২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নতুন বাসায় উঠার পর থেকেই মোটামুটি নিয়মিতভাবে বাসার একদম কাছের একটি দোকান থেকে সংসারের জন্য মুরগি কিনি। দোকানদার হাসিমুখের সুদর্শন এক যুবক, বয়স আমার চেয়ে ৮/১০ বছরের কম হবে বলে অনুমান করতে পারি। গড়নে ও চাহনিতে তিনি যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববান বলে প্রতীয়মান হয়। তার হাসিমাখা, খোলামেলা ও বিশ্বস্ত ব্যবহারের কারণে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্য কেনা-কাটার জন্য প্রায় নির্ধারিত কিছু দোকানদারের মধ্যে তিনি আমার অন্যতম পছন্দের। দোকানে গেলে অন্য সব কাজ থামিয়ে আমার দিকে তার এ্যাটেনশন দেয়া এবং কেমন আছি সহাস্যে তা জিজ্ঞেস করার ধরনটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য লালন করে। তার দোকানের সামনে দিয়ে অন্য কোন কিছু কিনতে গেলেও তার শুভেচ্ছা বিনিময়ের জাল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া দোকানে গেলে ‘মুরগির দাম বাড়তি’ এমন শ্লোগান শুনতে শুনতে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেলেও বেচারা মনে হয় আমার কাছ থেকে ন্যায্য বাজার মূল্যই রাখে।
লোকটি বরাবরই আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করলেও স্মৃতির সবটুকু আয়োজন উজাড় করে দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে, তার সামনে কোনদিন আমার পেশাগত পরিচয় উচ্চারণের প্রয়োজন হয়নি, তাই কোনদিন করাও হয়নি। কারণ, অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত প্রেক্ষাপটে নিজের পেশাগত পরিচয় উপস্থাপন আমার একবারেই স্বভাববিরুদ্ধ।
যাই হোক, গত শুক্রবার তার দোকানে গিয়েছিলাম ১ হালি ছোট সাইজের দেশি মুরগি কিনতে। স্বভাবসুলভ হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় ও ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর তার সহকারি ছেলেটাকে মুরগি প্রসেসিং এর কাজ বুঝিয়ে দিলেন। এরপর তার বসার টুলটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে সম্মানের সাথে বললেন, “বসেন”। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, ওকে অসুবিধা নেই, বসা লাগবে না। লক্ষ্য করলাম ৮/১০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার অপর প্রান্তে তার মুখোমুখি অবস্থিত দোকানদার ছেলেটির সাথে কোন একটি বিষয় নিয়ে তাদের মৃদু বাক-বিত-া চলছে। হাতে কাজ থাকলে দুজনই থেমে যাচ্ছে, আবার কাজের অবসরে ঝগড়ারূপী বাকযুদ্ধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। বেশ মজা (প্রকৃত মজা নয়) ও অস্বস্তির একটা পরিবেশ। কানে তাদের কথা কাটাকাটির উচ্চ আওয়াজ প্রবেশ করলেও আমি নির্বাক মননে মুরগি প্রসেসিং এর কাজ দেখছি।
হঠাৎ কি মনে করে লোকটি একেবারেই সামনে এসে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনয়ের সাথে বললেন, “স্যার আপনি তো পুলিশের কর্মকর্তা, বলুন তো এই কাজটি কি সে ঠিক করেছে ?” -আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সর্বোচ্চ আসনে আরোহণ করে মনে মনে শুধুই ভাবছি, ব্যাটা বলে কি ? আমার প্রতিবেশি, আত্মীয়-জ্ঞাতি বংশের কোন স্তরে কেউ পুলিশের চাকুরি করেনি। পুলিশের সাথে আত্মীয়তার কখনো কোন স্বপ্নও আমার পরিবার দেখেনি। লোকটি কিভাবে এ ধারণা করল ! বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ পর্বের সময়ে এক সহপাঠীর একান্ত আগ্রহে কোন এক পাত্রী পক্ষ আমার অনুপস্থিতিতে আমার গ্রামের বাড়িতে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য গিয়েছিল। পরে জানতে পারি, পাত্রীর বাবা নাকি পুলিশ কর্মকর্তা। সেটা ঐ পর্যন্তই থেমে গেছে, সম্ভবত তারা আমাকে পছন্দ করেনি। এটা ছাড়া পুলিশের সাথে আমার কোন পারিবারিক সম্পর্ক নেই
আমি থমকে যাওয়া মুহূর্তকে স্বাভাবিক করতে শুধু এটুকুই বললাম, “আপনার কথায় যুক্তি আছে।” দেখলাম লাকটি খুব খুশি হলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৭ সকাল ১০:৫১