স্বামী শোকে পাগলিনী হয়ে এমন কান্ড করেছে।
সন্ধ্যা বাতি দেবার পর বাইরের ঘরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়লো। চন্দ্রাবতীর গলার আওয়াজটা বরাবরই কর্কশ।কড়া নাড়ার শব্দে স্নেহলতার ঘুম ভেঙে যেতে পারে এই অসময়ে কে এলো আবার ?
- এই কে রে।
কথা নেই কোন।
কিছুক্ষণ বাদে আবার কড়া নাড়ার আওয়াজ।
- এই কোন হারামজাদারে কথা বলে কেন?
- আমি রে আমি।
থমকে গেল চন্দ্রাবতী। আনন্দ মোহন না? এই অবেলায় শয়তানটা কোথেকে উদয় হলো? কি চায় সে? চিন্তিত মুখে দরজা খুলে দিল সে।
অনেকক্ষণ ধরে সারা বাড়ি ঘুর ঘুর করে ঘুরে দেখলো আনন্দ মোহন।তারপর পিচ করে একদলা থুতু ফেলল এককোনে। চন্দ্রাবতী তাই দেখে ঝনঝণিয়ে উঠলো।
-যেখানে সেখানে থুতু ফেলার অভ্যাস যাবে না তোমার এ জনমে।
- দোলনায় কে রে?
- জেনে তোমার লাভ?
- আমি জানবো না তো কে জানবে?
- আমার মেয়ে।
খিক খিক করে বাজে একটা ভঙ্গিতে হেসে উঠলো আনন্দমোহন।
- আমি তো নয় মাস বাড়ি নাই। জেলে ছিলাম। এর মধ্যে ভাতার ধরে মেয়েও হয়ে গেল।
- মুখ সামলাও। তোমার মুখে এখন আর বাজে কথা শুনতে ইচ্ছে করে না। ঘেন্না ধরে গেছে আমার।
- মাথায় আগুন জ্বালাস না। আমায় ঘেন্না করলেও আমি তোর স্বামী, একথা ভুলে যাবি না। আমি যেমন চাইবো তেমনি তোকে চলতে হবে।
- ইশশ ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই। আসছে আমার শিব ঠাকুর।
- অবস্থা ফিরলে এমনই হয়, সব বুঝি,সব খবরই রাখি আমি। হাতে পয়সা কড়ি নাই, কিছু মাল কড়ি ছাড় তো। আমি ক’দিন ডুব দেই। জেল থেকে ছাড়া পেতে না পেতে আবার ঝামেলায় পড়েছি। যাহোক মেলাদিন মাল খাই না। টাকা কড়িও নাই হাতে।
- তুমি কি আমাকে এক মুহুর্ত শান্তিতে থাকতে দিবে না? সারা জীবন জ্বালাবে বলে ঠিক করেছো?
- মুক্তি তো নাই। সাত জনমের বন্ধন যে। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে আনন্দমোহন।
- আমি বিশ্বাস করি না।
- আমি সব শুনেছি, তুই কার পাপ আমার ঘরে আনছিস। আমি সব লোক ডেকে বলবো। যদি টাকা দিস তো ক’দিন মুখ বন্ধ। নইলে....
ঘর থেকে দু হাজার টাকা এনে আনন্দমোহনের মুখে ছুড়ে মারল চন্দ্রাবতী। তারপর বলল,
- জেল থেকে ছাড়া পেয়েছো হাতে পয়সা কড়ি নেই। তাই দয়া করে প্রথমবার টাকা দিলাম দ্বিতীয়বার যদি এদিকে পা বাড়াও সোজা পুলিশ ডেকে ধরাবো।
আমার সাথে কিন্তু অনেক ক্ষমতাবান লোকের জানাশোনা আছে। চৌদ্দ শিকের ভাত আবার খাওয়াবো আবার যদি আর কোনদিন বিরক্ত কর।
-তোকে দেখতেও আসা যাবে না? এত নিষঠুর তুই। তুই তো জানিস তোকে ছাড়া আমার পথ চলাই দায়।
-ভিখারি কোথাকার,জুয়াচোর একটা।
এসময় আবারও দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতে সচকিত হয় চন্দ্রাবতী।
- তুমি এখন পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও।তাড়াতাড়ি করো, আমি চাই না তুমি আমার কাছে আসো এটা লোকে জানুক।
- যাবো কেন আমি তো তোর বর।পরপুরুষতো নই। বরকে কেউ কি কখনো এমন করে তাড়িয়ে দেয়? না দিতে আছে?
-তুমি যাবে? চন্দ্রবতী বটি ধরে।
কৃত্রিম ভয়ের ভঙ্গি করে হেসে ওঠে আনন্দমোহন ।
- নতুন নাগর ধরেছিস বুঝি, ব্যবসা তো জমে একেবারে ক্ষীর দেখছি। আর এই বাচ্চার বাপটা কে তা তো বললি না? যাক আনন্দ ফুর্তিতে করো টাকা কামাও, আমার কাজে বাধা না এলেই হোল, আমার আর কি? কি বলিস? তুই শুধু টাকা কামাবি আর আমায় দিবি। টাকা কামাবি আর দিবি। নারে বউ?
এদিকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আরো তীব্র হয়।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১০:২৮