স্মৃতি নামের আশ্চর্য টেলিস্কোপ •••
০১•
স্কুলের শেষ দিনটায়, যেদিন আমাদের ফেয়ারওয়েল দেয়া হলো, বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছিলাম। জিলা স্কুলের ঘাসহীন ন্যাড়া মাঠটায় খেলার কত স্মৃতি! কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর কত ছায়াময় আমন্ত্রণ! স্কুল অডিটোরিয়ামের পাশে একটা বেশ আয়েশী ভঙ্গিতে বেড়ে ওঠা শিউলি গাছ ছিল। আমাদের ছোট শহরটায় শীতের পরশ লাগত একটু আগেভাগেই। আর দেখতে দেখতে, কোনো এক সকালে স্কুলে গেলে দেখা যেত, শিউলিতলাটা ভরে আছে ফুটফুটে সাদা ফুলে। মাঝে মাঝে কমলা রঙের ফুটকি। সাদার সাথে কমলা রঙের যে কী ভীষন আদুরে একটা সম্পর্ক হতে পারে, এর আগে জানা হয়নি।
স্কুলের পেছন দিকটায়, টিচার্স কমন রুমের ঠিক পেছনেই, একটা গভীর জলের পুকুর ছিল। ওটার ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া ঘাটের শেষ ধাপটায় উবু হয়ে বসে মাছের ঝাঁক দেখা ছিল নিত্যকার অভ্যেস। টিফিন পিরিয়ডে সিঙ্গাড়া ভেঙে পানিতে ফেলা মাত্রই ধূসর-কালো আর মাঝে মাঝে ইস্পাত রঙের ঝিলিক দেয়া ক্ষুদে জীবগুলো ভীড় করে আসত। ঠিক যেন ক্যাপ্টেন নিমোর ডুবোজাহাজ, অন্য সময় কোথায় থাকে কে জানে, ওই সময়টায় টুপ টুপ করে মাথা তুলে খাবারের টুকরো নিতে হাজির।
ছিল কিছু অশরীরী জীবও। বছরের পর বছর ওরা বেঁচে-বর্তে থাকত আমাদের কল্পনায়, গল্পে, আর ভয় পাওয়ার রোমাঞ্চে।
কোনো কোনো ছাদের কোন, সানশেডের বাড়ানো অংশ-যেখানে খুঁজতে যেতনা কেউ, ছিল আমাদের ’সিক্রেট প্লেস’। সবার চোখের আড়ালে বসে প্রাণের বন্ধুরা মিলে গভীর সব ষড়যন্ত্র হত সেখানে।
এরা সবাই বড় মায়ায় বেঁধে ফেলেছিল। সে মায়া যে কত তীব্র, বুঝতে পারলাম ফেয়ারওয়েলের দিনটায়। হিজিবিজি লিখে ভরিয়ে ফেলা খয়েরি হয়ে আসা কাঠের বেঞ্চগুলো, নতুন দালানের পাশে পুরণো হলদে দালানের খড়খড়ির জানালা, হেডস্যারের ঘরের পাশ দিয়ে শীত শীত অন্ধকারে ঢাকা প্যাসেজটা, যেখানে স্কুল লাইব্রেরির বইগুলো প্রাচীন সব আলমারিতে বন্দী হয়ে ছিল, বহু বছর বাদে আমরাই যাদের বন্দী দশা ঘুঁচিয়েছিলাম- সবাই অদ্ভুত এক করুণ চোখে তাকিয়ে দেখছিল আমাদের।
বেঞ্চের গায়ে নিজেদের হাতের লেখায় হাত বুলিয়ে, ব্ল্যাকবোর্ডের বোবা ভাষার বিষাদ বুকে নিয়ে পুকুর পাড়ের সিঁড়ির ধাপে বসে কেঁদেছিলাম। অন্যসময় হলে আমাদের হৈ হট্টগোলে শহীদুল স্যার অথবা বারী স্যার এসে নিয়মরক্ষার হুঙ্কার দিয়ে যেতেন। সেদিন কেউ এলেন না। আমরা সজল চোখে আমাদের স্বপ্নের মত সুন্দর স্কুলের দিনগুলোকে সেদিন পুকুরের জলে আক্ষরিক অর্থে ‘জলাঞ্জলি’ দিলাম।
মানুষ কাঁদতে কেন জলের কাছেই যায়?
০২•
এরপর অর্ধযুগেরও বেশি কেটে গেছে। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতক এমনকি স্নাতকোত্তর শেষ হল বলে। পরীক্ষা ক’টা ই শুধু বাকি। বয়স বেড়ে চলেছে। মোটা মোটা সব বই পড়ে ফেলেছি। দিস্তা দিস্তা কাগজ ভ’রে দিয়ে ফেলেছি খটমটে সব পরীক্ষা। আমরা নাকি ‘গ্র্যাজুয়েট’ হয়ে গেছি। ছাত্রজীবন ছেড়ে চলে যাচ্ছে আমাদের। দুদিন বাদে ঝাঁপিয়ে পড়ব কর্মক্ষেত্রে।
তবে কি একেই ‘বড় হয়ে যাওয়া’ বলে?
বড়রা কাঁদেনা। বড় হয়ে গেলে কাঁদতে নেই। হাসি দিয়ে কান্না ঢাকার সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়েই আমরা ‘বড়’ হচিছ। স্কুলের ছোট ছেলেটি তো আর নেই। কৈশোরের, বয়ঃসন্ধির আবেগের তীব্রতা- সবই তো হরমোনের বেয়াড়া ওঠা নামা। ওসবের বালাই নেই আর।
আমরা এখন পরিণত মানুষের মত আচরণ করব। বেশ সাবলীল নিয়ন্ত্রণে বিদায় নেব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বন্ধুদের থেকে।
২৮ তারিখ র্যাগ ডে তে এরকমই প্রচ্ছন্ন একটা প্রস্তুতি ছিল ভেতরে ভেতরে। হাসি, উচ্ছাস, আড্ডা, ক্যামেরার ক্লিক, টি-শার্ট জুড়ে রসিকতা আর শুভেচ্ছা বাক্য লেখালেখির একপ্রস্থ হুল্লোড়, খাওয়া-দাওয়া, গান, নাচ - আনন্দের কোন অনুষঙ্গই বাদ গেলনা। ধূসর মেঘের আকাশ, বৃষ্টি - প্রকৃতির কোন ষড়যন্ত্রই আমাদের আনন্দ আয়োজন পন্ড করতে পারছেনা।
সারাদিনের হুল্লোড় শেষ হ’ল পড়ন্ত বিকেলে। যে যার বাসায় ফিরবো এবার, বাকিরা হলে। এই সময়ে হঠাৎ-ই সবাই বুঝে গেলাম, আজকের ফেরাটা ঠিক অন্য দিনগুলোর মতো নয় । আজ আমরা বিদায় নিচ্ছি। কলাভবনের চেনা করিডোরগুলো থেকে, সেমিনারের সামনে জটলা পাকানো থেকে, নোটিশ বোর্ডের বিচিত্র বার্তা নিয়ে আসা কাগজগুলো থেকে, ১০৮৮’র অভ্যস্ত বেঞ্চ, পরিচিত বোর্ড, বিদঘুটে শব্দ করা ফ্যান আর বিভ্রান্ত করা সুইচবোর্ডগুলো থেকে।
বিদায় আসলে সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনের হুড়োহুড়ি থেকে, বেলালের দোকানের চা, আইবিএ ক্যান্টিনের দুপুরের খাবার, হাকিম চত্বরের সিঙ্গাড়া, মল চত্বরের বাসের জন্য অপেক্ষা, টিএসসির রাত গড়ানো দীর্ঘ জমাট আড্ডা থেকেও।
বিদায় জারুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু গাছগুলোকেও। বিদায় অপরাজেয় বাংলা।
বিদায় রোজকার আড্ডার বন্ধুদের।
কেমন গোলমাল হয়ে গেল হিসেবটায় । অনেকদিন আগের বয়ঃসন্ধির কিশোরটা সব সামাজিকতা ঠেলে তেড়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইল সেসময়।
নন্দিতা কাঁদছে, ইব্রাহীম কান্না চাপার ব্যর্থ চেষ্টায় বিব্রত। আমরা সবাই একই অব্যক্ত অনুভূতির অদৃশ্য মানববন্ধনে সামিল।
০৩•
বছর তিনেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বন্ধু গিয়েছিল দিনাজপুরে আমাদের বাসায় বেড়াতে। ওদের নিয়ে একরাতে শহর ঘুরতে ঘুরতে আমার স্কুলটায় ঢুকে পড়লাম। স্কুলের মাঝে ব্রিটিশ আমলে তৈরি লাল ইটের দালানটা আমার বড় প্রিয় ছিল। আমরা থাকতে থাকতেই সেটি ভেঙে নতুন দালান তোলা শুরু হয়। দেখলাম ঝাঁ চকচকে নতুন দালানটি দাঁড়িয়ে। আমার চেনা স্কুলবাড়িটির কাছে নিতান্তই ছেলেমানুষ মনে হয়। ইট-কাঠের দালানেরও যে ব্যক্তিত্ব থাকে, স্পষ্টই বুঝলাম। পুকুরপাড়টা দেখতে ইচ্ছে করছিল। একেবারে ফর্মূলা গল্পের অনুমানসাধ্য সমাপ্তির মতই দেখলাম, পুকুরটা বুঁজিয়ে ফেলা হচ্ছে। সিকিভাগ এরই মধ্যে মাটি ভরাট হয়ে গেছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, স্কুলের আসলে পুকুর দরকার নেই। ছোট ছেলেদের পড়ে গিয়ে বিপদ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
কি জানি ! আমাদের সময়ে তো কখনো এরকম বিপদে কেউ পড়েছে বলে শুনিনি। আজকাল দুধের শিশুদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। জিলা স্কুলে ভর্তি করানোও হয় ক্লাস থ্রি থেকে। সেই রাতে পুকুরপাড়ে সেই অব্দি টিকে যাওয়া কাঁঠাল চাঁপা গাছ ক’টায় থোকা থোকা ফুল ফুটেছিল মনে আছে। চরাচর ছাপানো কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে একটা অপার্থিব বেদনায় বুক ভারি হয়ে এসেছিল। আমার পরিচিত স্কুলটার ঠাঁই এখন শুধু স্মৃতিতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদের বিভাগটিতেও প্রতিবছর একেকটি ছাত্র-ছাত্রীর দল বিদায় নেয়। আবার নতুন ছেলেমেয়েরা আসে। ক্যাম্পাসেও আসে নানান অদল বদল। আমাদের চোখের সামনেই ক্যাম্পাসের চওড়া রাস্তাগুলো মাঝ বরাবর চিরে ফেলে সরু সরু লেন করে ফেলা হল। আকাশের নিচে একেকটা চাঁদোয়ার মত পুরণো গাছ কেটে ফেলে উঁচু উঁচু দালান করা শুরু হল। আমরা ঠাট্টা করে বলি সুপার মার্কেট! বিতর্ক থাকতেই পারে। ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় ক্লাস রুম কম, ভবন না বানিয়ে উপায় কি! তবু, আমরা যারা প্রশস্ত পরিসরের, গাছপালায় ছাওয়া খোলামেলা একটা ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়িয়েছি, তাদের এক ধরণের অস্বস্তি হয়। নিঃশ্বাস নিতে একটু হলেও বাতাসের অভাব হয় যেন।
পরিবর্তন নিশ্চয়ই আরো হবে। কিছু স্বাভাবিক নিয়মে, আবার অনেক কিছুই স্বাভাবিকতা ডিঙিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রের মত অধিকার বোধের গৌরব আর স্পর্ধা নিয়ে এখানে আর দাপিয়ে বেড়ানো হবেনা আমাদের। এরপর আমরা আসব প্রাক্তন ছাত্র, অ্যালামনাই হয়ে । সেইরকম কোনদিন হয়ত দেখব মল চত্বর, হাকিম চত্বরের মত খোলা জায়গাগুলোতেও দালান উঠেছে, বর্ষায় আর জারুল ফুলের সারি সারি গাছে বেগুনি রঙের ফুলের উৎসব হয়না। ইভনিং এমবিএ’র মত সব বিভাগেই সান্ধ্যকালীন-রাত্রিকালীন পড়াশোনা শুরু হয়েছে। দিনের শেষে অন্ধকার নামলেই জ্বলে উঠছে হাজার হাজার উজ্জ্বল বাতি ••• ঠিক যেন শপিং মল-ই।
*** *** ***
আমাদের একটা টেলিস্কোপ আছে । স্মৃতি নামের আশ্চর্য একটা টেলিস্কোপ। এই ক্যাম্পাসের জল-হাওয়া, কলরব আর প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা দিনগুলোর স্মৃতি। সবুজ ঘাসের মাঠ আর জারুল ফুলের স্মৃতি।
কর্মজীবনের সহস্র উত্থান-পতন, সাফল্য-বঞ্চনা আর ব্যক্তিগত জীবনের নানান বৈষয়িক সংযোগ-গোলযোগে অভিভূত আমরা কোন এক আকষ্মিক অবসরে চোখ রাখব এই আশ্চর্য টেলিস্কোপে। নিমেষেই কাছে চলে আসবে কালচক্রে আর দৈনন্দিনের কর্মযজ্ঞের ভিড়ে কোন অন্ধকার ব্রহ্মান্ডে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নময়, নির্ভার আনন্দের এই দিনগুলো। ধরা ছোঁয়া যাবেনা ঠিকই। তবু মুহূর্তের জন্য আচ্ছন্ন করবে সবুজ তারুণ্যের গন্ধ। সেদিনের বিদায়বেলায় বন্ধুদের আলিঙ্গনের উষ্ণতাটুকুও।
(২৮ জুলাই ২০০৯)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১০:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



