অফিসে বসে বসের দেওয়া ফাইলটা রেডি করছিলাম।এমন সময়ে রাবেয়ার ফোন।গ্রাম থেকে আমার এক স্কুল লাইফের বন্ধু আনিস এসেছে আমার সাথে দেখা করতে।আমি কল কেটে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফাইলটা রেডি করে বসের রুমে দিতে গেলাম।স্যার ফাইলটা দেখে রেখে দিয়েই বললেন,আশফাঁক সাহেব কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতে পারি?
-অবশ্যই স্যার
-গতকাল দেখলাম আপনার ডাস্টবক্সে অনেকগুলো সাদা কাগজ,যেগুলো একবারও ব্যবহার করা হয় নি।আপনি কি সেগুলো কোন কাজেই ব্যবহার করতে পারতেন না?
-স্যার সেগুলো ব্যবহার করতে পারি এমন কাজ অফিসে তো নেই
-নেই বললে ভুল হবে আশফাক সাহেব।তাছাড়া আপনি আপনার পার্সোনাল লাইফে অনেক কাজে এসব ইউজ করতে পারেন
-যেমন স্যার?
-ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন খেলনা তৈরিও করে দিতে পারেন
-ঠিক আছে স্যার
-কাগজ আমাদের বন্ধু,এরা আমাদের স্মৃতি জুড়ে থাকে।কত না হারানো সুখের গল্প...
আমার বসের কথা থেমে গেল।মানুষটা বয়সে আমার চেয়ে বছর সাত আট ছোট হলেও কি হবে অনেক সৌখিন আর স্মৃতিকাতর।প্রতিদিন একবার না একবার হলেও তিনি তাঁর অতীত জীবনের গল্প আমার সাথে শেয়ার করবেনই।আমিও জীবনের চুয়ান্নটা বছর পার করে এখন তাঁর গল্প শুনে সময়গুলো উপভোগ করি।
বসকে চুপ করে থাকতে দেখে বললাম,স্যার যদি কিছু মনে না করেন তবে আজকে আর শুনবো না।বাসায় এক স্কুল লাইফের বন্ধু এসেছে দেখা করতে।
-ওকে ওকে আশফাক সাহেব আপনি এখুনি বেরিয়ে পড়ুন
-থ্যাংকু স্যার
বসের কাছে বিদায় নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে সিএনজিতে উঠলাম।ঢাকা শহরের নিত্যদিনের জ্যাম কাটিয়ে সিএনজি ছুটে চলেছে বাসার উদ্দেশ্যে।পাশের ছিটে রাখা ব্যাগটা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছি।আজকে আসার সময় ডাস্টবক্সের অনেকগুলো সাদা অব্যবহৃত কাগজ ঢুকিয়ে নিয়েছি।আমার সমস্ত চিন্তায় এখন ঐ সাদা কাগজগুলো।আসলেই কি এসব আমাদের জীবনের সাথে অতোপ্রতভাবে জড়িত?আসলেই কি অনেক সুখের গল্প আছে এসব কাগজকে নিয়ে?আমি ভাবতে লাগলাম।পুরনো স্মৃতি হাতড়িয়ে এসব নিয়ে কিছু সুখের গল্প পাওয়া যায় কিনা তাই শুধু খুঁজতে লাগলাম।
টিনের ছাদ,টিনের দেয়াল,টিনের জানালা,সামনে কাঠের উপর কালো কালির প্রলেপ লাগানো ছোট্ট একটা ব্ল্যাকবোর্ড।বন্ধুরা সবাই মিলে হইচই করছে।আমি একটা বই নিয়ে বসে বসে পড়ছি।সামনে পরীক্ষা,তাই ক্লাসে বসেও বই নিয়ে ঘাটাঘাটি করি আজকাল।হঠাত কোথা থেকে একটা দমড়ানো মুচড়ানো কাগজ আমার শরীরে এসে পড়লো।বুঝলাম কেউ ইচ্ছে করেই কাজটা করেছে।আমি কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে মেলে ধরলাম।সেখানে কালো কালিতে লেখা,এত লেখাপড়া করে কি হবে?আয় চোর পুলিশ খেলি।লেখাটা পড়েই বুঝলাম কাজটা কার।পেছন ফিরে তাকাতেই আনিস তার হলুদ দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগলো।
আমি কাগজটার উল্টো পিঠে কলম দিয়ে লিখলাম,না খেলবো না।এখনো অনেক পড়া বাকি আছে।তারপর সেটা মুচড়িয়ে ছুড়ে দিলাম আনিসের দিকে।কিছুক্ষন পর আরেকটা কাগজ এসে পড়লো ঠিক আমার মাথার নিচে।এবার বেশ জোরেশোরেই ছোড়া হয়েছে সেটা আমার মাথা লক্ষ করে।আমি কাগজটা খুলে দেখলাম লেখা আছে,এত পড়ে কি হবি রে?ইঞ্জিনিয়ার,সাহেব?তখন আমাদের মনে রাখবি তো?আমি কিন্তু গ্রামেই থেকে যাব।তাই লেখাপড়া করছি না।
আমি আবার কাগজের উল্টো পিঠে লিখতে শুরু করলাম।এভাবেই চলতে থাকে আমাদের কাগজালাপ।মনের কথা গুলো কাগজে লিখে এক অন্য ধরনের আনন্দ পেতাম তখন।অথচ প্রতি ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে দূরত্ব থাকতো খুব বেশি হলেও সাত কি আট হাত।ইচ্ছে করলেই কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করা যেত।কিন্তু আমরা করি নি।কাগজালাপে যে আনন্দ পাওয়া যায় তা পাশাপাশি কথা বলে কোনদিন পাই নি বলেই হয়তবা।
আনিসের সাথে যোগাযোগ হয় না অনেকদিন।সে কম করে হলেও বছর পচিশেক তো হবেই।সেই যে কলেজ লাইফে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একবার দেখা হয়েছিল তারপর আর দেখা হয় নি।দারিদ্রতার কারনে আনিসের লেখাপড়া স্কুল লাইফেই শেষ হয়ে যায়।সেদিন যখন দেখা হল দেখলাম কাদা মাখা শরীর নিয়ে ক্ষেতবাড়ি থেকে ফিরছে।আমাকে দেখেই হাসি হাসি মুখ করে ইশারায় কিছু একটা জানতে চাইলো।কিছুক্ষন পরে বুঝলাম,সে আমার কাছে কাগজ আছে কিনা তা জিজ্ঞেস করছে।আমি আমার ব্যাগ থেকে একটা সাদা কাগজ আর কলম বের করে দিতেই সে তাঁর কাদা মাখা কাপড়ের মধ্যেই শুকনো জায়গাতে হাত মুছে নিয়ে সেগুলো নিল।তারপর কলম দিয়ে খসখস করে কাগজে কিছু লিখলো।তারপর সেটা আমার দিকে ছুড়ে দিল।আমি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম তাতে লেখা,আশফাক কেমন আছিস?অনেক শুকিয়ে গেছিস রে।আমি পড়ে হাসলাম।তারপর আমিও কাগজের উল্টো দিকে লিখতে লাগলাম...
স্যার এসে পড়ছি।সিএনজিওয়ালার ডাকে ফিরে আসলাম বাস্তবে।আসলে পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই কখন যে বাসার কাছে এসে পৌঁছেছি তা টেরও পাই নি।তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে বাসায় ঢুকে গেলাম।রাবেয়া আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো।কিন্তু তাঁর কথা না শুনে আমি ব্যাগটা নিয়েই আমি হত্নদন্ত হয়ে ড্রয়িং রুমে গেলাম।দেখলাম আনিস বসে আছে।আমাকে দেখেই তাঁর মলিন চেহারায় হাসি ফুটে উঠলো।বললাম,আনিস কেমন আছিস?
সে কিছু বলল না।ইশারায় কিছু একটা চাইছে।ইশারা বুঝতে পেরে রাবেয়াকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।কিন্তু তার আগেই মনে পড়লো আমার ব্যাগে কাগজ থাকার কথা।একটা সাদা কাগজ বের করে সেখানে কলম দিয়ে লিখলাম,কেমন আছিস আনিস?লিখেই ছুড়ে দিলাম আনিসের দিকে।অথচ আনিস আর আমার মধ্যে দূরত্ব এক হাতের চেয়েও কম।
আনিস আমার ছুড়ে দেওয়া কাগজটা পড়ার পর খচখচ করে কিছু একটা লিখলো।তারপর আমার দিকে ছুড়ে দিল।আমি সেটা নিয়ে মেলে ধরলাম।পড়েই হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম।দরজার দিকে তাকাতেই দেখি রাবেয়া আড়াল হয়ে আমাদের দুই বন্ধুর কাগজালাপ খেলা দেখছে আর হাসছে।আনিসের দিকে তাকাতে দেখে দেখি সেও হাসছে।কিন্তু আমি হাসতে পারলাম না।কাগজালাপ খেলাটা কেন জানি এখন আমার কাছে নিষ্ঠুর একটা খেলা মনে হচ্ছে।
আমি আনিসের ছুড়ে দেওয়া কাগজটায় লেখা আনিসের লেখাগুলো আবার পড়লাম,ভালো রে।তুই?জানিস গত বছর থেকে আমি আর কথা বলতে পারি না।এখন তাই ইচ্ছেমত কাগজালাপ খেলা খেলি।হা হা হা