ডাক্তার অলক চিন্তিত মুখে বসে আছেন তাঁর চেয়ারে। নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত। কিছুটা উত্তেজিতও তিনি এখন।
হঠাৎ কিছু একটা ভেবে মাঝে মাঝে চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারী করছেন আবার বসছেন,হাঁটার সময় তিনি হাত দুটোকে বিশেষ ভঙ্গিতে নাড়াচ্ছেন,খুব বেশি উত্তেজিত হলে তাকে এরকম অস্থির লাগে। আজ তিনি অতিরিক্ত উত্তেজিত।
একটি বাচ্চাকে অনৈতিকভাবে তার মায়ের কাছ ছাড়া করতে হবে এ ব্যাপারটা তার মনোজগতকে বেশ খানিকটা বিক্ষিপ্ত করে তুলছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে না ভুল? সমাজ না মানবিকতা কোনটা আগে? তিনি নিজের সাথে নিজে লড়াই করছেন নানা দায়বদ্ধতা থেকে।
নানা যুক্তি তর্ক তার মনের ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে অবিরত। অবশেষে সমাজ,সামাজিকতার দায়বদ্ধতা অগ্রাধিকার পেল, মানবিকতা হেরে গেল।
তিনি নিজেকে এই বলে নিজেকে স্বান্তনা দিলেন যে বাচ্চাটি তো অবৈধ ছিলো। ভ্রুণ অবস্থায় তাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতো অন্য যে কেউ হলে। তিনি তা করেননি মানবিক দিক বিবেচনা করে । তার তত্ত্বাবধানে অবশেষে বাচ্চাটি পৃথিবীর আলো দেখেছে। এখন তাকে একটু ভালো আশ্রয় দিতে পারলে, তিনি কিছুটা ভার মুক্ত হবেন।
মাতৃস্নেহ, মায়ের আদর বা বাবার ভালোবাসা, যত্ন কোনটিই দেওয়া সম্ভব নয় শিশুটিকে বর্তমান বাস্তবতায়।
এটাও তো ঠিক সব বাচ্চা তো আর বাবা মায়ের আদর স্নেহ পেয়ে বড় হয়ে ওঠে না, এই বাচ্চাটি ঠিক ঠাক আশ্রয় পেলে নিশ্চয় ভালো ভাবে বেড়ে উঠবে। সেটুকু সে নিশ্চিত করবে।
এটুকুই বা কে করে এ জগতে তাই না? আর এখন যা তিনি করছেন বাল্যবন্ধু রওনকের স্বার্থেই করছেন তার এখানে লাভ ক্ষতির কোন হিসাব নেই।
নিজের মনে তিনি নিজে বাদানুবাদ কথোপকথন চালিয়ে যেতে লাগলেন অনেকটাক্ষণ এবং সবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে তিনি অবশ্যই নিশ্চিত করবেন যেন শিশুটি ভালো থাকে।
আজ সকাল থেকে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি। এই দূর্যোগপূর্ণ দিনে কামরুন্নাহারের কোল জুড়ে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে আর্বিভূত হল ।
কামরুন্নাহার এখন ফুটফুটে বাচ্চাটির পাশে শুয়ে আছে মাতৃত্ব জনিত ক্লান্তি নিয়ে । অনেকটা ধকল গেছে আজ তার উপর দিয়ে।তার ঘুমন্ত মুখখানি এখন কোমল ও নিষ্পাপ অভিব্যক্তির সংমিশ্রণে মায়া মায়া লাবন্য পূর্ণ আভা ছড়াচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে দীপালী তার মুখের দিকে একমনে তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।মানুষের জীবনটা এমন কেন?
কিছুটা পরে তার কর্তব্যবোধ জাগ্রত হলো এভাবে চেয়ে থাকলে হবে না , বাচ্চাটিকে এখান থেকে সরাতে হবে । এটা তার দায়িত্ব।
অন্তত সে রকমই নির্দেশ দেওয়া আছে। আচ্ছা বাচ্চাটিকে সরিয়ে কোথায় রাখা হবে? এতিম খানায় নাকি ডাস্টবিনে? দীপালির শরীরের ভিতর কেমন যেন শিরশির করে উঠলো। তার চোখে জল চলে এলো। কেন রে তুই জন্মালি? কেন?
এর কিছুটা পরে বাচ্চাটিকে সরিয়ে নেওয়া হলো। কেঁদে উঠলো বাচ্চাটি, যেন প্রতিবাদ করতে চাইলো। এ সমাজের যত অন্যায় অবিচারের প্রতি ।ইট পাথরের দেয়ালে সেই প্রতিবাদ ভেসে বেড়াতে লাগলো। কিন্তু কারো করুনা বা অনুকম্পা জোগার করতে ব্যর্থ হলো শেষ পর্যন্ত।
এই জগতের মানুষগুলো যুগে যুগে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে কত কত বাচ্চার সুন্দর ভবিষ্যৎকে অন্ধকার গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে তার জানা অজানা ইতিহাসের অন্ত নেই।
বাচ্চাটির স্থলে রাখা হলো একটি ফুটফুটে পুতুল।দেখতে অবিকল মানুষের বাচ্চা যেন। সুস্থ মানুষও প্রথম দেখায় বোকা বনে যাবে নিঃসন্দেহে।
ধোকা দিয়ে শুরু হলো নতুন শিশুটির জীবন।জন্মেই সে সামিল হলো বাঁচা মরার তীব্র লড়াইয়ে।
পারবে কি সে টিকতে এই স্বার্থে ভরা নিষ্ঠুর পৃথিবীতে?
শেষ বিকেলে কামরুন্নাহারের যখন ঘুম ভাঙলো, প্রথমেই সে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো যেন, কি যেন হারিয়ে গেছে তার।তারপর পুতুলটির উপর চোখ যেতেই,একমনে তাকিয়ে রইলো, পুতুলটির দিকে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে ।
তারপর হারিয়ে যাওয়া কিছু পেয়েছে হঠাৎ এমন মনোভাবে ছোঁ মেরে পুতুলটি কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো কিছুক্ষণ আদর আহ্লাদের পর হঠাৎ সে নিজেই কেঁদে উঠলো,
- হায় আল্লাহ,খুকী তো কথা কয় না। খুকী তো কাঁদে না। খুকী তো হাসেও না, কি হয়েছে আমার খুকীর? আমার খুকী কি মরে গেছে?আমার খুকী কী মরে গেছে?
ও আল্লাহ আমার খুকী মরে গেছে?
মুহুর্তে পুরো পরিবেশ বেদনা বিধুর হয়ে উঠলো।দীপালি আর সহ্য করতে পারলো না। তার বুক ফেটে যাচ্ছে। চারদেয়ালের ইট পাথরও বুঝি শোকে কেঁপে কেঁপে উঠলো কামরুন্নাহারের কান্না শুনে।
মুহুমুহু কান্না আর বিলাপে ভবনটির পরিবেশ খুব তাড়াতাড়ি ভারি হয়ে উঠলো। তবু সিদ্ধান্ত বদলালো না কেউ । ফিরিয়ে দিল না কেউ বাচ্চাটিকে তার মায়ের কোলে।
নার্স দীপালির চোখ সেই থেকে ছলছল করছে, তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি বাচ্চাটিকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়।কিন্তু তা সম্ভব নয় তাহলে যে তার চাকরি চলে যাবে,ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে তাকে রাস্তায় এসে দাড়াতে হবে।তিনি এ জীবনে এরকম নিষ্ঠুর কাজ কোনদিনও করেননি। সে কারণে তার আরো বেশি খারাপ লাগছে, দিনশেষে সেও তো এক মা। আল্লাহ কি তাকে এজন্য কোন ভয়ংকর শাস্তি দেবেন?
আজ যা করলেন সেটা তো দায়িত্বের খাতিরে করলেন,তাছাড়া এতে নিশ্চয়ই মেয়েটির ভালোই হবে। তিনি আসলেই মেয়েটির ভালো চান।এ ক'মাসেই তার মায়া পড়ে গেছে কামরুন্নাহারের প্রতি।ছোট্ট শিশুটি আর কামরুন্নাহারের জন্য তার খুবই খারাপ লাগছে। খুব। কিন্তু কিছু করার নেই, মানুষের ক্ষমতা খুব সীমিত।
আহারে।
জন্মেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল মা আর সন্তান।
মেয়েটির নাম রাখা হলো স্নেহলতা। নামটি বেশ মিষ্টি,নামটি রাখলেন ডাক্তার অলক ।
রওনক সিকদার গোজ হয়ে বসে আছেন, কি সব যেন ভাবছেন তিনি আনমনে আর বিড় বিড় করছেন।
হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করে উঠলেন,
- নাহার ঠিক আছে তো? নাহার?
- এখন একটু উতলা হয়ে আছে স্নেহলতার জন্য,দীপালি ওর দেখাশোনায় আছে।আশাকরি সে সব সামলে নিতে পারবে। ও এসব কাজে অনেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ।আর চিন্তার কোন কারণ নেই কিছুটা সময় বাদেই ডাঃ অভিজিৎ আসবেন কামরুন্নাহারকে দেখতে। তারপর ঠিক করতে হবে পরবর্তী করনীয়।
রওনক সিকদার ভাবছেন অন্য ভাবনা, তার নিজের রক্ত বইছে বাচ্চাটির শরীরে তিনি চাইলে ও তাকে অস্বীকার করতে পারবেন না কোনদিন। সেটা সম্ভবও নয়।
আর তাই এই বাচ্চাটিকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে দেখতে তার ভালো লাগবে না কখনোই অথচ সামাজিকভাবে তিনি স্বীকৃতিও দিতে পারবেন না।
শাঁখের করাতে কাটা পাটাতনের মত তার মন আজ ফালা ফালা।
বাচ্চাটিকে তিনি সাদরে গ্রহণ করলে, তিনি, কামরুন্নাহার এবং তার পরিবারের সকলেই সামাজিক দৃষ্টিতে পতিত হবেন নিমেষে অথচ...।
-ডাক্তার একে নিয়ে কি করা যায়? কিছু ভাবলে?
ডাক্তার অলক সময় নিয়ে বললেন,
- এতিমখানায় দিবে?
তিনি গর্জে উঠলেন,
- না! না না,ওকে হয়তো আমি সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পারবো না কিন্তু অবহেলাও করবো না। ও মানুষ হবে আমার তত্ত্বাবধানে। যতদিন আমি বাঁচি,আমি ওকে দুর থেকে দেখে রাখবো। তুমি লোক দেখো।
- আস্তে কথা বল ইদানীং তুমি সবকিছুতে বেশি মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়ছো।
- না আসলে।
- তুমি যেমনটি ভেবেছো আমিও তেমনটি ভেবেছিলাম বেশ আগে? আমার জানা মতে চন্দ্রাবতী নামে একজন নার্স আছে তোমার শহরের কাছাকাছি থাকে, স্বামী পরিত্যক্তা,কিছুটা অসহায়, একাই থাকে।আমি কি ওর সাথে কথা বলবো? চাইলে স্নেহলতাকে তুমি ওখানে রাখতে পারো। কিছুটা কথা আমি তার সাথে তোমাকে না জানিয়ে সেরেছি বলে ক্ষমা প্রার্থী। তোমার নাম ধাম এসব অবশ্য বলিনি।
কিন্তু যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। বেশি সময় নেওয়া যাবে না।আমি আবারো বলছি আমার প্রতি বিশ্বাস রাখো আমি তোমার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রাখতে দায়বদ্ধ।
- ওভাবে বলো না,তুমি আমার অতি আপনজন।ঠিক আছে তুমি ওকে ডেকে পাঠাও আমি নিজে ওর সাথে কথা বলবো।
ঘন্টাখানেক পরে চন্দ্রাবতী এলেন,প্রথম দেখাতে রওনক শিকদার মেয়েটিকে পছন্দ করলেন,আসলে পছন্দ না করেও উপায় ছিল না।
চন্দ্রাবতী দরিদ্র এবং অসহায় তার হারাবার কিছু নেই, নগদ টাকা, মাসিক মাসোহারা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে গোটা কতক কাগজে সই করতে ও একটি মিশুর দায়িত্ব নিতে কোন রকমে দ্বিধা বোধ করলো না।
রওনক সিকদারও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে লাগলেন চন্দ্রাবতীর সাথে। তবে তা খুব গোপনে। এবং একটু একটু করে স্নেহলতার মায়ায় জড়িয়ে পড়তে লাগলেন।
আর এদিকে মাস তিনেক পরে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হলো কামরুন্নাহারকে। কামরুন্নাহার এখন কিছুটা সুস্থ। পলাশ কে তার কোলে দেওয়া হলো রওনক সিকদারের নির্দেশে। পলাশ তখন কয়েক মাসের শিশু। যদিও পলাশের মা জমজ বাচ্চার একটিকেও হাতছাড়া করতে খুব একটা রাজি ছিলেন না তবে বাড়ির কর্তাদের উপর কথা বলার উপর সাহস তখন তিনি সঞ্চয় করতে পারলেন না ।
এদিকে শ্রাবণের এক ঘণ ঘোর সন্ধ্যায় ফিরে এলো চন্দ্রবতীর স্বামী আনন্দমোহন। কি হবে এখন স্নেহলতার?
সে কী স্বাভাবিকভাবে নেবে স্নেহলতাকে? নাকি আবারও আশ্রয় চ্যুত হবে অসহায় মেয়েটি?
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ১১:২৫