somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক জীবনে - রেজাউদ্দিন চৌধুরী

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক জীবনে
রেজাউদ্দিন চৌধুরী


মানিক মিঞা এভিনিউর ভ্রাম্যমান চটপটি দোকান ‘চটপট চটপটি’র অন্যতম অংশীদার হাতেম আলি পুঁজির প্রায় সাকুল্য টাকা নিয়ে ইতালি পাড়ি দিলে মুষড়ে পড়ে অন্যতর মালিক সুবিদ আলি, পুঁজির জন্যে যতখানি না, রাধুঁনির জন্যে তারচেয়ে বেশী। চটপটি বানানোতে ওস্তাদ ছিল হাতেম আলি। নার্গিসি কাবাব? আহা! কি তার ভুবন ভুলানো স্বা-দ! ভাষাতত্বের এমএ সুবিদ আলি ফুচকা, চটপটি বানাতে শিখেছিল বটে তবে রান্নায় সে পাসকোসের্র অর্ডিনারি বিএ হাতেমের ধারে কাছে যায় না। তার অভাবে চটপটির দোকান এখন চলে না। মেসে তারা একসাথে থাকত, হাতেম মাঝে মাঝে বোনের বাসায় যেত। অপারগ হয়ে একদিন সেই বোনের বাসায় গেল সুবিদ আলি।
- দোকান যে আর চলছে না, আপা। বলল সুবিদ আলি।
- কেন, তোমার টাকা তো সে দিয়া দিবে বলে গেছে, কয়টা দিন সবুর কর!
- টাকার জন্যে না আপা, চটপটি রাঁধার মানুষ নেই।
ভাষাতত্বের এমএ সুবিদ আলি বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। নাসিমা আপা থোড়াই কেয়ার করেন বিশুদ্ধ বাংলার। তিনি বললেন,
- তারে কামের মানুষ পাইছিলা? নিজে রান্ধ গিয়া যাও। আমার বাসার কামের বুয়া নাই এক সপ্তাহ্, আমি রান্তেছি না?
দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে নিজের দোকানে ফিরে আসে সুবিদ আলি। যখন দোকান করেছিল সবাই বলেছিল এমএ পাস করে স্বাধীন ব্যবসা, এরচেয়ে ভাল আর হয় না, থার্ড ক্লাস চাকরীর চাইতে এই ভাল। স্কুলের বন্ধু হাতেম আলী পাসকোর্সে বিএ পাশ করে সম্ভবত: কোন চাকরীই পেত না, সে ও এসে জুটল। ইস্কুলে থাকতে ফুচকা, চটপটি খুব খেত তারা, কিন্তু সুবিদ যেখানে ফুচকা খেয়ে হাত মুছে চলে আসত, হাতেম সেখানে দাঁড়িয়ে চটপটি বানানো দেখত, এবং পরে শিখতে শুরু করল। ক্লাস নাইন-টেনে থাকতে ঘরে চটপটি বানিয়ে সে মা’কে অবাক করে দিত। মা’র কাছে সে শিখল নার্গিসি কাবাব বানাতে। বিএ পাশ করে ঘরে ফুচকা বানিয়ে পাড়ার দোকানে সাপ্লাই দে’য়া শুরু করল। এই ফুচকা, নার্গিসি কাবাব খেয়েই সুবিদের মাথায় একদিন ‘আইডিয়া’র বাতি জ্বলে উঠল - তারপর বাকী ইতিহাস।
‘সুবিদ আলী-হাতেম আলি একদিন এই শহরে পাঁচ-তারা হেটেলের মালিক হবে’, তার দোকানে খেতে খেতে ছেলে ছোকরারা বলত। সে আশার গুড়ে বালি দিয়ে ব্যবসা’য়ের মূলধন সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে বিদেশে কেটে পড়ল হাতেম আলি। প্রথমে দোকান তুলে দেবে ভেবেছিল সুবিদ আলি, কিন্তু চাকরী নেই, চাকরী পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, খাবে কি? বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় না, কৃষি জমি থেকে বাবার ঢের রোজগার, দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, সে বাবার একমাত্র ছেলে, কাজেই বাড়ির চিন্তা তার নেই, তবে ব্যবসা চালানোর চিন্তা আছে। ব্যবসা শুরু করার সময় বাবা দেড়লাখ টাকা দিয়েছিল তারপর আর একটা ফুটা পয়সাও ছোঁয়ায়নি।
বিক্রিবাটা কমে গেল সুবিদ আলির। পানসে চটপটি অথবা শুধু তেতুল পানির ফুচকা, নার্গিসি কাবাব নেই অথচ পাশের ভ্যান দোকানের এইট পাশ সমীরণ তার এসিস্ট্যান্টকে নিয়ে চটপটিা বেচে লাল হয়ে গেল। ভাষাতত্বের মাষ্টার্স সুবিদ আলির মাথায় ‘আইডিয়া’র বাতি আর জ¦লে না। বিক্রিবাটা অর্ধেক হয়ে গেল, ধারে চলছে দোকান, বিনিয়োগের টাকাই উঠছেনা পাকা রাধুঁনির অভাবে। পিচ্চি এক সহকারী আছে, কিন্তু রাধুঁনি ছাড়া কি বিক্রিবাটা বাড়ে?
এমন দিনে .. .. .. .. ..

দু’রকম কাজ শিখেছিল বেঁটে মদন, পকেট কাটা আর জিলাপী বানানো। মফস্বল শহরে পকেট কাটা খুব একটা লাভজনক ব্যবসা না। টাকা ভর্ত্তি পকেট অপ্রতুল, ঝুঁকি বেশী। ছোট শহর, প্রায় সবাই তার মুখ চিনে। ফলের বাজারে কানকাটা হারাধন বা ট্যারা শামসু কারো পকেট মারলে মাছের বাজারে এসে তারা বেঁটে মদনকে তুমুল মার লাগাত। ‘আমি না,’ ‘আমি না,’ বলে পার পেত না মদন। আকারে ছোট, বয়স কম মদনকে মেরে টাকার শোক কে তারা হাতের সুখে পরিণত করত। বেঁটে মদনের অন্য আনন্দ ছিল জিলাপী খাওয়ায়। পকেটমারীর মূল টাকা ওস্তাদের হাতে তুলে দিয়ে নিজের ভাগের টাকাটা নিয়েই সে দৌড়াত গগণ ঘোষের মিষ্টির দোকানে। জিলাপী খেত তারিয়ে তারিয়ে আর জিলাপী বানানো দেখত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তার আগ্রহ দেখে মদন ঘোষ তাকে জিলাপী বানানো শেখাল। এক সময়ে পাকা জিলাপী বানিয়ে হয়ে গেল সে। তখন একদিন পাবলিকের মার খেয়ে সে বলল ‘দুর, মাইর খাইতে আর ভাল্লাগেনা, জিলাপীই বানাইমু এখন থনে।’ জিলাপী বানানোর কাজে সে যোগ দিল গগণ ঘোষের মিষ্টির দোকানে। ময়রা গগণ ঘোষ তাকে পোষ্য নিল, কাজ শিখাল মন দিয়ে। গগণ ঘোষের জিলাপীর নাম শুনলে সেই ছোট শহরে কেউ মুখের পানি কেউ সামলে রাখতে পারত না। গগণ হল বাপ মা হারা মদনের পোষ্য বাবা এবং মিষ্টান্ন শিল্প গুরু। পকেটমার গুরুর কথা সে ভুলে গেল। গগণ অনেকরকম মিষ্টি বানাতে পারত, সবাই খেয়ে বলত ‘তাহা তাহা’ মানে ‘আহা, আহা’। বেঁটে মদন তার কাছে শুধু শিখল জিলাপী বানানো। এই জিলাপীকে তারা বলত ‘শাহী রেশমী জিলাপী’। ইলেকট্রিক ক্যাবলের সমান মোটা আড়াই প্যাঁচের জিলাপী, মুখে দিলে মিলিয়ে যেত হাওয়াই মেঠাইয়ের মত, শুধু রেখে যেত দিনভর মিষ্টির স্বাদ। ষোল আনা না হোক, বারো আনা এই শিল্প আয়ত্ব করেছিল বেঁটে মদন। ভালকথা, বেঁটে মদন কিন্তু আসলে মদন নয়, তার আসল নাম হয়ত জহির বা সামাদ বা রবার্ট বা অনিল, গগণ ঘোষ সে নাম জানতে চায়নি, সে নাম দিল মদন ঘোষ। সেই থেকে বেঁটে মদনের জন্ম। যদিও মুসলমানকে হিন্দু বানানো যায় না, কিন্তু মদন আসলে মুসলমান ছিল গগণ তাকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষা দিয়েছে এ রকম খবর রটলে গগণের খবর ছিল। আজকের দিন হলে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে রায়ট লাগিয়ে দিত। জিলাপীর সাথে সাথে গগণ ঘোষের কাছে ফুচকা-চটপটি বানানো শিখেছিল মদন। মিষ্টির সাথে ফুচকা যায় না, তাই শুধু সপ্তাহে দুই দিন দোকানের বাইরে তোলা উনুনে ফুচকা-চটপটি বানাতো তারা। তারপর একদিন সেই না হিন্দু না মুসলমান বেঁটে মদন গুরুর আশীর্বাদ এবং গুরুর কাছ থেকে পাওয়া টাকা নিয়ে ঢাকা শহরে পা রাখল।

দু’বার তার কাছ থেকে চটপটি নিয়ে খেয়েছে ছেলেটা। এক সময় বলল,
- আপনার রান্ধাত খামতি আছে।
কথাটা শুনেই রাগ হল সুবিদের।
- কোথায় খামতি?
- আপনে তাড়াহুড়া কররা। চটপটিত ডাশ লাগিতেছে না। প্রাণপণে শুদ্ধ বলল ছেলেটি। ডাশ না বুঝেই সুবিদ বলল,
- তাড়াহুড়া কি ভাবে হল? সময় নিয়েইতো করছি আমি। বিরক্ত হয়ে বলল সুবিদ আলি।
- ভাইজানে বুঝরা না। পয়লা পাতিল গরম হওয়ার লাগি সময় দেওয়া লাগব। ভাইজানে যদি সময় দেইন আমি এক পাতিল চটপটি রান্ধি দেখাই দেই।
তাকে চটপটি বানাতে দিল সুবিদ। চমৎকার হল পুরো জিনিষটা, এক সন্ধ্যায় জমে গেল। যারা একবার খেল তারা আবার ঘুরে আসল। আটটার মধ্যে নতুন হাঁড়ি শুন্য হয়ে গেল। পুরনো কিছু মাল আগের হাঁড়িতে ছিল, সে গুলো আর বিক্রি করল না তারা, সদ্যপ্রাপ্ত সুনাম নষ্ট হবে বলে। রাতে নতুন ছেলেটাকে তার কমলাপুরের ডেরায় ফিরতে দিল না সুবিদ আলি, নিজের মেসে নিয়ে এল। হাতেম আলি চলে যাওয়ার পর তার সিট্টা এখনো খালি পড়ে আছে। খাওয়ার পর বিজিনেস্ টক হল। পার্টনারশিপ ব্যবসা, নতুন ছেলেটা বলল সে দশহাজার টাকা দেবে এবং সাথে জিলাপী ও চটপটি বানানোর দক্ষতা সহ শ্রম, সুবিদ আলি দেবে মাল-সামান সহ ব্যবসায়ের চালু মূলধন এক লক্ষ টাকা। দু’জনের শেয়ার যথাক্রমে বিশ পার্সেন্ট ও আশী পার্সেন্ট। ফুচকা-চটপটির সাথে ‘মন খুশ জিলাপী’ বিক্রির প্রস্তাব দু’জনের বোর্ডে অনুমোদিত হল। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলল মদন। ভাল কথা, এই নতুন ছেলেটাই ছোট্ট শহরের বেঁটে মদন।

ব্যবসা রমারমা চলল। সুবিদের ভাগের দু’লাখ সহ ব্যবসায়ের জয়েন্ট একাউন্টের সাড়ে তিন লাখ টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছিল হাতেম আলি, এখন সুবিদ আর মদনের জয়েন্ট একাউন্টে চারলাখ টাকা। হাতেম আলি চিঠি দিয়েছে রোম থেকে। সেখানে পার্টনারশিপে খাবার দোকান দিয়েছে সে, ‘তাকিয়া পাখি’ মানে টার্কির মাংসের ডোনের কাবাব বেচে ইউরো বানাচ্ছে। হাতেম আলি বেনামী পার্টনার, কারণ সে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। সুবিদ আলির দু’লাখ টাকা সে পাঠিয়ে দিচ্ছে সামনের মাসে এবং ফুচকার ব্যবসা বড় করতে সে আরো টাকা পাঠাবে।
তর তর করে এগিয়ে চলল সুবিদ-মদনের ফুচকা, জিলাপীর ব্যবসা। পেশাদার রান্নার ট্রেনিং কোর্স করল মদন, সুবিদ আলি ম্যানেজমেন্টের উপর ছয় মাসের কোর্স করল। এতে ব্যবসায়ের যে খুব উন্নতি হল তা’ নয়, তবে শিক্ষিত রেস্তোঁরা মালিক বলে কদর বাড়ল, আর ফাউ হিসেবে কিছু ব্যবসা কৌশল শেখা হল। মদনের মুখের ভাষাও অনেকটা পরিশুদ্ধ হল। আরো টাকা জমল তাদের জয়েন্ট একাউন্টে। তারপর একদিন ফুচকা-চটপটির ব্যবসা দ্’ুই জুনিয়ার সাগরেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গ্রীণ রোডে একটা চালু রেষ্টুরেন্ট কিনল তারা। ‘মাদারীপুর হোটেল’ নাম বদলে হয়ে গেল ‘জলপরি’। এককালের ডোবার উপর একটা কাঠের মাচায় এই হোটেলটা ছিল বলে নামটা যুৎসই হল। মন্দলোকেরা যারা ইতিহাস জানত তারা কেউ কেউ অবশ্য নাম দিল ‘জলপেতিœ’ আর ইতিহাস না জানা হিংসুকেরা বলতে লাগল ‘ঝালপুরি’। তবে তাদের সবার মুখে ছাই দিয়ে ‘জলপরি’ নামই স্থায়ী হল। মদন বিয়ে করতে বাড়ি গেল, কিন্তু জাতের প্রশ্ন উঠায় গগণ ঘোষ কিছুতেই তার পোষ্য ছেলের বিয়ে দিতে পারল না।
স্থানীয় মানুষ বলল, ‘ই পুয়ার গেছে পুড়ি দিব কুন বে-আখলে? জাত-ধর্ম্মর ঠিক নাই।’ দু:খ ভরা মনে, ‘লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’, গুণ গুণ করতে করতে করতে ঢাকা ফিরল মদন। সুবিদ ও বিয়ে করেনি, দু’জনে তাই গ্রীণ রোডের এক গলিতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে লাগল।
এমন সময়ে .. ..

একদিন হাতেম আলি ফিরে এল। সঙ্গে ইতালিয়ান বৌ মিরাবেলা এবং অনেক টাকা। সুবিদ আলিকে খুঁজে বের করে একদিন সে রেষ্টুরেন্টে এল, বলল,
- ছি, ছি, তোর রুচি এখনো বাড়ল না? সেই ভাতের দোকানেই রইয়া গেলি?
- কেন খারাপটা কি হল? তুইতো আমার সাথে ফুচকা ভ্যান চালাতি।
- যখন চালাইতাম তখন চালাইতাম, ফুচকা ভ্যানেতো থাইমা নাই আমি। একশ দু’ই রকম ইতলিয়ান রান্না জানি। রোমে, ফিরেঞ্জে’তে ইতালিয়ান খাবার বেচছি, টাকাও বানাইছি ।
- ফিরেঞ্জে আবার কোন জায়গা?
- ঐ লোকে যারে ফ্লোরেন্স বলে।
মদন পাশে এসে দঁড়িয়েছিল এবং অবাক হয়ে হাতেম আলির বাতেলা শুনছিল। সে বলল,
- ইতালিয়ান খানা আমিও বানাইতাম পারি। পিজা, পাস্তা -
মদনকে চিনলো না হাতেম, জিজ্ঞেস করল.
- আপনে?
মদনকে কথা বলতে না দিয়ে এক নি:শ্বাসে বলে গেল সুবিদ আলি,
- আমার পার্টনার মদন ঘোষ। আমাদের শেফ্ও। চমৎকার রাঁধে। আমাদেও রেষ্টুরেন্টের রান্নার সুখ্যাতি
তাকে বাধা দিয়ে মদনকে জিজ্ঞেস করল হাতেম,
- পিৎজা মারিনারা বানাতে পারেন?
- না।
- পাস্তা আল পেস্তো বানাতে পারেন?
- না।
- রিসেত্তো আলা মিলানীজ পারেন?
- না।
- র‌্যাভিওলি, ক্যাচিয়াটোরে বা একুয়া পাজা?
- না।
একই সাথে খুশী আর হতাশ হল সুবিদ আলি।
- তা’হলে আর কি হইবে। আমাকেই দেখছি এটাকে মডার্ণ রেস্তোঁরা করার ভার নিতে হইব।
কয়েক দিনের মধ্যে হাতেম আলি ভার নিল, মানে সোজা বাংলায় রেস্তোঁরার পার্টনার হল। সুবিদ তার ছয় মাসের ম্যানেজমেন্ট বিদ্যায় বুঝেছিল এতে তাদের লাভ। মদন ও বুঝেছিল টাকা এবং ইতালিয়ান রন্ধন বিদ্যা দু’টোই তাদের দরকার। হাতেম আলি হল ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তার বৌ মিরাবেলা হল ডেপুটী শেফ। নতুন চুক্তি হল। কোম্পানির নাম হল এইচ এস এম হোটেলস্ এন্ড রিসোর্টস প্রাইভেট লিমিটেড, ভবিষ্যতে হোটেল করার আশায়। তিনজনের শেয়ার চল্লিশ পারসেন্ট - চল্লিশ পারসেন্ট - বিশ পারসেন্ট । বেঁটে মদন বেঁটেই থেকে গেল। মামুলী ভাতের দোকান থেকে ‘জলপরী লা ইতালিয়ানা’ নামে আধুনিক রোস্তোঁরার জন্ম হল। সুবিদ মদন কে যারা চিনত এবং তাদের দোকানকে ‘জলপেতিœ’ বা ‘ঝালপুরি’ বলত তারা ঢোক গিলে ‘জলপরী লা ইতালিয়ানা’ পর্য্যন্ত না এগোলে ও ‘জলপরী’ বলা শুরু করল। এদিকে ‘জলপরী’তে আগে থেকে রিজার্ভেশন দেয়া না থাকলে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। মি: মদন আর মাদাম মিরাবেলা’র ফাটাফাটি রান্নার গুণে দিন দিন তাদের পশার বাড়তে লাগল। তারা নিজেরা রাঁধেনা, তবে রেসিপি তাদের, ফাইন্যাল টাচ তাদের, পুরনো রান্নাকে নতুন চেহারায় নতুন স্বাদে উপস্থাপন কারা তাদেরই গবেষণার ফল। তরতর করে এগিয়ে চলল ‘জলপরী’। গুলশানে এপার্টমেন্ট কিনল তিনজন তিনখানা। গাড়িও কিনল তিন কিসিমের। দুইজন ব্যাচেলর আর একজন বিবাহিত কিন্তু তিনজনই কাজের লোকদের উপর নির্ভর করে সংসার চালায়, কারো বাবা মা এ বাড়িতে আসতে রাজী না। মিরাবেলার বাচ্চাকাচ্চা নেই, হোটেল আর রান্না নিয়েই সে পড়ে থাকে।
- মিরা, আমাকে ইতালিয়ান রান্না শেখাবে?
একদিন মদন বলল। মিরা বলল,
- অবশ্য - অবশ্য।
মিরাবেলার কাছে ইতালিয়ান রান্না শিখল মদন, মদনের কাছে সিলেটি উচ্চারণে বাংলা শিখল মিরাবেলা।
কিছুদিন পর এয়ারপোর্ট রোডে নিজেদের কেনা জমিতে ‘জলপরী লা ইতালিয়ানা’ স্থানান্তর করল তারা। দু’পাশে এবং পিছনে অনেকটা জায়গা কিনে রাখল মুফতে। সস্তায় পেয়ে গিয়েছিল। ‘জলপরী লা ইতালিয়ানা’ এখন ‘এ’ ক্লাস একটা হোটেল। মিরাবেলার কাছ থেকে শিখে এবং ইতালিয়ান রান্নার রেসিপি বই কিনে মদন এখন পুরো দস্তুর ইতালিয়ান শেফ। বাংলা (সিলেটি) শেখানোর পাশে পাশে নিজেও কিছু কিছু ইতালিয়ান ভাষা শিখে নিয়েছে সে। হাতেম ব্যাপারটা পছন্দ করল না। ইতালিতে থেকেও সে যেসব ইতালিয়ান রান্না জানে না সিলট্যা মদন তার সবগুলি শিখে ফেলল? মিরাবেলা বলে তার ইতালিয়ান উচ্চারণও নাকি ভাল। একদিন হাতেম আলি বলল,
- বোকামি করতেছ, মিরা।
- বুকামি কিলা অইল?
- ‘বুকামি’ না, বোকামী, ‘কিলা’ না, কি রকম, ‘অইল’ না, হল বল।
- অইছে, তুমারে আর উশ্চারণ হিকানি লাগতো নায়। বুকামী কুনটা কও?
- মদনকে ইতালিয়ান রান্না শিখাইতেছ ক্যান? সে তোমার সিক্রেট রেসিপি জেনে যাইতেছে।
- সিক্রেট আবার কিতা? আমরাতো এক জাগাত কাম করি।
মোট কথা হাতেমের যুক্তি মিরাবেলা মানল না। সে ছিল উদার হৃদয়।
তারপর .. ..

একদিন তিন বিদেশী ‘জলপরী লা ইতালিয়ানা’য় খেতে এলেন। তারা আন্তর্জাতিক চেইন হোটেল ‘রয়েল ইন’-এর ম্যানেজমেন্টের লোক। মদনের ‘লবস্টার থার্মিডোর দ্য চিটাগাং’ এবং মিরাবেলার ‘ক্যাপন ম্যাগ্রো’ খেয়ে তারা তাহা তাহা, মানে ‘ওয়াও’, ‘ওয়াও’ করলেন। মদনকে তারা প্রস্তাবিত চেইন হোটেল ‘ঢাকা রয়েল ইন’- এর শেফ অর্থাৎ প্রধান বাবুর্চি করার প্রস্তাব দিলেন। আইডিয়াটা তখনই হাতেম আলির মাথায় আসল। তারা পার্টনার হলে কেমন হয়? পার্টনার? এত টাকা কি তাদের আছে? অবশ্যই আছে। রেষ্টুরেন্টের এর দুইপাশে এবং পিছনে তাদের দুই বিঘা জমি আছে, এর দামেই তারা হোটেলের শেয়ার কিনবে। অতএব, শেয়ার কেনা হল। ‘ঢাকা রয়েল ইন’এর শেয়ার পঞ্চাশ পারসেন্ট, সুবিদ আলির বিশ পারসেন্ট আর হাতেম আলির ত্রিশ পারসেন্ট। মদনের কোন শেয়ার নেই, হাতেম আলি তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার অংশ কিনে নিয়েছে। শহরের লোকেরা একদিন দেখল এয়ারপোর্ট রোডের একটু ভিতরে পাঁচ তারকা হোটেল ‘জলপরী রয়েল ইন’ দাঁড়িয়ে আছে। এই শহরে পাঁচতারা হোটেলের মালিক এক কালের দুই শিক্ষিত ফুচকাওয়ালা। মদন এখন পাঁচতারা হোটেলের শেফ, অনেক টাকা বেতন, তার শেয়ারের কি দরকার? বলতে গেলে জলের দরে হাতেম আলি বাগিয়ে নিয়েছে তার অংশ। মিরাবেলা এখনো কুক এই হোটেলে, সে ও ভাল বেতন পায়। রাস্তা প্রায় যানজট মুক্ত থাকায় এবং মূল রাস্তা থেকে কিছুটা ভিতরের দিকে নিরিবিলি হওয়ায় এবং অতি উত্তম খাবারের কল্যানে এই হোটেলে সব সময় আবাসিকে ভরা থাকে। মদনের তেমন কোন চাহিদা নেই। শেয়ার বেচা টাকায় সে তার পালক বাবাকে জেলা শহরে দোতালা মিষ্টির দোকান বানিয়ে দিয়েছে। তাদের বাড়িটাও দোতালা করেছে, কিন্তু সে আর বাড়িতে যায় না। মনের মধ্যে সব সময় গুণ গুণ করে, ‘লালন কি জাত সংসারে।’
একদিন বোর্ড মিটিং-এ প্রস্তাব তুলল হাতেম, তাদের আন্তর্জাতিক সুনামের জন্যে আন্তর্জাতিক মানের পেশাদার ডিগ্রীধারী শেফ দরকার। এতদিন চলেছে চলেছে, এখন আর চলবে না। চেইন হোটেলের পক্ষে যারা প্রথম মদনের রান্না খেয়ে ‘তাহা তাহা’ বা ‘ওয়াও ওয়াও’ করেছিলেন তারা কেউ আর এখন নেই, নতুন প্রতিনিধিদের কাছে মদন ঘোষ বা শামসুল হক বা রবার্ট পিনেরিও মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুবিদ আলি বাধা দে’য়ার চেষ্টা করল, প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিল, কিন্তু কাজ হল না, ৪-১ ভোটে মদন ঘোষকে বিদায় দে’য়া সাব্যস্ত হল। একদিন তিন মাসের বেতন নিয়ে মদন চলে গেল।
তারপর --

রোমের চমৎকার এক রেস্তোঁরার নাম, ‘রিস্তোরান্তে গ্র্যান্ডিয়োসো ইন্ডিয়ানো’। রেস্তোঁরার বাহার ভারতীয়, আহার বাংলাদেশী। ভারতীয় চিত্রের প্যানোরামা দেখতে দেখতে ঝালে ঝোলে মশলায় বাংলাদেশী খাবার খায় এখানকার পাবলিক। বিদেশী অর্থাৎ বাংলাদেশী সহ অন্যান্য দেশী ট্যুরিষ্টদের কাছে এবং এদেশীয় ইটলিয়ানদের কাছে এটি অতি প্রিয় এক খাবার জায়গা। এই চমৎকার খাবারের স্বাদ নিতে দূর দূরান্তর থেকে তারা আসে। রেস্তোঁরার ওয়েটাররা সার্ভিস দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। এই রেস্তোঁরার মার্কামারা খাবারের মধ্যে আছে ‘রিসোত্তো আলা সিলেটীজ’ এবং ‘ওসোবুকো আলা বেঙ্গালা’ মানে জাফরান মিশানো পোলাও এবং বাছুরের মাংসের ফাটাফাটি বাংলাদেশী ঝোল। কেউ একবার খেলে তার আবার না ফিরে উপায় নেই। এর সাথে স্টার্টার হিসাবে আছে ‘ডাকা ফুসকানো’ মানে ‘ঢাকার ফুচকা’ এবং শেষে অন্যতম ডেজার্ট হিসাবে, ‘ডলচে ডেল বেঙ্গালা’ মানে বাংলার মিষ্টি, সোজা বাংলায় রেশমী জিলাপী। এই না খেয়ে রোমের এবং বিদেশের খাদ্য রসিকেরা নিজ নিজ ভাষায় বলে, ‘তাহা তাহা’।
জুনের পরিপূর্ণ এক সকালে রিস্তোরান্ত গ্র্যান্ডিয়োসোর মালিক সিন্নরে মদন ঘোষ ভাবছিলেন কাচ্চি বিরিয়ানি’র ইতালিয়ান সংস্করণ কি করে বানানো যায়, কিসের সাথে কি মেশালে ইতালিয়ান রসনা তৃপ্ত হবে এবং তার নামই বা কি হবে? লাউঞ্জের লাগোয়া তার চেম্বারে বসে ইন্টারকমে তিনি শেফকে আসতে অনুরোধ করলেন। শেফ রুমে ঢুকতে ইতালিয়ান ভাষায় তিনি বললেন,
- ডালিং, একটা নতুন রান্নার চিন্তা মাথায় আসছে।
- কি রান্না, ডার্লিং?
মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন রিস্তোরান্তে গ্র্যান্ডিয়োসো ইন্ডিয়ানোর অবাক করা শেফ সিন্নরা মিরাবেলা ঘোষ।

৩১/১২/২০১৪
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:০৭
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×