somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার প্রিয় বাংলাদেশ

২৫ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার প্রিয় বাংলাদেশ
" এবার আমায় গ্রহণ করো ‘বাংলাদেশ’---
বর্ণমালার রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে চেয়ে।
আমি পথহারা এক তৃষ্ণার্ত পথিক।
উদাসী মাঝির ডাক পদ্মার ওপার থেকে—
সোজোনবেদিয়ার ঘাটে,নক্সীকাঁথার মাঠে, জসীমউদ্দিন
রূপসী বাংলার জীবনানন্দ।
আমার দীর্ঘশ্বাস হয়ে ওঠে,মেঘনার সর্বনাশা ঝড়---
আজ তোমার-আমার মাঝে অলঙ্ঘ্য সীমারেখা!
আমায় গ্রহণ করো বাংলাদেশ--- এখানে আমি বাকরূদ্ধ,শ্বাসরূদ্ধ!
বিবর্তনের পালায় বঙ্গাংশ-বিহার-উড়িষ্যা সীমায়িত,
ধূমায়িত উত্তর,ক্ষয়িষ্ণু দক্ষিণ অরণ্যশোভা।
সুদূর দ্বীপান্তর হয়তো আমার শেষ ঠিকানা!
এবার আমায় গ্রহন করো বাংলাদেশ---
যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে দিশাহীন,বর্ণদূষণ বাংলা সেখানে নিরুত্তাপ।
কখনো ঋষি বঙ্কিম ভেসে আসে উন্মত্ত সাগর প্রবাহে---
‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ!’
রবীন্দ্র-বাণী--‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ!’
দুরন্ত কালবোশেখী ঝড়ে কবি নজরুলের
‘পথহারা পাখি,কেঁদে ফেরে একা!’
এবার আমায় আশ্রয় দাও ‘বাংলাদেশ’
আমার প্রিয় ‘বাংলাদেশ’!!"
...সময়টা ২০০৮-এ জানুয়ারীর ২৯।বাংলাদেশ ডেপুটি কমিশনারস্ অফিস কলকাতা থেকে একমাসের জন্য বাংলাদেশ পরিভ্রমণের অনুমতি পাওয়া গেল। ৩১ শে জানুয়ারি কলকাতা থেকে ঢাকার রাজপথে শুভযাত্রা।লাল সবুজে মেশানো টিকিটের গায়ে ‘শ্যামলী পরিবহন’ লেখাটি দেখে মনটা কেমন ক’রে উঠলো!রবীন্দ্রনাথের ৭৪তম জন্মদিনে শেষ গৃহপ্রবেশ ‘শ্যামলী’-র কথা মনে প’ড়ে গেল।কবির কথায়:- ‘আমার শেষ বেলাকার ঘরখানি বানিয়ে রেখে যাব মাটিতে তার নাম দেবো শ্যামলী।‌’ বাসস্ট্যান্ডে আসতেই চোখে পড়লো লাল সবুজে মেশানো রঙের সুদর্শণা একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।বুঝতে দেরি হ’লনা এই সেই শ্যামলী,আজ সে যেন চলমান শ্যামলী,আমাদের দীর্ঘ পথযাত্রার সঙ্গী।নির্ধারিত সময়ে ‘শ্যামলী’ আমাদের নিয়ে চললো,কলকাতার কোলাহল থেকে দূরের পথে।বেনাপোল-এ কেনাকাটার ভিড়।অর্থের বদলে কিছুটা অর্থদন্ড হলেও,অর্থ-দালালদের মুখোজ্জ্বল করতে পারার একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দানুভব করলাম।আমরা সবাই তো অর্থমুখী!কতকগুলি ভিখারিকে হাত পাততে দেখলাম।আন্দামানে দীর্ঘদিন থাকার সুবাদে ভিখারি-সমস্যার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলাম!এখন বহু পুরনো স্মৃতি আবার যেন তরতাজা হয়ে উঠল।আরে এটাই তো সেই বাংলা,এই তো সেই বাংলার মুখ।এইসব মানুষের মলিন মুখেই তো ফুটে ওঠে সোনার বাংলার করুণ ইতিহাস!....এসব ভাবতে ভাবতেই সহযাত্রী বন্ধু তাড়া করলে: ‘এরকম ধীরগতিসম্পন্ন হলে সুরক্ষিত সীমান্ত-রেখা যে পেরোতে পারবেন না,তা ভেবেছেন কি?’কবি-বন্ধুর কথা অস্বীকার করার উপায় নেই!সত্যিই সে দুর্বলতা আমার আছে!অপরদিকে দ্বিতীয় সহযাত্রী অশীতিপর সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় শ্রী দ্বীজেন্দ্র কিশোর বিশ্বাস(কবি-বন্ধুর জ্যাঠামশাই,নিশিকান্ত বিশ্বাস সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত) প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যেও সক্রিয়!সীমান্ত-দাপ্তরিক কাজ শেষ ক’রে আবার শ্যামলী-র নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়লাম।যশোর রোডের দুপাশে সোনালি-সবুজের দৃশ্য মন ভুলিয়ে দেয়।দূরে যে দিকে তাকাই,প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য চোখে পড়ে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।কবি নজরুলের ভাষায়:- ‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী। ফুলে ও ফসলে কাদামাটি জলে ঝলমল করে লাবণী।।‌’ মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ প’ড়ে বুঝিনি তখনো পদ্মার রূপ কী মোহময়ী হতে পারে।নজরুল গীতি ‘পদ্মার ঢেউরে!মোর শূন্য হৃদয়পদ্ম নিয়ে যা,যা রে’কতবার শুনেছি,মনে মনে পদ্মার ছবি এঁকেছি।আজ আমার দুচোখে পদ্মার রূপ দেখে বিস্ময় শুধু নয়,লোকসঙ্গীতের কথায়—‘আমায় ভাসাইলি রে,আমায় ডুবাইলি রে/অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে!’ বাংলাদেশ-রাজধানি ঢাকা।রাত প্রায় আটটা।জাতীয় নাট্যশালার ‘রোকন জহুর’ আমাদের স্বাগত জানালেন।অতিথি আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি আমাদের চোখে পড়ল না।আধো ঘুমে রাত কাটল।ত্রস্তগতিতে প্রাত:কালিন প্রস্তুতি,১লা ফেব্রুয়ারি।গন্তব্য ঐতিহাসিক ‘রমণা প্রাঙ্গণ’। ‘বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা পরিষদ’-আয়োজিত কবিতা উৎসব। নির্ধারিত কর্মসূচি অনুসারে বাংলাদেশ-জাতীয়কবি নজরুল ইসলামের সমাধিদর্শণ,শহীদবেদী সমাগম,অবশেষে কবিতা-মঞ্চে আগমন।শুরুতেই প্রথিতযশা শিল্পীসহ অগণিত মানুষের কন্ঠে শোনা গেল অমর শহীদদের উদ্দেশে আব্দুল গফফার চৌধুরীর লেখা সে গান: ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি কি ভুলিতে পারি!’ এবং জাতীয় সঙ্গীত: ‘আমার সোনার বাংলা’।গান দুটি শুনে আমার হৃদয়ে এক অস্বাভাবিক শিহরণ জাগে।এই গান দুটি শুধু বাংলাদেশের নয়,সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণ সে কথা এক নিমেষেই মনে হ’ল! শুরু হ’ল আমন্ত্রিত কবিদের সম্মান-প্রদর্শণ পর্ব।সূচীবদ্ধ কবিদের আমি একজন না হয়েও অন্যান্যদের মতো আমাকেও পুষ্পস্তবক দিয়ে যেভাবে সম্মানিত করা হয়েছিল,তাতে আমি অভিভূত না হয়ে পারিনি।আলাপ হ’ল জনপ্রিয় কবি সমুদ্রগুপ্ত-র(আব্দুল মান্নান)সঙ্গে,কবি আসাদ চৌধুরি,কবি আসলাম সানীসহ অনেক গুণী মানুষদের সাহচর্যে কবিতা উৎসব প্রাঙ্গণ আনন্দমুখর হয়ে উঠল।কী নিবিড় সখ্যতা,কী বিস্ময়কর অভিনন্দন ভাল কবির জন্য,কবিতার জন্য।কবিতা যে সত্যিই জীবনের ভাষা,সাধারণ মানুষের ভাষা সেদিন প্রতি মূহুর্তেই মনে হচ্ছিল।সারাদিনের কবিতা-সংগ্রাম শেষে বাসায় ফেরা।ডায়েরির পাতায় লিখে রাখলাম অব্যক্ত উচ্চারণ: ‘যাহা দেখিলাম,যাহা শুনিলাম—জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না’। পরের দিন ২রা ফেব্রুয়ারি আবার ‘কবিতা-মঞ্চ’-র ডাক।সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা।মঞ্চে তখনও অবিরাম বিস্ময়কর বাণী-প্রবাহের প্রাবল্য! রাত্রি প্রথম প্রহরের পুণ্যলগ্ন।ভারতীয় কবিদের সারিতে প্রতীক্ষমান আমিও।আন্দামান থেকে কবি অনাদিরঞ্জনের কবিতা ‘বাংলা মানে’ আর রইসউদ্দিনের ‘আমার প্রিয় বাংলাদেশ’ কবিতায় হয়তো বা আমাদের অজান্তে মন ছুঁয়েছে কারও।তাই বোধ হয় শ্রদ্ধা আর ভালবাসার খামতি কোথাও ছিল না।আমাদের কবিতা ভাল লাগুক বা না লাগুক,কাব্যপ্রাণ মানুষদের যে ছোঁয়া আমরা পেয়েছি,তা’পরশপাথরের ছোঁয়া বললে অত্যুক্তি হবে না।বাংলাদেশের কবিপ্রেমে আমার উদাসী মন কখন কবি হয়ে গেল জানি না। বই মেলায় কবি জসীমউদ্দিন-পুত্রের পুস্তকবিপণী থেকে ‘নকসী কাঁথার মাঠ’,সোজন বেদিয়ার ঘাট, শুধু নয়—জসীমউদ্দিনের ‘জীবনকথা’-র হানিফ মোল্লা,যাদব ঢুলি,কবিগান,মধু পন্ডিত,চৈত্র-পূজা,সন্ন্যাসী ঠাকুর সবাইকে পেয়েছি একসাথে—এ আমার কম সৌভাগ্যের নয়। জীবনদেবতা বোধ হয় বাধ সাধলো তৃতীয় দিনের প্রারম্ভে।স্মৃতিরোমন্থনের আনন্দানুভূতি যখন চরম শিখরে হৃদ্-যমুনায় উথাল-পাথাল অস্বাভাবিক শব্দ-দ্বন্দ্ব;অকস্মাৎ দুচোখে ঘনঘোর অন্ধকার।আর সেটাই নাকি হার্ট-অ্যাটাক!হৃদয় বিশেষজ্ঞ-র স্থির সিদ্ধান্ত--- ‘অস্ত্রোপচার’।আমার মন-বিশেষজ্ঞ মেনে নিতে পারল না।তাই মনমাঝি বৈঠা হাতে ডাক দিলেন—‘ফিরে চলো,ফিরে চলো পান্থ’।অগত্যা ফিরে এলাম এপারে।ফেরার পথে বার বার মনে পড়ছিল ফেলে আসা বাংলাদেশে থাকা ক’দিনের স্মৃতিচিত্র।অসুস্থ-অবস্থায় বাংলাদেশ সীমান্তে এসে অস্ফুট স্বরে শুধু বলতে পেরেছিলাম কয়েকটি কথা: ‘বিদায়! আমার প্রিয় বাংলাদেশ,বিদায়!!’
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×