এক।
‘সংকট’-শব্দটি আজকাল আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ছড়িয়ে পড়েছে এফডিসির অলিগলি,কাকরাইল পাড়া আর গণমাধ্যমের বিনোদন পাতায়। সংকট রয়েছে ভালো চলচ্চিত্রের। সংকট রয়েছে ভালো নায়কের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকে এমনটি মনে করেন। এখানেও অন্যসব বিষয়ের মতো দু’টি পক্ষ বিদ্যমান। এক পক্ষ বলছেন নায়কের সংকট নেই,সংকট ভালো ছবির। আবার কেউ কেউ বলছেন ভালো ছবির সংকটের চেয়ে নায়ক সংকট বেশী। যদিও দক্ষ নায়ক এবং ভালো ছবি-এই দু’টি একে অন্যের পরিপূরক। নায়ক সংকটের সূত্র ধরেই বেশ কয়েকজন নায়কের আগমন হয় এফডিসিতে। যে আশা আর সম্ভাবনা নিয়ে তারা চলচ্চিত্রে এসেছিলেন সেটা যেনো তাদের অদক্ষতার কারনে এফডিসির আকাশে বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। তাই আশাহত নির্মাতারা।
দুই।
গত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ‘একনায়কতন্ত্র’ চলছে। ‘একনায়কতন্ত্র’ শব্দটি রাজনৈতিক মনে হচ্ছে। যদিও এই লেখাটির সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। শব্দটিতে খুব বেশি আপত্তি থাকলে ‘এক-নায়ক-তন্ত্র’ এর মতো করে ভাবা যেতে পারে।
মূল প্রসঙ্গে আসি। এফডিসি কেন্দ্রিক বাংলাদেশে বছরে যে সংখ্যাক ছবি নির্মিত হচ্ছে তার আশি শতাংশ ছবিতে নায়ক হিসেবে থাকছেন শাকিব খান। বাকি বিশ শতাংশ ছবি করছেন অন্যান্য নায়করা। শাকিব খান যে স্বৈরাচারি সরকারের মতো গায়ের জোরে সব ছবিতে একা অভিনয় করছেন তা নয়। দর্শক মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বলেই তিনি সবার থেকে এগিয়ে। তার ছবি মুক্তি পেলে প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভর্তি থাকে। তার অভিনয়, সংলাপ,অ্যাকশান-সবকিছু দেখে এক শ্রেণীর দর্শক দেখে মুগ্ধ হয়। একজন নায়কের এর থেকে পাওয়ার আর কি থাকে?
শাকিব খান আজকাল বড় বাজেটের যৌথ প্রযোজনার ছবিতে অভিনয় করছেন। এমনকি কলকাতার স্থানীয় ছবিতে অভিনয় করছেন। সেখানে তার কিছু দর্শক তৈরী হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যে তাকে খুব গ্রহণ করেছে তা নয়। তবে হয়তো সেজন্য সময়ের প্রয়োজন।
শাকিব খান বাংলাদেশে বেশি সংখ্যাক ছবিতে অভিনয় করছেন। কলকাতায় নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এতে করে শাকিব খান লাভবান হলেও লাভের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্জন শূণ্য। কলকাতায় শাকিব খানের যৌথ প্রযোজনার ছবি ব্যবসা সফল নয়। তারপরও তাকে নিয়ে একের পর এক যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মিত হচ্ছে। এর একমাত্র কারন। বাংলাদেশের বাজার দখল করার জন্য শাকিব খান বড় একটি ট্রাম্পকার্ড।
যাহোক। এসব আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনা করতে চাই শাকিব খানের উত্তসূরী নিয়ে। শাকিব খানের এরকম জনপ্রিয়তা অনেক নতুন পুরোনো নায়কদের ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি বলা যেতে পারে। এটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য অশুভ লক্ষণ। একটি চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে একাধিক মানসম্পন্ন নায়ক প্রয়োজন। প্রতিযোগীতা হতে হবে নায়কদের মধ্যে। যা বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে না।
মান্না মারা যাওয়ার পর শাকিব খান যে সুযোগ পেয়েছিলেন সেটা তিনি পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছিলেন। তাহলে কি এখনকার নতুনদের সুযোগ দেয়ার জন্য শাকিব খানের মরে যেতে হবে? না। এটা কোন সমাধান নয়। শাকিব খান বেঁচে থাকতেই তার বিকল্প নায়ক হিসেবে নতুনদের উঠে আসতে হবে।
একটা সময় শাকিব খানের উত্তরসূরী হিসেবে ছোটপর্দা থেকে আসা ইমন,নীরবকে ধরা হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। তারা যে কয়টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তার কোনটি দর্শকদের হলমুখী করতে পারেনি। অভিনয়ে এমন কোন বৈচিত্র্য দেখাতে পারেনি যার কারনে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে তাদের ছবি দেখবে। এই দু’জনের মধ্যে ইমনের ‘লাল টিপ’,‘জোনাকির আলো’ প্রশংসিত হলেও তার ক্যারিয়ারকে সেভাবে সমৃদ্ধ করতে পারেনি। অন্যদিকে নীরব যেনো সবসময় নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন। ছবি না পেয়ে নিজে প্রযোজক খোঁজার কাজে নেমে পড়েন। সেসব ছবিতে তিনি পারিশ্রমিক নেন না। ছবি ব্যবসারা কমিশন নেন। বলিউড বা অন্যান্য দেশে এই কমিশন নেয়ার রেওয়াজ চালু আছে। এটা ভালো। এসব না করে তিনি যদি অভিনয়ে মনোযোগী হতেন তাহলে ভালো করতেন। তার অভিনয়ের আরও উন্নতি করার জায়গা আছে।
পরবতীতে আরেফিন শুভ,সায়মন সাদিক এবং বাপ্পী চৌধুরির মতো সুদর্শন নায়কের আবির্ভাব ঘটে। সায়মন ও বাপ্পী একই বছরে অর্থ্যাৎ ২০১২ সালে চলচ্চিত্রে অভিনয় আরম্ভ করে। তার দুই বছর আগে আরেফিন শুভ প্রথম বড় পর্দায় হাজির হন। সে হিসেবে আরেফিন শুভি কিছুটা অগ্রজ তাদের তুলনায়। তবে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন ২০১৩ সালে। সে হিসেবে এই তিনজনকে সমসাময়িক ধরলে নেহায়েত ভুল হবেনা।
এই তিনজনকে নিয়ে চুলচেঁড়া বিশ্লেষন করা প্রয়োজন। কারন এই তিনজনের ওপর এখন অনেক প্রযোজক ভরসা করছেন। শাকিব খানের শিডিউল না পেলে প্রযোজকরা তাদের পেছনে ছুটছেন।
সায়মন ‘জ্বি হুজুর’ ছবির মাধ্যমে ক্যারিয়ার আরম্ভ করলেও ছবিটি তাকে সফলতা এনে দিতে পারেনি। তবে ‘পোড়ামন’ ছবিটি তার ক্যারিয়ারের মাইল ফলক বলা যায়। এর পরে তিনি একাধিক ছবি করলেও সেই অর্থে সফলতা পাননি। দূর্বল অভিনয়,সংলাপ বলার ধরন তাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাপ্পীর ক্ষেত্রেও এমনটি। বাপ্পীর অভিনয় দূর্বলতা চোখে পড়ার মতো। সংলাপ বলার ধরন নায়কসুলভ নয়। ‘ভালোবাসার রঙ’ ছবির মাধ্যমে প্রথম রুপালি পর্দায় আসেন। এরপর একের পর এক ছবি করে গেছেন। নিজের অভিনয় দূর্বলতা থাকার পরও তিনি গ্রামের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যথা পেয়েছেন কিছুটা। কাকরাইল পাড়ায় তাকে নিয়ে বেশ আগ্রহ রয়েছে।
এদের তিন জনের মধ্যে আরেফিন শুভকে শাকিব খানের উত্তসূরীদের মধ্যে সব থেকে এগিয়ে রাখা হয়। কেউ কেউ তাকে তার প্রতিদ্বন্দী বলতে দ্বিধা করেন না। আরেফিন শুভর সেই যোগ্যতা থাকার পরও তিনি আশার প্রদীপ জ্বালাতে পারছেন না। জ্বলবে জ্বলবে করেও জ্বলছেনা। তার কোন ছবি সেভাবে আলোচনায় আসেনি। সবশেষ ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবি আলোচনায় এলও তাকে একা কৃতিত্ব দেয়া যাবেনা।
কয়েকমাস হলো সিয়ামের এসেছেন ছোটপর্দা থেকে। প্রথম ছবি ‘পোড়ামন ২’ করে পেয়েছেন সফলতা। দেশব্যাপী প্রেক্ষাগৃহগুলোতে টানা কয়েক সপ্তাহ চলেছে। তাকে কি শাকিব খানের উত্তরসূরী ভাবা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তার আরও কয়েকটি ছবি মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
শাকিব খানের উত্তরসূরি খোঁজার জন্য নতুন শিল্পী অনুসন্ধান প্রক্রিয়া অচিরেই শুরু হতে যাচ্ছে। কয়েকধাপে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিল্পী নির্বাচন করা হবে। এখন কথা হলো যেসব নতুন মুখ ইন্ডাস্ট্রিতে পা রাখবে এক বুক আশা নিয়ে তাদের আশা কতোটা পূরণ হবে? যেখানে পর্যাপ্ত প্রেক্ষাগৃহ নেই,অর্থলগ্নিকারক নেই সেখানে নতুন মুখ এসে কি এফডিসির ক্যান্টিনে বসে চা পান করবে?
তিন।
শাকিব খানের বিরুদ্ধে বরাবর একটি অভিযোগ আছে যে,তিনি নতুন নায়কদের সঙ্গে রাজনীতি করেন। তার সঙ্গে কোন নতুন নায়ক সহ-শিল্পী হিসেবে অভিনয় করলে পোস্টারে তার ছবি রাখতে দেয়না। গান রাখতে দেন না। এমনকি সেই নতুন নায়কের ক্লোজ শট রাখতে মানা করেন। পরিচালকদের তার কথা শুনতে হয়। কারন তিনি প্রভাবশালী নায়ক।
তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কতোটা সত্য সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। তবে একবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না। তার সহযোগীতা পেলে এখন অনেক নায়ক দাঁড়িয়ে যেতো। একতরফা ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার যে ময়দান তিনি তৈরী করেছেন তার খেসারত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে দিতে হচ্ছে।
আর কত বছর শাকিব খান নায়ক হিসেবে অভিনয় করবেন? ধরে নিলাম পাঁচ বছর বা দশ বছর। তারপর তাকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে নতুনদের জন্য। নতুন নায়ক তৈরীতে শাকিব খানের বড় ভূমিকা পালন করা উচিত। কলকাতায় শাকিব খান সর্বসুখ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তা কি তিনি আদৌ খুঁজে পাবেন? এমনও তো হতে পারে তাদের স্বার্থ রক্ষা হয়ে গেলে শাকিব খানকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো!
কলকাতার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করেছিলো বাংলাদেশে তাদের ব্যবসার বড় বাজার রয়েছে। এখন তাদের ধারণা অনেকটা পাল্টে গেছে। বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে কলকাতার ছবি একই দিনে মুক্তি পাওয়ার পরও বাংলাদেশের মানুষ কলকাতার ছবি দেখছে না। তাদের এদেশের মানুষ ড্রয়িংরুমে দেখেই অভ্যস্ত।
কথা বেশি বাড়াবো না। উচিত কথা আওয়াজের মতো মনে হয়। তবে এটা ঠিক শাকিব খানের বিকল্প নায়ক তৈরী না হলে এদেশের চলচ্চিত্রর অবকাঠামো আরও ভেঙে পড়বে সেটা সহজে অনুমান করা যায়। সেজন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে নতুনদের সুযোগ দিতে হবে। প্রথম ছবিতেই সুপার-ডুপার হিট হবে সেটা প্রত্যাশা করা যাবে না। যদিও আপাতত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ প্রযোজক নতুনদের সুযোগ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাইবে না। এর একমাত্র কারন হলো,এদেশে পেশাদার প্রযোজকের অভাব। কারওয়ান বাজার থেকে উঠে আসা প্রযোজকের সংখ্যা বেশি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৭