(১)
আমি সমির । আমার পুরো নাম সমির তালুকদার। তালুকদার আমার বংশ পদবি। এক ঘন ঘোর বর্ষার দুপুরে আমার জন্ম।আমার মায়ের কাছ থেকে শুনেছি আমি জন্ম হওয়াতে নাকি আমার মায়ের সংসারটা টিকে গিয়েছিল।বাঁধ ভাঙা খুশির বন্যা বয়ে গিয়েছিল তালুকদার বাড়িতে । মন মন মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল দেদারসে ।আমার দাদিজান সগৌরবে ঘোষণা করেছিলেন
-ছোট তালুকদারের বংশ প্রদীপের আগমন হয়েছে। তোরা মন খুলে আনন্দ কর,খরচ যা কিছু আমার। আমার জীবনের শুরুটা দারুণ ছিল বলা চলে।
রং মাখা, বাজি পোড়ানো সহ নানা আয়োজনে মুখরিত হয়েছিল সেই সময় তালুকদার বাড়ি।সেই আয়োজন চলেছিল মাসখানেক ধরে । বিধবা জোবাইদা বেগমের একমাত্র ছেলে মানিক তালুকদার।অবশেষে মানিক তালুকদারের চার মেয়ের পর ছেলে হলো অর্থাৎ বংশ রক্ষা হলো।কিছুদিন আগেও এই নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে ছিলেন জোবাইদা বেগম।পাথর চাপা একটা কষ্ট সবসময় বয়ে বেড়াতেন বুকে করে তিনি। এত এত সম্পদ টাকা পয়সা কার জন্য? কিসের জন্য? কে করবে এই সম্পদের ভোগ দখল। সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবার যদি আবারও মেয়ে হয় সখিনা খাতুনের তবে আবার বিয়ে দেওয়া হবে মানিক তালুকদারকে। সবাই ধরে নিয়েছিল এবারও মেয়েই হবে তালুকদারের বউ সখিনার।গর্ভবতী হবার পর সখিনার শারীরিক লক্ষণও ছিল সেরকমই। মেয়ে হলে হোক তাতে আর দশ জনের কি? মেয়ে হলেই তো মানিক তালুকদারের বিয়ে আয়োজন । বিয়ে মানে সীমাহীন আনন্দ,খাওয়াদাওয়া আর উপহারের ছড়াছড়ি। সবাই সেরকমই প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
জোবাইদা বেগম তো গাল গল্প করে বলেই ছিলেন লোকে পাঁচ ছেলের পাঁচ বউ আনে আর তিনি এক ছেলের পাঁচ বিয়ে দিয়ে পাঁচ বউ আনবেন।যদিও পাঁচ বউ রাখা হারাম তবে চার বউতো রাখা যায় নাকি? প্রয়োজনে তিনি দুই মহলা বাড়ি বাড়িয়ে পাঁচ মহলা বাড়ি বানাবেন।তার টাকাপয়সার কোন কমতি নেই। সারা বাড়ি জুড়ে ছেলে ছেলের বউ নাতি নাতনিতে গম গম করবে। পাঁচ বউ তাকে সেবা যত্নে কোন কমতি রাখবে না নিশ্চয়। আসলে প্রতিযোগীতা না থাকলে কি সুবিধা হয়!
কিন্তু আমার আগমনে বিয়ে ব্যপারটা অকস্মাৎ ধামা চাপা পড়লো। আমার মায়ের সংসারটা বেঁচে গেল বলা যায়। ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে আমার মা ও বোনেরা আপাতত বেঁচে গেল।
সাতদিনের মাথায় মহা ধুমধামে আকিকা হলো আমার।আত্নীয় স্বজন দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হলো আর উৎসব তো চলছিলই। আমার নাম রাখা হলো সমির,সমির তালুকদার। তালুকদার বংশের একমাত্র বাতি বলে কথা। আমার যত্নের কোন ত্রুটি বিচ্যুতি রইলো না।দেখভালে নিয়োগ করা হলো খান তিনেক দাসী।
আমার মায়ের মুখের হাসি আর ধরে না। চোখে আনন্দ অশ্রু। মায়ের কদরও বেড়ে গেল একনিমেষে। আল্লাহর অশেষ রহমতের কারণে তার বিয়েটা টিকে গেল সেই উপলক্ষে আমার মা দশ রাকাত নফল নামাজ পড়েছিলেন একটু সুস্থ হয়েই। স্হানীয় পীরের দরগায় শিন্নি দিয়েছিলেন।সেই সাথে আরও নানা আয়োজন চলেছিল ধারাবাহিকভাবে।
দারুণ আরাম আয়েশ আর অঢেল বিত্ত বৈভবে আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম। বেশ কয়েক বছর পরে আমার বাবার ব্যবসায়িক সূত্র ধরে আমরা শহরে চলে এলাম। আমরা বলতে আমি আমার চার বোন আর বাবা মা।দাদীজান গ্রামেই রয়ে গেলেন। যদিও তিনি বাবার শহরে চলে আসাকে খুব একটা ভালো ভাবে নিলেন না।সংসারে তখন মায়ের প্রভাব বেড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। আপাত বউ শ্বাশুড়ী যুদ্ধে আমার মা এগিয়ে রই্লেন।তাই শহরমুখী হতে আমাদের তেমন একটা অসুবিধা হলো না। কিন্তু বল দাদীজানের নাগালের বাইরে বলে তিনি শুধু সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। আমার বোনেদের দেখলাম তারা বেশ আনন্দেই আছে তারা আমার মত দাদীজানের জন্য হা হুতাশও করছে না। এর একটাই কারণ দাদীজান মেয়ে সন্তান খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাদের তেমন একটা কাছে ঘেঁষতে দিতেন না।এদিকে আমার দাদীজানের জন্য মন খারাপ হয়ে গেল।কারণ আমার সময়ই কাটতো দাদীজানের পেছনে ঘুরঘুর করে আর সময় সুযোগ পেলে তার সাথে গল্পগুজব হাসি ঠাট্টা করে।
শহরে এসে মা যেন দম ছেড়ে বাঁচলেন। দ্রুতই তিনি দক্ষতার সাথে নিজের সংসার গুছিয়ে নিলেন। বোনেরা নতুন স্কুল নতুন পরিবেশে খুশি মনে পাখা মেলে প্রজাপ্রতির মত উড়তে লাগলো।
আমি দাদী ন্যওটা ঘরকুনো স্বভাবের বলে নতুন বন্ধু জোটাতে পারলাম না। অগত্যা কি আর করা। বোনদের সাথে খেলা আর ঝগড়া মারামারি করে সময় কাটাতে লাগলাম।
কিন্তু আমি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে নতুন একটা সমস্যা তৈরি হলো। মা যেন আমার সাথে কেমন আচরণ করতে লাগলো। বাবাও আমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে লাগলো । এটা করিস কেন? এভাবে করিস কেন? মোটা গলায় কথা বল ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের পরামর্শদাতাও জুটে গেল অনেক। বোনেরা যেন আমার সাথে না মেশে তার জন্য কড়া নিয়মকানুন তৈরি হলো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।
এদিকে আমার স্কুলেও এক সমস্যা হলো কেউ আমাকে খেলতে নেয় না।কেউ আমার পাশে বসতে চায় না।নানারকম অপমানজনক কথা বলে প্রায়।কিছু আমি বুঝি আবার কিছু বুঝি না।সবাই প্রায় আমার নাম বিকৃতি করে ডাকে যা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। কোন কোন শিক্ষকরাও মজা নেয় আমার সাথে। আমি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরি মাকে কিছু বললে মা আরও দুকথা শুনিয়ে দেয়।বাবাও আমার সাথে ভালো করে কথা বলে না। আমার কষ্ট কেউ বোঝে না।
পাড়া প্রতিবেশী ছেলে মেয়ে কেউ কেউ আমাকে দেখে মুখ টিপে হাসে।কেউ কেউ ওয়াক থু করে থুতু ফেলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় নানা অপমানজনক কথা বলে।
আমি বুঝি না চারপাশের মানুষ আমার সাথে এমন কেন করে। কি আমার অপরাধ? এত প্রিয় দাদীজান ,দাদীজানের ওখানে গেলেও তিনিও আমাকে ইদানিং কেন জানি সহ্য করতে পারেন না। তার কাছে গেলেও তিনি বিরক্ত হয়ে আমাকে এড়িয়ে যান। বলেন ব্যস্ত আছি পরে আয়।
তারপর একদিন অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যপারটা কি তারপর ধীরে ধীরে সমস্তটা পরিষ্কার হয়ে এলো আমার কাছে। বাবা আর মায়ের মধ্যে প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হচ্ছে ,
- ও ওরকম হলে আমি কি করবো? আমি কি শিখিয়ে দেই? আমার কি দোষ?
-দোষ তোরই কারণ তোর পেটে ও হয়েছে।
-ও এমন হবে জানলে তো সেই আঁতুড় ঘরেই গলা টিপে মারতাম। বলতাম আমার মরা সন্তান হয়েছে। আমার আর ভালো লাগে না।
- ওরে শুধরাতে বল। এইসব আচরণ আমার বাড়ি চলবে না। আমি সহ্য করবো না।
- কেন ?তুমি বল।তোমারও তো সন্তান। আমি তো অনেক বুঝিয়েছি।ও না শুনলে আমি কি করবো। রোজ রোজ আমার সাথে ঘ্যানঘ্যান করো কেন?
- কিছু করা লাগবে না ও তোর সন্তান আমার না।আমার বক্ত ওর শরীরে নাই। ও নোংরা! ওকে বাড়ি ছাড়তে বল। আর একটা কথাও শুনে রাখ মা আমার জন্য মেয়ে দেখেছে আমি আবার বিয়ে করবো।কালই আমার বিয়ে।
-তুমি আরেকটা বিয়ে করবে?
-হ্যাঁ আমার ছেলে সন্তান চাই্ দরকার হলে আরোও বিয়ে করবো।
-আমি কোর্টে কেস করবো।
-কেস করবি ?দাড়া তোর কেস করা আমি জনমের মত ঘোচাচ্ছি ।এর পরে শুরু হলো মায়ের উপর অকথ্য অত্যাচার । সে যে কি মা’র আমার....।
আমার শরীর কেমন যেন গুলাতে লাগলো।মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে লাগলো।একটা কথা বারবার মনে হতে লাগলো এরা আমার কেউ না,কেউ না,কেউ না। আমি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম যা হয় হোক এত অপমানের পর আর এ বাড়িতে এক মুহুর্ত নয়।
আমি রাতের আঁধারে বাড়ি ছাড়লাম।যদিও মায়ের জন্য আমার মন কেমন করতে লাগলো তবু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।
চলবে
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২২ সকাল ৮:৫৫