লোহাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি ভেসে থাকো কী করে? তোমার তো সবসময় ডুবে থাকবার কথা। লোহা জবাব দিলো, সঙ্গ গুণে। কলসিকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি ডুবে গেলে কী করে? তোমার তো ভেসে থাকবার কথা! কলসি জবাব দিলো এটা হয়েছে সঙ্গ দোষে।
সঙ্গ ব্যপারটি আসলে খুবই অ্যাফেক্টিভ। শয়তান ফেরেশতাদের সঙ্গ পেতে পেতে (প্রায়) ফেরেশতা হয়ে গিয়েছিলো। আবার নূহ আ.’র ছেলে সাম বিগড়ে গিয়েছিলো বখাটেদের পাল্লায় পড়ে।
নাহ, আর কোনো রাজনৈতিক হতাশার গল্প না। আজ একটি গল্প বলি।
অনেক অনেকদিন আগের কথা। ‘সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন’ লেখা ট্রাক আবিস্কার হয়নি তখনো। ব্যবসায়ীরা মালামাল বহনে গাধা ব্যবহার করতো। সেই সময়ের গল্প। এক লোক শহরে গেছে মাল কিনতে। সেদিন আমদানি একটু বেশি ছিলো বোধ’য়। দেখলো জিনিষপত্রের দাম একটু সস্তা। সুযোগটা সে ভালোভাবেই কাজে লাগালো। অনেক মাল কিনে ফেললো সে। মালগুলো সব গাধার পিঠে তুলে দিয়ে নিজেও চেপে বসলো গাধায়। চললো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
গাধা চলুক। অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে তাকে। এইফাঁকে আমরা বরং একটি গরুর সাথে দেখা করে আসতে পারি।
এক গৃহস্থের ছিলো এক গাই। ব্যাটা ছিলো বুদ্ধিজীবি টাইপ। তবে ভীষণ ত্যাঁদড় ছিলো সে। সব সময় পঙ্গুত্বের অভিনয় করে থাকতো। সকাল বেলা গোয়ালঘর থেকে বেরোনোর সময় পা টেনে টেনে বের হতো। মাঠে গিয়ে দিব্যি ভালো মানুষ। আবার বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় পা টেনে টেনে এসে ঢুকতো। মালিক তাকে হাল চাষের কোনো কাজেই লাগাতো না। বেচারা লেংড়া গরু...দিনকাল বেশ ভালোই কাটছিলো তার।
গাধা চলছে। মাত্রাতিরিক্ত মালের ভারে কুঁজো হয়ে চলছে বেচারা। চলতে চলতে এসে দেখা হয়ে গেলো সেই বুদ্ধিজীবি গরুর সাথে। গাধাকে এই অবস্থায় দেখে বাঁকা একটি হাসি দিয়ে সে বললো,
ব্যাটা গাধা কোথাকার! এ জন্যই তো তোর নাম গাধা। কত মাল উঠিয়েছে পীঠে! আবার নিজেও চেপে বসেছে। আর তুই টেনে নিয়ে যাচ্ছিস! গাধার গাধা।
গাধা বললো, ভাইরে, কী আর করবো বলো। গাধা হয়ে জন্মেছি। সবই কপাল!
আরে রাখ তোর কপাল। তুইও দেখছি বেকুব মানুষের মতো কথা বলতে শুরু করেছিস। তারাও যখন আক্কেল দোষে কোনো বিপদে পড়ে, তখন বলে, কপালে ছিলো।
তারপর গরুটি তার লেজ নাড়িয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে এক ধরণের আয়েশি ভঙ্গিতে বললো, আর এই আমাকে দেখ। আমাকে কি তোর কাছে অসুস্থ মনে হয়?
গাধা বললো, না।
কিন্তু আমার মালিকের কাছে মনে হয়। সেও তুই প্রজাতির। সে ভাবে আমি অসুস্থ। সেও মোটামুটি একটা গা...
গাধাটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগলো। বুদ্ধিজীবি বললো, আমি একদম ঠিক আছি। কোনো সমস্যা নেই আমার। খাই ধাই, ফুর্তি করে ঘুরে বেড়াই। মালিক তো কি, মালিকের বাপেরও ক্ষমতা হয় না আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করায়।
সেটা কী করে সম্ভব! গাধার চোখে অবিশ্বাস। মুছকি একটা হাসি দিয়ে গরু বললো, এ জন্য সামান্য বুদ্ধি খাটাতে হয়েছে। আর কিছু না।
কেমন বুদ্ধি ভাই? বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস কররো গাথা। মুখে ব্যাঙ্গাত্বক হাসি রেখা টেনে এনে বুদ্ধিজীবি গরুটি তখন বললো,
এইতো, সকালবেলা গোয়াল ঘর থেকে বেরোনোর সময় পা টেনে টেনে বের হই। আবার বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় পা টেনে টেনে গিয়ে ঢুকি। মালিক মনে করে আমি বুঝি লেংড়া। আচ্ছা তুমি আমার ঘাড়ের দিকে চেয়ে দেখ তো! কোনো স্পট আছে?
না।
থাকার কথাও না। জীবনে কখনো কাধে জোয়াল তুললে তবে না দাগ পড়বে।
গরুর এই বুদ্ধিদ্বীপ্ত বর্ণনা শুনে গাধা তো রীতিমত অভিভূত! সে বললো, আরে ভাই! কী মচৎকার বুদ্ধি তোমার!
গরু বললো, মচৎতার মানেটা কি?
আমি আমার মালিককে মাঝেমধ্যে মচৎতার বলতে শুনেছি। এটা চমৎকারের থেকেও বেশি। বাদ দেন। গাধার সব কথা ধরতে হয় না। আচ্ছা ভাই, আপনার তো অনেক বুদ্ধি! আপনি হলেন পারফেক্ট ডিজিটাল গরু। আমাকে একটা বুদ্ধি দিন না ভাইজান। আজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আমিও আপনার মতো ডিজিটাল বুদ্ধিসম্পর্ণ ডিজিটাল গাধা হতে চাই---
(গরুর বুদ্ধি দেখে গাধা তুমি থেকে আপনিতে চলে এসেছে। এমন বুদ্ধিমান একজনকে তুমি করে বলা রীতিমত বেয়াদবি।)
গরুটি তখন মাথাটা হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, হুম। এতো করে যখন বলছো, তখন তোমার জন্য তো কিছু করতেই হয়। আচ্ছা রাখো। আমাকে একটু ভাবতে দাও। দেখি তোমার জন্য কী বরতে পারি...!
গরু আর গাধা। কথা বলছিলো হাটতে হাটতে। গাধার পীঠে বসে থাকা সলিমুদ্দিন আয়েশ করে বিড়ি ফুঁকছিলো আর ভাবছিলো, আজ মালগুলো খুব সস্তায় পাওয়া গেছে। অনেক লাভ হবে। কল্পনায় সে লাভের টাকা গুনতেও শুরু করেছে। ঠিক সেই মূহুর্তে ঘটলো একটি দুর্ঘটনা। গাধাটি হুছট খেয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। মাল গেলো একদিকে, সালিমুদ্দিন অন্যদিকে। কোমরে বেশ ভালো ব্যথা পেলো সলিমুদ্দিন। কোনো রকমে উঠে দাড়ালো সে। কিন্তু অনেক খোচাখুচির পরও গাধাকে আর উঠাতে পারলো না। কীভাবে উঠাবে? সলিমুদ্দিন তো আর জানে না এটি এক মহা বুদ্ধিজীবি গরুর সাজানো পরিকল্পনা।
গাধা যখন বুদ্ধি চাইছিলো গরুর কাছে, গরু বলেছিলো, তুমি এক কাজ করো। সামেনে ধান খেতের কোনো উচুঁ আইলে গিয়ে হুছট খেয়ে পড়ে যেও, আর উঠো না। তোমার মালিক ভাববে, পড়ে গিয়ে ব্যথা পয়েছো তুমি, তাই উঠতে পারছো না। তখন সে তার মাল অন্যভাবে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে..... সব কিছুই ঘটছে ডিজিটাল পরিকল্পনা মাফিক।
সলিমুদ্দিন পড়লেন মহা সমস্যায়। হাওরের মধ্যেখানে এতোগুলো মাল নিয়ে এখন তিনি কী করবেন? সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভালো না। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আবার রাত হয়ে গেলে ডাকাত-টাকাতের পাল্লায় পড়তে হয় কি না-কে জানে। একটু আগেই লাভ গুনছিলেন। এখন পূঁজি তো কি, জান নিয়েই টানাটানি।
ইতোমধ্যে আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। সবাই চেষ্টা করছে গাধাটিকে উঠাতে। কিন্তু গাধা তো আর উঠে না। মাটি কামড়ে পড়ে আছে সে। মুরব্বী টাইপ একলোক কাছে এসে সলিমুদ্দিনকে বললো, জনাব, আল্লাহপাকের নামে কিছু মান্নত করেন। একমাত্র আল্লাহই পারেন আপনাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে।
সলিমুদ্দিন তখন বললেন, আমি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য একটি পশু সদকা করতে চাই। আপনারা আমাকে একটি ছাগলের ব্যবস্থা করে দিন।
অই যে! বুদ্ধিজীবি ছাগল, তার মালিকও ছিলো সেখানে। সে দৌড়ে কাছে এসে বললো,
জনাব, আমার একটা গরু আছে। পায়ে সামান্য সমস্যা আছে, তবে খুবই মোটাতাজা, একদম হৃষ্টপুষ্ট। আপনি এটা নিয়ে যান। মান্নত পুরা করেন। আমাকে যত খুশি দিলেই হবে। এমনিতেই এটা আমার কোনো কাম কাজে লাগে না। আপনি না হয় ছাগলের দামই দিয়েন। সমস্যা নেই।
গরু কেনা হয়ে যাবার পর লোকজন ছুরি চাকু যোগাড় করতে লাগলো। ইমাম সাহেবের অপেক্ষা করা হচ্ছে। তিনি এসে হালকা একটা মোনাজাত দিয়ে আল্লাহ’র নাম নিয়ে জবাই করবেন।
গাধা কিন্তু এতক্ষণ ধরে সব দেখছিলো। সে ভাবলো, আমাকে বুদ্ধিদাতা বুদ্ধিজীবির যদি এই হালত হয়, তাকে যদি এভাবে মেরে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়, না জানি আমার জন্য আরো কতো কঠিন পরিণাম অপেক্ষা করছে। সুতরাং আর অভিনয় করে বিপদ বাড়িয়ে লাভ নাই। এক লাফ দাড়িয়ে গেলো সে।
সলিমুদ্দিন তো মহাখুশি। যে মুরবাবী সদকা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি বলতে লাগলেন, দেখলেন তো! বলেছিলাম না আমি! আপনার সদকা হাতে হাতে কবুল হয়ে গেছে। বলেন, শূকুর আলহামদুলিল্লাহ।
সলিমুদ্দিন শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলতে বলতে গাধার পীঠে মাল উঠবাতে লাগলো। লোকজনও সাহায্য করছে তাকে। মালপত্র উঠানোর পর সে বললো, আচ্ছা ভাইয়েরা, এবার আমাকে বিদায় দিন।
লোকজন বললো, তা কী করে হয়! আপনার শিরনী আর আপনি নিজে উপস্থিত থাকবেন না, সেটা কেমন কথা?
অনেক দূর যেতে হবে আমাকে। আপনারা গোশত ভাগ করে নিয়ে যান। আমি যাই।
তাহলে কিছু গোশত নিয়ে যান সাথে করে।
ভাই, আমার গাধার পীঠে জায়গা কোথায়! এমনিতেই লোড অনেক বেশি।
লোকজন তো নাছুড় বান্দা। বললো, অন্তত মাথাটা হলেও নিয়ে যান।
কীভাবে নেব রে ভাই! উপায় নাই তো!
দাঁড়ান, একটা ব্যবস্থা করছি।
তারপর সবাই মিলে গরুর মাথা রশি দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো গাধার গলায়। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করলেন সলিমুদ্দিন।
গাধা চলছে। চলছে তো চলছেই। একে তো আগে থেকেই ছিলো অভার লোড। এখন আবার সাথে যুক্ত হয়েছে আরেকটা। বুদ্ধিজীবির মাথা। হাটতে গিয়ে মাথাটা এসে ঠাস করে বাড়ি লাগে হাটুর সাথে। ব্যথাও লাগে আবার ঢং ঢং করে শব্দও হয়। গাধাটি তখন দুঃখ করে বলতে লাগলো, আহারে!
কু সঙ্গে সঙ্গ , গলায় ঢং ঢং !!!
বাচ্চাদের যদি এই গল্পটি শোনানো যেতো, তাদের যদি সৎ সঙ্গ’র গুরুত্বটা গল্পের ছলে বুঝিয়ে দেয়া যেতো---

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




