somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অভাব স্বভাব ও একটি ক্যাঁচালের গল্প

২৮ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(১)
আজকাল সিঁড়ি ভাঙলে একটুতে হাপিয়ে ওঠে বিজলী।বিশেষ দরকারে বহুদিন পরে রোকেয়া খালাম্মার বাসায় এলো সে।খালাম্মা এতোদিন অবশ্য দেশে ছিলেন না। এই তো দীর্ঘ সফর শেষে গত ক'দিন আগে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন তিনি। বিজলী সুরাইয়ার মায়ের কাছ থেকে খবর পেয়ে আর দেরি করে নি সোজা চলে এসেছে।
কতদিন আগের কথা এই বাসাটা একসময় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল।রোকেয়া বেগমদের অবস্থাও তখন তেমন সুবিধাজনক ছিল না।জালালুদ্দিন বড় চাকরি করলেও ছিলেন প্রচন্ড রকম সৎ। তিন সন্তান সহ পাঁচজনের সংসার তাঁর, সেই সংসারে হুট করে এসে জুটলো স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় বিজলী। সাথে কোলে এগারো মাসের ন্যাদা বাচ্চা পারভীন ।
প্রথমে অবশ্য মানা করে দিয়েছিলো রোকেয়া বেগম কিন্তু বিজলীর আর্তি ছিল একেবারে নিঁখাদ।সৌভাগ্যই বলতেই হবে বহুদ্বার ঘুরে সে আশ্রয়টা জুটাতে পেরেছিল অবশেষে।তখন এ শহরে বাসাবাড়িতে কাজ করে এমন লোকের অভাব ছিল না তার উপর তার কোলে ন্যাদা বাচ্চা।কে দেবে কাজ? স্বামী হারামজাদা তাকে এক কথায় ঘরছাড়া করেছিল। দীর্ঘ অত্যাচার আর সেই সব মারের ব্যাথা এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে বিজলীর।পারভীন পেটে আসতেই হারামিটা মাসুমার কচি মেয়ের প্রেমে মজেছিল নতুন করে।যা হবার তাই হলো।বিজলী তবু মানিয়ে নিতে চেয়েছিল তবু..... এদিকে সংসার ভাঙা মেয়েকে কে দেবে আশ্রয়?
যাহোক একটা কাজ জুটলো বটে কিন্তু একদিনের একটা ঘটনার কারণে বাসার ভিতরে পারভীনের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল।মেয়েটার পেটের রোগ ছিল।ড্রয়িং রুমের কার্পেট জুড়ে মল ত্যাগ করেছিল পারভীন । অন্য মানুষ হলে তাড়িয়েই দিতো নিশ্চিত কিন্তু জালালুদ্দিন আর তার স্ত্রী রোকেয়া বরাবরই নরম মনের মানুষ। বিকল্প এক প্রস্তাবে দুটো ভাতের নিশ্চয়তার জন্য নিজের সন্তানকে গ্যারেজ ঘরে রশি দিয়ে বেধে উপরতলায় কাজে যেতে রাজী হলো সে। ভাতের খিদে বড় খিদে!এক পেট হলেও কথা ছিল এখন তো দু দুটো পেট তার উপর সামনে শীতকাল।কোন রাস্তায় ঠাই নেবে সে?
রোকেয়া বেগম কখনোই নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ নন তিনি বিজলীকে মাঝে মাঝে পারভীনকে দেখে আসবার অনুমতি দিতেন।কখনও কখনও নিজেও এসে দেখে যেতেন।পারভীনও আর তেমন জ্বালাতো না তবুও এমন পরিস্থিতিতে নিজের সন্তান সাথে মাহবুবেরা তিন ভাই বোন আর ঘর গৃহস্থালির হাজারটা কাজ সব একা হাতে সামলাতে বিজলীর জীবন বেরিয়ে যাবার জোগাড় হতো। সে একরকম মাটি কামড়ে দাঁতে দাঁত চেপে কাজগুলো মনোযোগ দিয়ে ই করতো,এ ছাড়া আর উপায়ই ? এ পৃথিবীতে গরীবের জন্য কেউ নেই।
দিন সে তো বসে থাকে না।সময়ের আবর্তে রোকেয়া বেগমের বড় ছেলে বিদেশে পড়তে গেলে ওদের বড়মামার সহযোগিতায় অন্য দুই ভাই বোনও পাড়ি জমায় সেদেশে অবস্থা ঘোরে খুবই দ্রুতই। আসলে মাহবুব ছিল দারুণ মেধাবী। তাই সাফল্য আসতে দেরি লাগে না এ পরিবারটিতে।
এদিকে বিজলীর মেয়েটি তখন সবে পনেরোতে পড়েছে। সোমত্ত মেয়ে সেও এক দুশ্চিন্তার কারণ। তবে রোকেয়া বেগমের সহযোগিতায় বেশ ভালোই বিয়ে দেয় সে পারভীনকে।তার নিজের জীবন সুখী না হলে মেয়ে সুখে আছে এতেই সে খুশি হয়।সেই ঘরে একটা নাতনিও আছে।সে আবার বিজলীর ভীষণ ন্যাওটা। তার আবার একটা গাল ভরা নাম আছে, নামটা হলো সজিনা।এই নামটা অবশ্য বিজলীই দেয়া।
এভাবেই দোষে গুনে কাটছিল দিন তবে ইদানীং হাত বেশ টানাটানি যাচ্ছে বিজলীর।আজকাল বয়সের কারণে কেউ তাকে কাজেও নিতে চায় না।এই বয়সে অভাব বড় ভয়ংকর সেই সাথে শরীরও আর কথা শুনতে চায় না আগের মত। তাই নিতান্ত বাধ্য হয়ে একটু মিথ্যে সত্যি গল্প বানায় সে।বিদেশ ফেরত খালাম্মাও চোখের পানিতে মিথ্যা ক্যান্সার হবার সম্ভাবনার গল্পটা বিশ্বাসও করে। বিজলীকে চিন্তা করতে মানা করেন তিনি।সেল ফোন নাম্বার বিনিময় করতে ভোলে না বিজলী। এদিকে এত সহজে টাকাপয়সার হাতে আসতে বিজলী বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। উৎফুল্ল হবার আরও একটা কারণ পারভীনের মেয়ে সজিনাকেও নিরাশ করে না রোকেয়া বেগম।
(২)
কাজ সারা হয়ে গেলে সে ও সজিনা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়।টাউন হল মার্কেটের পিছনে রাস্তা পার হতে হতে এক অন্ধ ভিখারী করুন আর্তিতে বিজলীর মনটা হঠাৎ নরম হয়ে ওঠে। আহা লোকটার কত না দুঃখ,এর চেয়ে সে বরং ভালোই আছে।আল্লাহ তাকে ভালো রেখেছে । সে সজিনার হাত ধরে এগিয়ে যায় এবং ভিক্ষা দেবার আগমুহূর্তে ভীষণ রকম চমকে ওঠে। স্বগোতক্তি করে
-জব্বার না,ও এখানে কি করে? আর ও অন্ধ হলো কবে থেকে? জব্বারের কোনদিকে কোন খেয়াল সে একমনে সুরে সুরে ভিক্ষা চাইছে
"দীন দুঃখী জন্ম অন্ধ আমার নাই সহায়
পাচটা টাকা দ্যান গো ভাইজান আমি নিরুপায়।"
মূলত জন্ম অন্ধ কথাটা শুনে বিজলীর হাসি পায় মিথ্যাবাদী একটা হঠাৎ ই তার সহানুভূতি উধাও হয়ে যায়। এক জীবনে এই ভন্ড মিথ্যাবাদী চোখবোজা চশমখোরকে ধান্দাবাজকে তার মতো আর কেউ চেনে না।কতদিন ইচ্ছে হয়েছে এরে একটা শিক্ষা দেয় কিন্তু বুদ্ধি আর শক্তিতে সে কখনোই পেরে ওঠেনি।
হঠাৎ তার বুকের ভিতর জেগে ওঠে প্রতিশোধের আগুন।একসময় লোকটা তাকে হাতে ভাতে পানিতে মারতে চেয়েছে আজ সে সামান্য হলেও প্রতিশোধ নেবে। ওর এই দুই নম্বরী ব্যবসার বারোটা বাজাবে।জন্ম অন্ধর অন্ধত্ব ঘুচাবে।
পরিকল্পনা মত সে কাছের আলুপুরি সিঙারার দোকানে সজিনাকে নাশতা করতে বসিয়ে আবার খুব দ্রুত ফিরে আসে জব্বারের কাছে। খুব খেয়াল করে লক্ষ করে নিশ্চিত হয়। তারপর সে পাঁচ টাকার একটা কয়েন ছুড়ে মারে থালায়। বেশ জোরেই ঘোষণা করে।
-আহারে রোদ্রে তোমার কত বা কষ্ট! একটু ছায়া দেখে বসাতে পারো নাই। এইখানে কেডায় বসায়ছে তোমারে? কে আছে তোমার সাথে? কেউ নাই আহা!
তারপর অবস্থা বুঝে পিছন ঘুরে সজোরে এক লাথি কষে জব্বারের পিঠ বরাবর ।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় জব্বার হুমড়ি খেয়ে পড়ে দারুণ আক্রোশে তেড়ে আসে।স্বভাবতই মুখ পরিচিত দোকানি হকাররা অবাক হয় অন্ধ ফকির আর অনাকাঙ্ক্ষিত মহিলা আগন্তুকের কান্ড দেখে।
দাঁত মুখ খিঁচিয়ে জব্বার বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলে
- এই কেডা তুই রে
- চেনো নাই অহনো? ভালো কইরা দেহো, চিনছো
- হারামজাদী মরোস নাই অহন তরী?
-মরণ অত সহজ? আমারে তাইলে চিনবার পারছোস?কাম ধান্দা তো ভালো ই জমাইছোস।
-চিনুম না আবার আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।তুই আমারে... তোর তো সাহস কম না। তুই আমার গায়ে হাত তুলছোস। আমার রুটি রুজু র উপরে হাত তুলছোস
ততক্ষণে ভীড় জমে গেছে মহা জোশে বিজলী গগন বিদারী কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে
- তুই না জন্ম অন্ধ। চোখে দেখোস কেমতে?শালা ধান্দাবাজ।আজ ধরা খাইছো।
হঠাৎ কেমন চুপসে যায় জব্বার।অন্য দিকে জব্বারের সঙ্গী দুজন দুর থেকে বিপদের সম্ভাবনা দেখে কাছে ভেড়ে না।যা হয় পরে দেখা যাবে।
ভীড়ের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে।বিজলী পরিকল্পনা সফলতা পায়।সে বিজয়ীর হাসি হেসে বলে
-এই ব্যাডা এক নম্বর টাউট।...আমি ওরে হাড়ে হাড়ে চিনি।
হালার পো অহন জন্ম অন্ধ সাইজ্যা ভিক্ষা চায়।....
ফিরবার আগে ভিক্ষার থালা থেকে একমুঠো টাকা ওপয়সা কুড়িয়ে নিতে ভোলে না সে।ক'দিন ধরে নাতনিটা বড্ড গোস্তো খাবো গোস্ত খাবো করছে।
নাশতার বিল মিটিয়ে নাতির হাত ধরে মাছ মাংসের বাজারের দিকে জোর কদমে হাটে বিজলী। নাহ! বড্ড বেলা হয়ে গেল আজ।তবে মনটা আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে।আসলে দিন সারাজীবন সবার একরকম যায় না । আর যাই হোক লাথিটা কিন্তু সেই রকম ছিল....
© রফিকুল ইসলাম ইসিয়াক

কৈফিয়তঃ নাটকের রিহার্সেল আর কবিতা আবৃত্তি নিয়ে ভীষণ রকম ব্যস্ততার কারণে আমার আগের তিন চারটি পোস্টের প্রতি মন্তব্যে আসতে পারিনি বলে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।আশা করি বিষয়টি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।আপনাদের ভালোবাসা আমার চলার পথের পাথেয়। সবার জন্য শুভকামনা রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১০:৫৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাদ্রাসা শিক্ষা, বৈশ্বিক রাজনীতি, সহিংসতা ও জঙ্গিবাদ

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৫


লেখাটির শুরুতে একটি ভূমিকা দেওয়া যাক। সর্বশেষ দেশে গিয়ে কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। উত্তরবঙ্গে, নিতান্ত অনুন্নত আমাদের সেই গ্রামে এতগুলো কওমি মাদ্রাসা হয়েছে দেখে অবাক হয়েছিলাম। আগে গ্রামে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চোখের জল

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪৬


সুদীর্ঘ ১৭ বছরের জমে থাকা
বিনম্র চোখের এক কোণে জল!
প্রকাশে এলো এই জনসমুদ্রে-
জনসমুদ্র তুলছে আনন্দাশ্রুর
ঢেউ- দেখছে নতুন ফুলের গন্ধ;
এ নৈঃশব্দের আর্তনাদ বুঝতে
হবে শুধু তোমাকে- আমাকে
গড়ে তুলতে হবে মনুষ্যের প্রণয়ে
সূর্য ভোর- যেখানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকার মানুষের জীবন

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪


ঢাকাতে মানুষ বড় বিচিত্র ভাবে বেঁচে থাকে। নিয়মিত ঢাকার রাস্তার ঘুরে বেড়ানোর কারণে এই রকম অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে মনে হয় মানুষ কত ভাবেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে প্রায় সারা বছর বৃষ্টিপাতের কারণ কী?

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯

পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে প্রায় সারা বছর বৃষ্টিপাতের কারণ কী?



পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে প্রায় সারা বছরই বৃষ্টিপাত হয়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার কিছু দেশ এবং দক্ষিন আমেরিকার কিছু দেশ ও অঞ্চলে বছরের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ কখনো এমন করে বলতে পেরেছে কি?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


ভারতে গরু ও গোমাংস নিয়ে হত্যা বা সহিংসতার নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন কারণ এটি রাজ্য, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং 'গরু রক্ষা' বাহিনী ইত্যাদীর কারণে একেক যায়গাতে একেক রকম। ভারত গোমাংস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×