শব্দ সংখ্যা ৯৬৭
__________________
মুহিত ছেলেটি আর দশটা বাচ্চার মত না। সে বেশ নরম সরম আর কিছুটা ভীতু স্বভাবের। বরাবরই সে কথা কম বলে, লোকজনের সাথে মিশতেও পারে কম আর সম্ভবত এই কারণে তার বন্ধুবান্ধব খুব একটা নেই।
সারাক্ষণ সে নিজের মনেই থাকে নিজের মত পড়ে,একা একা ঘোরে আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি যেন হিসাব মেলায়।কেউ কেউ তাকে সামনে /আড়ালে ছিটগ্রস্তও বলে।
তবে শ্রেণির পাঠ বা পরীক্ষার ফলাফলে তার অসাধারণ কৃতিত্বের কারণেই সম্ভবত তার জন্য বরাদ্দকৃত পাগল উপাধিটা অধুনা বিলুপ্ত হয়েছে।
সে স্বরুপকাঠি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। অভাবী ঘরের ছেলে আর তাই অযত্নেই বেড়ে ওঠে সে।বাবা দিনমজুরের কাজ করে ,নুন আনতে পান্তা ফুরায় আর সেই কারণে পড়াশোনা করা তাদের মত মানুষের কাছে বিলাসিতার পর্যায়ে পরে।
বাড়ি থেকে স্ব-প্রনোদিত হয়ে কেউ তাকে স্কুলে পাঠায় নি, কোন এক কালে কানাই মাস্টারের হাত ধরে রূপদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসেছিল সে নিতান্ত খেয়ালের বশেই।সেই থেকে স্কুলে যায় আর আসে।স্কুল তার ভালো লাগে শিক্ষকদের কথা শুনতে তার আরও ভালো লাগে।কত কিছু জানা যায় শেখা যায়। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো ছোটবেলা থেকে তাকে যে পাঠ একবার দেখিয়ে দেওয়া হয় সেটা সে খুব ভালো করে মনোযোগ দিয়ে শোনে আর মনে রাখতে চেষ্টা করে ।কোন কিছু সহজে বোঝবার ক্ষমতাও তার অসাধারণ।
গণিত শিক্ষক হারাধন মুখুজ্জে মুহিতকে ছোটবেলা থেকে খুব স্নেহ করেন।তার জহুরি চোখ বলে উপযুক্ত সুযোগ পেলে এই ছেলে অনেক দুর অবধি যাবে।
তার সামর্থ্য নেই তবু তিনি মুহিতের খোঁজ খবর রাখেন।নিজের সাধ্যের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করবার চেষ্টা করেন।
মুহিতের মা নেই সৎ মায়ের সংসারে খেয়ে না খেয়ে নানা দুঃখ কষ্টে মানুষ। সৎ মা চায় এবার পড়াশোনার পাঠ চুকুক।কাজে গেলে ঘরে স্বচ্ছলতা আসবে কিছুটা।তাদের মত সংসারে সেটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।
মুহিত বুঝতে পারে না তার কি করা উচিত। সে শুধু এটুকু বোঝে তার কেবলি অজানা জানতে সাধ হয়,অসীম বিশ্বকে জয় করতে ইচ্ছে হয়। কত শত প্রশ্ন যে মনের মধ্যে নিরন্তর ঘোরে, তার খোঁজ কে রাখে?
এদিকে স্কুলে নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে।কয়েকটি ছেলে মুহিতকে সুযোগ পেলেই বিরক্ত করে ।
ইংরেজি শিক্ষক টোকন জোয়ার্দারের কারণে চেয়ারম্যানের ছেলে রশিদের হিংসার পাত্রে পরিণত হয় মুহিত ।
ঘটনার সূত্রপাত হয় গত গরমের ছুটির পর থেকে।ক্লাসে ইংরেজি পড়া না পারার কারণে টোকন জোয়ার্দার মুহিতকে দিয়ে রশিদের কান মলিয়ে দেয়। সেদিন থেকে রশিদ মুহিতকে শত্রু জ্ঞান করে । রশিদ ও তার সাঙ্গ পাঙ্গ সুযোগ খোঁজে বদলা নেবার জন্য।তারা নানাভাবে মুহিতকে বিরক্ত করে, মজা নেয়। হাসি ঠাট্টা করে গায়ে হাত দেয়।হিজড়া বলে উত্যাক্ত করে ভরা বাজারে ।মুহিত জানে সে ওদের সাথে পারবে না তাই সে চুপ চাপ সব অপমান হজম করে। ছোটবেলা থেকে তার বাবা শিখিয়েছে গরীর মানুষের বেশি তেজ দেখাতে নেই তাতে বিপদ বাড়ে। মুহিত তাই এসব অপমান হজম করে।
এদিকে মুহিত প্রতিদিন বাড়ি থেকে মাইল দেড়েক পথ পায়ে হেঁটে স্কুলে আসে। পথের মধ্যে রহমত নামে এক পাগল তাকে ভীষণ জ্বালাতন করে। মুহিতের ভীষণ ভয় করে রহমতকে।রহমত না-কি মাঝে মাঝে মানুষকে কামড়িয়েও দেয়।সে অবশ্য কোনদিন দেখে নি। লোকে নাকি সেই কারণে রহমতকে মানুষ খেকো পাগল বলে।
সত্যি মিথ্যা সে জানে না তবে এটা সত্যি রহমতের ক্ষুধা লাগলে সে মাঝে মাঝে পাড়া ঘরের হাঁস মুরগী তাড়িয়ে ধরে কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলে।
মুহিত একদিন ভালোবেসে ক্ষুধার্ত রহমতকে একটা বিস্কুট খেতে দিয়েছিল।সেই থেকে এই জ্বালাতন ।হুটহাট কোথেকে দৌড়িয়ে এসে পাগলটি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। দোয়া করার ভঙ্গি করে।
রহমতকে ফাঁকি দেবার জন্য পথ ঘুরে অন্য পথে এলেও সে প্রায় দিনই রহমতের কাছে ধরা পড়ে যায়।
এর মধ্যে স্কুলে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা তারিখ পড়ে যায়।একদিন রশিদ মুহিতের কাছে আসে দোস্ত দোস্ত বলে খাতির করে, মুহিত ও তাতে সাড়া দেয়।মুহিতের ভালো লাগে ঝামেলা মিটে গেছে বলে।দুজনে নানা কথার এক পর্যায়ে রশিদ বলে, আগামীকালের পরীক্ষা মুহিত যেন তার পাশে বসে আর তাকে পরীক্ষায় সাহায্য করে।কিভাবে এই কাজটা মুহিত করবে সে জানে না তবে মুহিতকে এইটুকু উপকার করতেই হবে। এমন অদ্ভুত আবদারের কারন হিসাবে সে জানায়, বড় বোনের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে পড়া লেখা করবার সময় পায় নি গত ক' মাস,সে আসলে ফেল করতে চায় না।ফেল করলে তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে ইত্যাদি। মুহিত মুখে কিছু না বললেও সে পরীক্ষার হলে রাশিদকে সাহায্য করে না,সেটা সম্ভব ছিলও না তার পক্ষে । সে আপন মনে পরীক্ষা দেয়।তাছাড়া কোন প্রকার হঠকারী কাজকে মুহিত কখনও প্রশ্রয় দেয়ও না।সে বরাবরই নিয়ম মেনে চলা মানুষ।
সেদিন বিকালে মুহিতের বাড়ি ফেরার পথে রাশেদ ক্ষিপ্ত হয়ে দলবল নিয়ে আসে মুহিতকে ধোলাই করবে বলে হঠাৎ তার মাথায় অন্য বদমায়েশি বুদ্ধি আসে।পরিকল্পনা বদলায় সে।রশিদ তার পোষা কুকুর লেলিয়ে দেয় মুহিতের দিকে কুকুরের ভয়ে মুহিত প্রাণপনে দৌড়ায়। পালাতে চায় দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে না। ভরা বাজারে ব্যাপারটা সবাই উপভোগ করে।হাততালি দেয়।মজা নেয়।কেউ কেউ ভিডিও করে। ঠিক তখনই রহমত পাগল দৌড়ে এসে মুহিতকে আড়াল করে তাকে বাঁচায়।রহমতের বিচিত্র বেশ দেখে তৎক্ষনাৎ আরও কিছু কুকুর এসে তাকে একযোগে আক্রমণ করে বসে। ভয়ার্ত মুহিত একটা সেলুনের ভিতর গিয়ে লুকায়।কুকুরগুলো রহমতকে কামড়াতে থাকে। একসময় মুহিতের ছোট্ট মনে বিবেকবোধ জেগে ওঠে। সে দুর থেকে কুকুরের সম্মিলিত আক্রমণ ও মানুষের উল্লাস লক্ষ করে।রহমত পাগল বাজারে বড্ড বিরক্ত করে, না বলে এটা সেটা নিয়ে দৌড় মারে প্রায় তার এ হেন পরিস্থিতিতে উপযুক্ত শিক্ষা হচ্ছে বলে আনন্দ লাভ করে বাজারের লোকজন।
এদিকে কিছুটা সুস্থির হলে মুহিতের মন ব্যাথায় ভারাক্রান্ত হয়।যে মানুষটা তার বিপদে এগিয়ে এসেছে তার বিপদে সে ভয়কে জয় করে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।দেরি না করে সেলুনের বাইরে বেরিয়ে আসে।তখন তার হাতে সেলুনের দরজার খিল। সেই খিলকে লাঠি বানিয়ে কুকুরগুলোকে আক্রমণ করে সজোরে । কোথেকে সে সাহস ফিরে পায় , কে জানে? তাকে বাঁচাতে গিয়ে রহমত মারাত্মক আহত এটা সে বুঝতে পেরেছে।কেউ পাগল রহমতকে বাঁচাতে আসবে না এটাও সে বুঝেছে।যা করার তাকেই করতে হবে সেটাও সে বুঝেছে। রহমতকে যে করে হোক বাঁচাতে হবে।কুকুরগুলো বিদায় হলে সে রহমতকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে চায়।নিজের জামা ছিড়ে ক্ষত স্থানগুলো ঢাকতে চেষ্টা করে। কেউ সাহায্যে তাদের এগিয়ে আসে না।সে রহমতের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ।রহমতের রক্ত ক্ষরণ চলতে থাকে ।সময় পার হয় বিকাল পেরিয়ে রাত হয়। রহমত জ্বরে ব্যাথায় কাতরায় কেউ রহমত বা মুহিতের সাহায্যে এগিয়ে আসে না।সময়ের সাথে সাথে যন্ত্রনা বাড়ে।এক সময় প্রবল যন্ত্রণায় রহমত জ্ঞান হারায়।এশার আযানের সময় শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করে সে।মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সে মুহিতের হাত ধরে থাকে। পাগল হলেও সে ভালোবাসা বোঝে।
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক