somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভোরের অপেক্ষা

১০ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ সামিয়ার বিয়ে। না বিয়ে বলতে আমরা যে রকমটা বুঝি সেরকম না। বিয়েতে কোন আয়োজন নেই। কোন উল্লাস নেই। কোন সাঁজগোছ নেই। বিয়েটা ও পালিয়ে করছে। বাসা থেকে আসার সময় জন্মদিনে পাওয়া সোনার লকেটটা নিয়ে এসেছে। আর ব্যাগে করে ওর সব চাইতে পছন্দের শাড়িটা। বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে চেঞ্জ করেছে। ওর বান্ধবী হুমায়েরা যতটুকু সম্ভব ওকে সাজিয়ে দিয়েছে। আজ ওদের বাসরও হবে হুমায়েরার বাড়িতে। হুমায়েরার স্বামী আর হুমায়েরা ওর বিয়ের স্বাক্ষীও হবে।

সামিয়া এখন বসে আছে মগবাজার কাজী অফিসে। ঘন্টা খানেকের বেশি হয়ে গেছে। আসিফের দেখা নাই। আসিফ ওর প্রেমিক। যার সাথে ওর বিয়ে হতে যাচ্ছে। আসিফের সাথে ওর প্রথম দেখা হয় টিএসসি তে। একটা ছবির এক্সিবিশন এ। খুব সুন্দর ছবি ছিল একটা। একটা বাচ্ছা মেয়ে। দাঁত বের করে হাসতেছে। দুটা মাত্র দাঁত। দেখলে কেমন জানি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সামিয়া ফটোগ্রাফারের নাম দেখল আসিফ রায়হান। সামিয়া মজা করে হুমায়েরাকে বলল, যে হাতটা দিয়ে এত সুন্দর একটা ছবি তোলা হয়েছে ওটা পেলে আমি হাতে একটা চুমু দিতাম!

পাশ থেকে একটা লম্বা, এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ির ছেলে এক গাল হেঁসে বলল, আমি আসিফ। এই যে আমার হাত। এটা দিয়ে এই ছবি তুলেছিলাম...!

সামিয়া লজ্জা পেয়ে চলে আসে। কিন্তু পর বিকালে গিয়ে ছবিটা কিনে নিয়ে আসে। সেই সাথে ফটোগ্রাফারের পরিচয়। ফোন নাম্বার।

এরপর মাঝে ফোনে কথা। মুখবইয়ে বন্ধুত্ব। সারাদিন চ্যাটিং। এভাবে ঘনিষ্ঠতা। ঘনিষ্ঠতা একসময় গড়ায় প্রণয়ে। আজ তাঁর পরিণতি। হালকা একটু সাঁজ গোচে সামিয়াকে অসাধারণ লাগছে। হাতের মেহেদীটা অত টকটকে হয় নি। হুমায়েরা তাড়াহুড়া করে লাগিয়ে দিয়েছিল। লাল শাড়ি আর খোঁপায় বেলী ফুলের একটা মালায় সামিয়াকে ইন্দ্রাণীর মত লাগছে। বেলী ফুল ও নিজে কিনে নিয়ে গিয়েছিল। আসিফের খুব পছন্দ বেলী ফুল।

কিন্তু সময় যত যাচ্ছে সামিয়ার সজীব চেহারায় একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। দেড় ঘন্টা হতে চলল। ওর কন খবর নেই। ফোনটাও নেটওয়ার্কের বাইরে। আজ হরতালের রাস্তা। কোন সমস্যা হল না তো...।

আসিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। কোন চাকরি বাকরি জোগাড় করতে পারে নি। তাই সম্পর্কটা ঝুলে ছিল। গত পরশুই চাকরি পেল। বাবা নেই। মাকে চাকরির খবরটা জানিয়েই সামিয়াকে ফোন দিল। সামিয়াকে বলল, চল আজই বিয়ে করি। সামিয়া বলল, মানে?

আসিফ বলল, মানে বিয়ে করব। চাকরি তো হয়েই গেল। পরে বাসায় জানিয়ে দিলেই হবে।

আসিফ বরাবরের মতই খামখেয়ালি। শুধু মাত্র ক্যামেরা আর ছবি ছাড়া কোন কিছুকে কখনও গুরুত্ব দেয় নি। এমনকি মাঝে মাঝে সামিয়ার মনে হত আসিফের খামখেয়ালীর জগতে তারও ঠিক প্রত্যাশিত গুরুত্বটুকু নেই। তারপরও যখন আসিফ ওর হাতটা আলতো করে ধরে হাতের তালুতে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলে, রাগ করা হয়েছে বুঝি? তখন সামিয়া ঠিক রাগ করে থাকতে পারে না। এমন কি কপট অভিমানও না। আসলে আসিফের বড় বড় মায়াভরা উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে কেউ রাগ করে থাকতে পারবে না।

কাজী অফিসে যাওয়ার জন্য আসিফ মেস থেকে বের হল। সাথে ভার্সিটির বন্ধু পল্লব। ওর বিয়ের আরেক স্বাক্ষী। মালিবাগ থেকে একটা রিক্সা নিল। হরতালের দিন। রাস্তা ফাঁকা। রিক্সা উড়ে চলছিল। কারওয়ান বাজারের কাছে আসার পর হঠাৎ ঝামেলা শুরু হল। একটা মিছিল হচ্ছিল। হঠাৎ পুলিশের সাথে সংঘর্ষ। মারামারি। ছুটাছুটি। আসিফের হাতে ক্যামেরা ছিল। ও নেমে ছুটে গেল ছবি তুলতে। হঠাৎ জটলার ঠিক মাঝে কয়েকটা ককটেল ফাটল পর পর। চার পাশ ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। কিছুক্ষণ পর সাইরেন বাজাতে বাজাতে পুলিশের কিছু গাড়ি রাজারবাগ থেকে ছুটে আসল। ততোক্ষণে কারওয়ান বাজার ফাঁকা। শুধু এখানে সেখানে ইট পাটকেল, হুড়োহুড়িতে ফেলে যাওয়া স্যান্ডেল আর ৩ টা মানব দেহ। এখনও কাৎরাচ্ছে।

বিপ্লব একসময় হুঁশ ফিরে পেয়ে আসিফকে খুঁজতে শুরু করে। চোখে ধোঁয়া সহ্য হয়ে আসতেই পুলিশের ছুটাছুটি আর ৩ টা প্রায় নিথর দেহ চোখে পড়ল। বিপ্লব ছুটে গেল সেই দিকে। লাল পাঞ্জাবি পড়া দেহটাকে দেখে বিপ্লব অনুমান করতে পারে সে কে। কাছে গিয়ে পাশে ক্যামেরা ধরা বিচ্ছিন্ন হাতটা দেখে সে নিশ্চিত হয়। আর সহ্য করার ক্ষমতা ওর ছিল না। ততোক্ষণে এ্যাম্বুলেন্স চলে আসে। ঝটপট উঠিয়ে নেয় মৃতপ্রায় দেহগুলোকে।

বিকেল ৫ টা। আসিফের দেখা নেই। হুমায়েরার স্বামী বলল, ও আসবে না। মনে হয় কোন সমস্যা হয়েছে। আমরা নাহয় বাসায় চলে যাই। খোঁজ নিয়ে দেখি কি হয়েছে। তখনই সামিয়ার মোবাইলটা বেজে উঠল। বিপ্লবের ফোন। বিপ্লব বলল, সামিয়া! তুমি বাসায় চলে যাও। এখানে একটু সমস্যা হয়েছে।
সামিয়া রাগ মিশ্রিত গলায় বলল, কি হয়েছে? আসিফ কোথায়?
বিপ্লব বলল, আছে। তুমি বাসায় চলে যাও
সামিয়া বলল, আসিফকে ফোন দেন।
বিপ্লব মরিয়া হয়ে বলল, আসিফ কথা বলার মত অবস্থায় নাই।
সামিয়া বলল, বিপ্লবদা! আপনি প্লিজ আমাকে বলেন আপনারা কোথায়?

সামিয়া, হুমায়েরা, বিপ্লব ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসিইউ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আসিফের অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। স্প্রিন্টার ওর একটা হাত উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সারা শরীরে অসংখ্য স্প্রিন্টার। এখন আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে।

রাত ৯ টা নাগাদ আফিসের জ্ঞান ফিরল। প্রথমেই বলল, সামিয়া! আমার ক্যামেরা...
সামিয়া কিছুই বলতে পারল না। ডাক্তার এসে ঘুমের ঔশধ দিল। বিপ্লব হুমায়েরাকে বলল সামিয়াকে নিয়ে যেতে। ও থাকবে আসিফের কাছে। সামিয়া যন্ত্রের মত উঠে গেল। যাওয়ার সময় খোঁপা থেকে বেলী ফুলের মালাটা রেখে গেল আসিফের ঘুমন্ত বুকের উপর।

রাত ১২ টা। ডাক্তার এসে বিপ্লবকে বলল, রোগী আপনার কি হয়?
বিপ্লব বলল, আমার বন্ধু। আজ ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
ডাক্তার সাহেব বলল, ওহ! ইয়ে, কিছু পেপার সাইন করতে হবে। বডিটা কি এখানেই দাফন করবেন? নাকি গ্রামে?
বিপ্লব ভাবলেশহীন গলায় বলল, গ্রামে। ওর মা আছে। সামিয়াকেও জানাতে হবে। ওর সাথে আসিফের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
ডাক্তার বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। সকালে এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা হবে। আমি বলে দিব। রাতের বেলা রওনা হওয়া ঠিক হবে না।
বিপ্লব বলল, হ্যাঁ! হরতালের রাত। বিপদ হতে পারে। আচ্ছা, ওরা লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্স এ হামলা করবে না তো?
ডাক্তার সাহেব কিছু না বলে কাঁদ ঝাঁকি দিয়ে চলে গেলেন।

বিপ্লব হসপিটালের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। কুচকুচে কালো অন্ধকার। রাত বাড়ছে... ক্রমশ ভোর হওয়ার অপেক্ষায়...

১০-১১-২০১৩
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩৬
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন রাজনীতি কে কবে দেখেছে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২০


জেনজিরা আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামল দেখেছে। মোটামুটি বীতশ্রদ্ধ তারা। হওয়াটাও স্বাভাবিক। এক দল আর কত? টানা ১৬ বছর এক জিনিস দেখতে কার ভালো লাগে? ভালো জিনিসও একসময় বিরক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×