১. ৫ নভেম্বর, ১৯৭৫। ধানমণ্ডির ৬নং সড়কের ১১নং বাসা। বন্ধু রাশেদ মোশাররফ এমপি এলেন রাত ৯টার পর। বললেন, কিছু হলো না। ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়নি। যোগাযোগ হয়নি। বরং ভাই টেলিফোনে উল্টো মাকে বলেছেন, এ কী করেছ! তুমি মিছিলে গিয়েছিলে এবং এই ঘটনাটি আমার বিরুদ্ধে চলে যাবে। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো যোগাযোগ ছিল না এবং তারা নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল আওয়ামী লীগকে তারা উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত বা সহায়তা দেবে না। প্রকৃতপক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী ঘটনা যে রাজনৈতিক এটা বুঝতে না পারা ছিল তাদের নির্বুদ্ধিতা ও আবেগী অপরিপক্ষতা। সামরিক কর্তৃপক্ষ ব্রিগেডিয়ার খালেদ বা জিয়াউর রহমান, কারোরই রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো ইচ্ছা ছিল না।
.
২. ব্রিগেডিয়ার খালেদের অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তটি হয়েছিল ১ নভেম্বর। তার লক্ষ্য ছিল সীমিত। ক. সেনাবাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে খুনি মেজরদের ও ট্যাংক বাহিনীকে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে উৎখাত করা। খ. জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার, অন্তরীণ করা এবং একই সঙ্গে তার পদত্যাগ আদায়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কে হবেন এ নিয়ে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়েত জামিল একমত হতে পারেননি। খালেদের যুক্তি ছিল_ রাজনৈতিক কারণে এই মুহূর্তে খোন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে রেখে দেওয়া। কিন্তু শাফায়েত জামিলের অভিমত প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি করা। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি খালেদ মোশাররফের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ মোশতাককে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তার পূর্বে ২ নভেম্বর খালেদ কর্নেল রশীদকে ট্যাংকসহ ক্যান্টনমেন্টে এসে সারেন্ডার করতে বললে রশীদের জবাব ছিল আমরা শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়ব।
.
৩. খালেদ-শাফায়েতের সামনে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। তারা খুনিচক্রকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর। তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জিয়াউর রহমান বন্দি হন। শাফায়েত জামিল বাংলামটর পর্যন্ত সেনা মোতায়েন করেন, বিমানবন্দর দখল করেন। কিন্তু কৌশলে খোন্দকার মোশতাক টালবাহানা করে ৩০ ঘণ্টা সময় ক্ষেপণ করেন। এর মধ্যে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করা হয়। খালেদ প্রধান সেনাপতি পদের শর্তে খুনিদের দেশ ছাড়ার ব্যবস্থা করেন।
.
৪. অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের দিনই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য বেশ কিছু সিপাহি, এনসিও (নন-কমিশন্ড অফিসার) এবং জেসিও (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) কর্নেল (অব.) তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাসায় হাজির হয়। আরেকটি বিদ্রোহের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৫ নভেম্বর 'বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা'র নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস ও শহর এলাকায় হাজার হাজার প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অভ্যুত্থানের ডাক হিসেবে ১২ দফা দাবি পেশ করা হয়। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সব সেনা ইউনিটের প্রতিনিধির পরিকল্পনাকে দু'ভাবে ভাগ করে তা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং অন্যান্য সেনানিবাসেও সতর্কতার সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়_ ৬ নভেম্বর গভীর রাত ১টায় সিপাহি অভ্যুত্থান শুরু হবে।
সভার সিদ্ধান্ত ছিল :
.
ক. খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা।
.
খ. জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা।
.
গ. একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা।
.
ঘ. দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তিদান।
.
ঙ. রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার।
.
চ. বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন। ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি মেনে নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন করা। জাসদের পক্ষ থেকে এই অভ্যুত্থানের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়: খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় আসার পর ভারত-সোভিয়েত প্রভাববলয় শক্তিশালী হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং মণি-মোজাফফর চক্র প্রকাশ্যে শেখ মুজিবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে।
.
৫. বেতার, টিভি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস, বিমানবন্দর ও অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র প্রথমেই দখল করা হয়। ভোররাতে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান ও ট্রাকভর্তি সেনা সমভিব্যহারে কর্নেল (অব.) তাহের ভোর ৩টার দিকে সেখানে উপস্থিত হলে এক আবেগপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। নৈশ পোশাক পরিহিত জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহের ও তার ভাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেন ও তার জীবন বাঁচানোর জন্য অশ্রুসজল চোখে কৃতজ্ঞতা জানান। ভোর ৪টায় তাহের ও জিয়া একসঙ্গে বেতার ভবনের উদ্দেশে রওনা হন। পথে দু'জনে যেসব তাৎক্ষণিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন তার একটি হলো সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে সেনা-জনসমাবেশে উভয়ের ভাষণদান। পরে জিয়া বলেন, 'তিনি একজন সৈনিক। তার গণজমায়েতে বক্তৃতা দেওয়া সাজে না।' এ যুক্তি দেখিয়ে শহীদ মিনারে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ওই কর্মসূচি বাতিল করা হয়।
.৬. কর্নেল সিরাজ শেরেবাংলানগর থেকে টেলিফোনে আমার স্ত্রীকে জানান অবিলম্বে আমাকে অন্যত্র সরে যেতে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আত্মীয় প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান তালুকদারের ফ্ল্যাটে চলে যাই। সেদিন সারারাত দেখেছি উচ্ছৃঙ্খল সিপাহিদের আচরণ। এক গ্রুপ বলছে 'জিয়া জিন্দাবাদ', অন্য গ্রুপ চিৎকার করছে 'কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ'। আরেক গ্রুপ বলছে 'খোন্দকার মোশতাক জিন্দাবাদ'। সম্ভবত জিয়া-তাহের ভেবেছিলেন, উভয়েই একে অপরকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ব্যবহার করতে পারবেন। জাসদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে নিয়মিত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখত। জাসদ মনে করেছিল, উপযুক্ত সময় এলে জিয়া হয়তো প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করবেন।
সকাল আনুমানিক ৯টায় জিয়া বুঝে নেন তার সামনে ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট। কর্নেল তাহের তখন উপলব্ধি করেন, তিনি ষড়যন্ত্রের দাবা খেলায় হেরে গেছেন। খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহীদের খবর শুনে বঙ্গভবন ছেড়ে লালমাটিয়ায় তার মামার বাসায় আসেন। পরে শেরেবাংলা নগরে ১০ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে আসেন। রংপুর থেকে কর্নেল হুদা দু'দিন আগে এই ব্যাটালিয়নটি ঢাকা নিয়ে আসেন খালেদকে সহায়তা দেওয়ার জন্য। ১৯৭১-এ খালেদই ব্যাটালিয়নটি সৃষ্টি করেন তার নিয়ন্ত্রণাধীনে।
.
৭. ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে খালেদের উপস্থিতির কথা জানাজানি হলে কর্নেল তাহের ও মীর শওকত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকদেরকে প্ররোচনা দিয়ে বিদ্রোহের আহ্বান জানান। বিদ্রোহের এক পর্যায়ে সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে খালেদ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা করা হয়। ওদিকে সেনানিবাসের অভ্যন্তরে তখন চলছে রক্তবন্যার হোলি খেলা। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকরা সিপাহি-সিপাহি ভাই ভাই, সুবেদারের ওপর অফিসার নাই এ স্লোগানের নিষ্ঠুর বাস্তবায়নে অফিসার হত্যার মাতলামিতে মেতে ওঠে। সেনানিবাসের অভ্যন্তরেই তারা এক সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী এবং অপর ১১ জন অফিসারকে হত্যা করে। এ সময় অরক্ষিত সেনা কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও মেয়েদেরকে লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনাও ঘটে। টেলিভিশন ভবনে দায়িত্বরত চার কর্মকর্তাকে তারা খুন করে। শাফায়েত জামিল তার বাহিনীকে একত্রিত করে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে বঙ্গভবনে উঁচু প্রাচীর টপকে পার হতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন। ফলে প্রতিরোধের যে আশা তিনি করেছিলেন, তাও ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
.
৮. বিভিন্ন বিদেশি পত্রপত্রিকা, বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ঘটনাপ্রবাহ জানতে পারে। দেশি-বিদেশি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রচারাভিযান মোকাবেলায় রাজনৈতিক লক্ষ্য ও সম্পর্কহীন খালেদ মোশাররফ এবং তার সমর্থকদের কার্যকর কোনো প্রচার তৎপরতাই ছিল না। জাসদের গণবাহিনীর একটি প্রচারপত্রে বলা হয়, অফিসাররা ক্ষমতা ও পদের লোভে অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে, আর প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ সিপাহিরা। সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করতে হবে। সুতরাং বিপ্লবের জন্য, শ্রেণী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হউন। সেই লক্ষ্যে তাদের কথিত বিপ্লবের নায়ক হিসেবে তারা জিয়াউর রহমানের অনুরোধে তাকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে। মুক্ত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান তাদের সঙ্গে চুক্তিপত্র ভঙ্গ করেন, বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং তাহেরকে শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়।
.
৯. জিয়াউর রহমান সকালে টেপকৃত ভাষণে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন। কিন্তু রাত ১১টায় তা পরিবর্তন করে রাতের ভাষণে নিজেকে ডেপুটি মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। সিপাহি বিপ্লবের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে শাফায়েত জামিল বলেন :'আসলে এতে অংশ নেওয়া সৈনিকদের বেশিরভাগই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনো একটি ব্যাটালিয়নও এর মধ্যে ছিল না।'
১০. ১৫ আগস্ট জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ও ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের পৈশাচিক হত্যা ও ঘটনাবলি প্রকৃতপক্ষে এ কথাই প্রমাণ করে এসবই ছিল প্রতিবিপ্লবী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান। পরাজিত পাকিস্তানি দালালদের রাজপথে উল্লাস, সাম্প্রদায়িক স্লোগান, এমনকি পাকিস্তানের অনুরূপ পতাকা নিয়ে কতিপয় সৈনিকের আস্ফালন। একই সঙ্গে সেদিন সরকারি দৈনিক টাইমসের প্রথম পাতায় ২ কলামব্যাপী শিরোনাম ছিল 'বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম', যা লেখেন সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান। শুরু হয় 'নিউ পাকিস্তান' নির্মাণের যাত্রা।
.
লেখক: '৭২-এর সংবিধানের অন্যতম খসড়া প্রণেতা ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:০৯