‘মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ মাটির মালিক তাহারাই হন’- এ রকম একটি কবিতা (কাজী নজরুল ইসলামের ফরিয়াদ কবিতা) প্রায়ই আবৃত্তি করতাম ছোটকালে। তখন শুধু মঞ্চ মাতাতে এটিকে বাছাই করা হতো- কিন্তু এখন বুঝিবা এর মর্মার্থ অনুধাবনের উপযুক্ত সময় এসেছে।
কে না জানে প্রায় পৌনে দু’ কোটি জনতা বুকে ধারন করা মেগাসিটি রাজধানী ঢাকার অসহায় নগরবাসী দীর্ঘদিন থেকে অসহ্য ও ভয়ানক যানজটে প্রচ- অশান্তিতে দিন পার করছে। অন্তত ২০ লাখ চাকুরিজীবী ও কর্মজীবীর প্রতিদিন গড়ে ৮০ লাখ কর্ম ঘণ্টা চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করছে। এই ২০ লাখ মানুষের ঘরে ছেলে-মেয়েরা তাদের অপেক্ষায় বসে থাকে- পরিবারের অন্য বড় সদস্যরা আপনজনের নিরাপদে ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায় সীমাহীন টেনশনে সময় অতিবাহিত করে। শুধু ঢাকা নয়- চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটসহ দেশের বড় বড় প্রায় প্রত্যেক শহরেই যানজটের মতো অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। পাশাপাশি রয়েছে জলযট। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে রীতিমতো হাঁটু পানি।
দেশের সর্বস্তরে লাগামহীম দুর্নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করছে সাধারণ মানুষ। ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকলেও দুর্নীতি দূরীকরণে কার্যকরী সুফলের সন্ধান না পেয়ে জনগণ অশান্তির অতল স্পর্শ করে চলেছে। শান্তির সুবাসময় বার্তা কবে নাগাদ ছড়িয়ে পড়বে তার জন্য আমজনতার নিরন্তর প্রতীক্ষা।
গুম-খুন-নিখোঁজ এখন বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্ষণের অন্তহীন আতঙ্ক। দেশের ১৬ কোটি মানুষ এখন অনিরাপত্তার বিপর্যস্ত চাদরে মুড়িয়ে আছে। নিখোঁজের পর লাশের সন্ধান- এ খবর এখন প্রতিদিনের অনিবার্য বাস্তবতা। আর গুমের তালিকা কয়েকশ‘ এরই মধ্যে ছাড়িয়ে গেছে যার মধ্যে মেধাবী ও চৌকস সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সৎ ও মেধাবী ব্যারিস্টার, প্রথম শ্রেণির জনপ্রিয় রাজনীতিকসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী-পেশার মানুষ-জন রয়েছেন, ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে এর দৈর্ঘ্য। এ অশান্তি শুধু ঐ স্বজন হারানো বেদনাহত পরিবারের নয়, সকলের। কেননা, দেশের ১৬ কোটি মানুষই তাদের কারো না কারো আত্মীয়। সুতরাং, গুম-খুন-নিখোঁজের মতো অনাকাক্সিক্ষত অনিরাপত্তার অশান্তি দেশের সব প্রান্তের মানুষই এখন বহন করে চলেছে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সারা দেশেই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলছে অযাচিত নিপীড়ন ও হয়রানি। শান্তিতে নিজের ঘরে ঘুমাতে পারে না এমন লোকের সংখ্যা এখন দেশে লাখ লাখ। উন্নয়নের জোয়ারের ফেনা তোলা হলেও কার্যত সারা দেশ কিরূপ অশান্তির মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে তা নিরপেক্ষ দৃষ্টির অনুসন্ধানেই কেবল উঠে আসা সম্ভব। চাউলের কেজি ৭৫-৮০ টাকায় উত্তীর্ণ হয়েছে- লাফিয়ে লাফিয়ে এভাবেই বাড়ছে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রীর দাম। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এসব এখন দিনদুপুরের বিষয়। ঘর থেকে আপনি বের হয়েছেন- নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবেন এ নিশ্চয়তা পাবার মতো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অধিকার আমাদের অবশিষ্ট আছে কিনা তা রীতিমতো প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ ছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া নৈরাজ্য, অস্ত্র প্রদর্শনী, ধর্ষণসহ অন্যান্য অনাকাক্সিক্ষত কর্মতৎপরতায় জনমনে মারাত্মক অশান্তি বিরাজ করছে। মামলা মোকদ্দমার কথা নাই বা বললাম। এই হলো রাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা । এর পরও যদি এ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তবে তা আমাদের জন্য বিরল গর্বেরই হবে বটে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৪০