(১)
সীমা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলো। তারপর ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাফির দিকে তাকিয়ে রাফির খাওয়া দেখতে লাগলো।আজ রাফি এত তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছে কেন?মনে হচ্ছে দেরি করলে...রাফি আসলে খুবই প্রাণবন্ত একটা ছেলে।ওর সাথে সীমার পরিচয় এই রেস্টুরেন্টেই। সেও বছর খানেক আগে।রেস্টুরেন্টটি অবশ্য রাফির বাবার। নতুন জবটা পাবার আগে রাফিই এই রেস্টুডেন্টের দায়িত্বে ছিল।
সীমার হুটহাট রাফিদের এই রেস্টুরেন্টে আসা একদমই পছন্দ না তবু আজকে অনিচ্ছা স্বত্বেও তাকে এখানে আসতে হয়েছে।যেখানে থেকে শুরু সেখানে শেষ হোক। রাফিকে স্পষ্ট কিছু কথা বলা দরকার।এই সম্পর্কের ইতি এখানেই টানতে হবে। না হলে দিন যত যাবে ক্রমশ জটিলতা তত বাড়বে। সীমা ভালো করে জানে রাফি খুব আবেগী ছেলে।এরপর ওকে... ..
খাওয়ার ফাঁকে হঠাৎ সীমার দিকে দৃষ্টি যেতেই রাফি যেন খানিকটা লজ্জা পেল ।চোখাচোখি হতে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল
- সে কি তুমি খাচ্ছো না কেন?কিছু মনে করো না আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছিল।তাই তে অমন....। মনে হচ্ছিল আরেকটু হলের ক্ষিদের জন্য মরে না গেলেও ঠিক অজ্ঞান হয়ে যেতাম ।
কথাটা শুনে সীমার হাসি পেল তবে সে সেটা কৌশলে দমন করলো।
এমনই মজার ছেলে রাফি।তবে এক্ষেত্রে পরিবেশটা হালকা করলে চলবে না।
রাফি আবারও তাগাদা দিলো
-কি হলো বলো তো? নাও শুরু করো।ঠান্ডার দিনে খাবার দ্রুত ঠান্ডা হয় জানো নিশ্চয় ।এরপর আরও কাজ আছে।
সীমা যেন শুনতেই পায় নি সে নিচু স্বরে বলল
- তুমি ভুল করছো রাফি। আমার সম্পর্কে তুমি খুব বেশি জানো না।
- আগেও বলেছি আমি জানতে চাই না।
- আমি অনেকটা ধুতুরা ফুলের মত।আমার স্পর্শ কারো সহ্য হয় না।
রাফি সীমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল
- ফুল তো! ফুল আমি ভালোবাসি। সে যে ফুলই হোক।
- তাহলে তো ব্যপারটা সহজ হয়ে গেল।আমাকে বাদ দাও।নতুন কোন ফুল বেছে নাও।
- এমন অবুঝের মতো করো না'তো।খাবারটা শেষ করো।দারুণ টেস্ট। শোনো আজ তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবো।মা তোমাকে দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। চিন্তা করো না আমি নিজে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো।হবু বউ বলে কথা।আমার একটা দায়িত্ব আছে না? কি বলো?বাইরে যা অবস্থা ভিজতে হবে মনে হচ্ছে। রাফি দূরন্ত আবেগে ফুটছে।
কারো কারো হিসাব কত সহজ অথচ।সীমার মনের ভিতরটা খচখচ করলেও নিজের আবেগ সামলে মুখ শক্ত করে ঠান্ডা গলায় বলল
-আজকের পর আমরা আর দেখা করবো না রাফি। এটাই আমাদের শেষ সাক্ষাৎ।
- কেন এমন করছো? আমি জানি তোমাকে ভালোবেসে আমি কোন ভুল করি নি।আমি নিজের দিক থেকে পুরোপুরি পরিষ্কার। কেন মিছে মিছি নিজের অতীত নিয়ে পড়ে আছো?যা হয়ে গেছে বাদ দাও।নিজেকে তুমি এত ছোট ভাবছো কেন? আমাকে বিশ্বাস করো। তোমার অতীত নিয়ে আমি বিন্দু মাত্র চিন্তিত নই। আমার উপর একটু ভরসা রাখো। আমরা খুব ভালো থাকবো,থাকবোই।প্রমিজ।
-ভালো!
মোমবাতির আলোয় সীমার মুখটা আরও রহস্যময় লাগছিল। বাইরে তখন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।বর্ষার কারণে হয়তো আজ রেস্টুরেন্টে লোকজন কম।চারপাশটা অদ্ভুত শুনশান। পথঘাটেও লোকজন কমে গেছে ।যে যার বাড়ি ফিরছে দ্রুত।
সীমার তাড়া ছিল। সে দ্রুত কথা শেষ করতে চাইছিল।কিন্তু কথাটা এভাবে বলা ঠিক হবে কি-না সে জন্য সে দ্বিধান্বিত ছিল। রাফির নাছোড়বান্দা ভাবের জন্য তার বিরক্ত বাড়ছিল।
রাফি আরেক প্রস্থ খাবার চিবাতে চিবাতে বলল
- কি ব্যপার? আবার মন খারাপ হলো নাকি? তুমি না! পারোও বটে।
সীমা মোবাইলে সময় দেখে নিলো।নাহ!উঠতে হবে।সে শেষ বারের মত বলল
- শোন রাফি তুমি হালকা ভাবে নিলে হবে না। আমি একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই।যদিও কথাটা তোমার ভালো লাগবে না তবু আমি বলতে চাই। তোমার জীবন নিয়ে খেলার কোন অধিকার আমার নেই। যদিও আমি কোন খেলা খেলছি না। তুমিই নাছোড়বান্দা ।আমাকে ভালোবাসো,বিয়ে করতে চাও। দ্যাটস গুড কিন্তু আমি! আমার দিকটা ভেবেছো কখনও? আমার সাথে তুমি এই অসম সম্পর্কে জড়িয়ে একা একা তুমি হয়তো ভালো থাকবে কিন্তু আমি? আমার দিক থেকে তো এভাবে মিথ্যা মিথ্যি ভালো থাকার নাটক করে জীবন বয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। প্লিজ তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।আমি অনেক ভেবেছি । তুমি খুব ভালো মনের একটা ছেলে।ভালো চাকরি করো।বাবার অনেক পয়সা।তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তুমি এক কাজ করো আমার চিন্তা বাদ দাও।জীবনটাকে গুছিয়ে নাও।দেরি হবে হয়তো... কিছু দিন একা থাকো সেও ভালো। বিশ্বাস করো আমি খুব করে চাই ক্ষণিক আবেগের বশে কোন ভুল মানুষ না আসুক তোমার জীবনে।
-সীমা আমি তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি।।প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি।তুমি আমার জীবনে ভুল মানুষ নও।
- কষ্ট পেও না রাফি।বিয়ে সম্পর্কটা কোন ছেলেখেলা নয়।সত্যি বলতে কি আমি তোমাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারবো না। তাছাড়া..
- তাছাড়া কি?
- আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে।
কথাটা সীমা কেন বলল সে নিজেও জানে না কিন্তু কথাটা বলে নিজেকে বেশ হালকা লাগলো তার।
অবশেষে সেই সন্ধ্যায় সীমা রাফিকে ফিরিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল কিন্তু সেই সন্ধ্যার অন্য একটি ঘটনা সীমার বুকে কাটার মতো আজও খচখচ করে বিঁধে। সেই বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার কারণ সে নিজে। এই কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়।কিন্তু সে তো নিরুপায় ছিল ।যদিও সেই দূর্ঘটনায় তার কোন হাত ছিল না।তবু ট্রাকের চাকায় পিষ্ট রাফি তার কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে বারবার ফিরে আসে। কারো কারো জীবনটা বড্ড অগোছালো আর এলোমেলো থাকে কিছুতেই গুছিয়ে ওঠা হয় না। সীমার জীবনটাও তেমনি।
আজ আবারও এই বৃষ্টির দিনে অনেক কথাই মনে পড়ছে সীমার। ঘুমুতে যেতে হবে কাল খুব সকালে ট্রেন। নতুন গন্তব্য হাজিরা দিতে হবে। জীবনটা আজকাল কেমন যেন বড্ড ভারি লাগে।এ জীবন বয়ে নিয়ে বেড়াবার কোন মানে আছে কি?সে কিছুটা দ্বিধান্বিত।
চলবে
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:০৬