সকালে গরম গরম ধুমায়িত এক কাপ চা নিয়ে টাটকা টাটকা পেপারটা পড়ার আলাদা মজা।
পায়ের উপর পা তুলে বসে পাতায় পাতায় চোখ বুলানোর ফাঁকে ফাঁকে আলতো চুমুক।
এটা রমিজ সাহেবের প্রতিদিনের এক অপরিহার্য রুটিন আয়েশ।যেদিন কোন কারনে এটা মিস যায় ঐ পুরো দিনটা তাঁর মেজাজ খারাপ থাকে।সেটা সারাদিনের কাজের উপর বাজে একটা এফেক্ট ফেলে ।
আজকেও তাই সক্কাল বেলার পয়লা কাজটা সেরে ফেলতে বসলেন তিনি। মজনু এককাপ হাতে ধরিয়ে দিয়েছ।ওর চায়ের হাত চমৎকার,অল্প কিছুদিনের জন্যেই ওর এই সুবিধাটা ভোগ করা যাবে এটা ভাবতে ভালো লাগে না রমিজ সাহেবের।
একটা টোস্ট বিস্কিট তুলে চায়ে চুবিয়ে মুখে পুরলেন তিনি।মজনুর এই জিনিসটা ভালো, সে নিজ থেকে চায়ের সাথে টায়ের ব্যবস্হা করে দেয়। ভালো জিনিস বেশীদিন কপালে সয় না এটা একদম সত্যি কথা।
আজকের হেডলাইন গুলো দেখতে গিয়ে প্রথমে কুখ্যাত সন্ত্রাসী গালকাটা ইদ্রিসের খবরটার দিকে নজর গেল তার, -না গিয়ে উপায় নেই -লাল লাল হরফে খবরটা পাঠককে মনোযোগ দিতে বাধ্য করার মত করে সাজানো।পুলিশের সাথে গালকাটা ইদ্রিস ও তার সাঙ্গপাঙ্গোর "বন্দুকযুদ্ধ" হবার সময় পালের গোদা ইদ্রিস সবার চোখে ধুলা দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। যে কোন জায়গায় সে আত্নগোপন করে থাকতে পারে। এই সাথে তার একটা ছবি ও চেহারার বনর্না দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে তার কোন খোঁজ কেউ পেলে যেন অবশ্যই পুলিশকে অবহিত করে। একটা বিশাল অংকের পুরষ্কারের ঘোষনাও আছে ধরিয়ে দেবার জন্যে।
লেখার সাথে টপটেরর মহাশয়ের বর্ণাঢ্য জীবনের উপর আলোকপাত করা হয়েছে, সে ইতিহাস পড়লে গা শিউরে ওঠে। রমিজ সাহেব ভাবলেন টাকার অংকটা বিশাল , তাঁর মত একজনের সারা জীবন চলে যাবার জন্য যথেষ্ট কিন্তু টাকা পাওয়ার লোভেও এই লোকের সাথে মোলাকাত করতে কেউ চাইবে না, ঠান্ডা মাথার খুনি সে, এইসব লোকদের ধরবেই বা কে আর পুলিশকে খবর দেয়ার বুকের পাটাই বা কজনের আছে। আজ ধরলে কাল বেরিয়ে আসবে। তখন ?
ইদ্রিসের খবর ছেড়ে বাকি খবর গুলোতে মন দিতে যাবেন ,এমন সময় কলবেল বাজল। মজনু দরজা খুলতে গেল। রমিজ সাহেবের আগের কাজের লোক লোকমান যখন তাঁর স্বল্প পরিমান অস্হাবর সম্পত্তির সম্ভবপর অংশটা চুরি করে গায়েব হয়ে গেল তখন তাঁর পরিচিত টিস্টলের মালিক কয়েকদিন সকালে কিছু কিছু কাজ করে দিয়ে যাবার জন্য দোকানের বয় মজনুকে পাঠিয়েছিল। দয়াপরবশ হয়ে না , এর বিনিময়ে সে বেশ কিছু টুপাইস কামিয়ে নিচ্ছে।এমনিতেই ওসময় দোকানে লোক তেমন একটা থাকে না, তাই খুব একটা লস নেই লোকটার ।তবে এত অস্হায়ী চড়া মূল্যের ব্যবস্হাতে রমিজ সাহেবের চলবে না, তাই দেশের বাড়িতে আলিমুদ্দিকে বলে পাঠিয়েছিলেন একটা লোক যেন দেয়।ওর আজ আসবার কথা, মজনু দোর খুলে যে লোকটিকে ঢোকাল সেই হবে নিশ্চয়ই। ডাইনিং এ বসে দূর থেকে দেখলেন মাথায় ভালো মত গামছা মো্ড়ালো, কাশতে কাশতে ঢুকল লোকটা।এই গরমের দিনে এমন কাপড় মুড়ি দেয়া , জ্বর জারি বাঁধিয়েছে নাকি? মজনুকে রান্নাঘর ঘেষা ডাইনিং লাগোয়া জায়গাটাতে বসাতে বললেন তিনি। 'বাথরুম আর ওর নিজের রুমটা দেখিয়ে দে, লোকটার শরীর খারাপ মনে হচ্ছে , হাতমুখ ধুয়ে আসুক।'
ওর কাছে কিছুক্ষণ পরে গেলেও চলবে।হাত মুখ ধুয়ে ততক্ষণে পাক সাফ হোক।আবার পেপারটা পড়ায় মন দিলেন তিনি।
মজনু কাজে খুব চটপট, অনতিবিলম্ব্বে এসে জানাল, কাজ শেষ।এখন সে যাবে।তা যাক , আটকে রাখার কিছু নেই , কাজ যখন শেষ।অপ্রীতিকর ভাবনাটা মনে এল , ওকে না করে দিতে হবে,নতুন লোক যখন এসে গেছে। আচ্ছা বৈকালিক ভ্রমনের সময় চা খেতে গেলে বলে আসবেন, হিসেবও চুকিয়ে দেবেন। আবার পত্রিকার পাতা উল্টাতে লাগলেন তিনি।
পাতা উল্টানোর ফাঁকে একবার রান্নাঘরের লাগোয়া জায়গাটায় চোখ গেল তাঁর। কি আশ্চর্য! লোকটা দেখি এখনও ওখানেই ঠায় বসে আছে।গামছা খুলে রেখেছে পাশে তাই লোকটার একপাশ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।চাপা চোয়াল, একমাথা ঝাকড়া চুল আর... আর গালের একপাশ বরাবর নেমে আসা লম্বা একটা কাটা দাগ। চেহারার আর কোন ডিটেইলস এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে লোকটার মুখ কেন যেন চেনা চেনা লাগলো রমিজ সাহেবের কাছে। কিন্তু এর মুখ চেনা লাগার কোন কারন নেই , আজই তো জীবনে প্রথম একে দেখলেন তিনি। তাহলে?
মনে ভাবনা চলছে, এমন সময় নজর গেল ফ্রন্টপেজে। গালকাটা ইদ্রিসের চেহারাটার সাথে তাঁর বাড়িতে আগন্তুকের পুরো মিল। শিহরিত হয়ে আবার লোকটার দিকে তাকালেন তিনি,হুঁ কোন ভুল নেই, এ সেই-ই , কাটা দাগটাও মিস নেই , একদম মোক্ষম জায়গাটায়।কি সর্বনাশ!
রক্ত হিম হয়ে গেল রমিজ সাহেবের।টের পেলেন হাতের আঙ্গুল গুলো কাঁপছে।মেরুদন্ড বেয়ে শিরশিরে অনুভূতি।খুব বেশী ভয় পেলে নাকি মানুষের এমনটা হয়, মোটামুটি অকুতোভয় মানুষ রমিজ সাহেব এই অনুভূতির কথা শুধু শুনেছেন আজতক , আজ বাস্তবে পরিচিত হয়ে তিনি খুব একটা যে আনন্দিত হলেন না , তা বলাই বাহুল্য।
এখন তিনি কি করেন? জলজ্যান্ত দুধর্ষ গালকাটা ইদ্রিস তাঁর ঘরে এসে আস্তানা গেড়েছে। বাড়ি মোক্ষম বেছেছে সে, কেননা একাকী মোটামুটি বন্ধুহীন মানুষ রমিজ সাহেবের বাড়ি তার জন্য অতি নিরাপদ আশ্রয়।এ বাড়িতে বাইরের মানুষের আনাগোনা নেই,কিছু ঘটলেও কতদিন পরে লোকে সেটা টের পাবে কে জেনে।
ঐ একই কারনে রমিজ সাহেব আরও বিপর্যস্ত বোধ করছেন। তিনি এখন কি করবেন? কার কাছে সাহায্য চাইবেন?কিভাবেই বা চাইবেন? পুলিশকে জানানো দরকার নিশ্চয়ই । কিন্তু তা করতে গেলেও তো সমস্যা। ফোনে টাকা নেই এবং টাকা ভরতে বাইরে গেলে ইদ্রিস কি তাঁকে যেতে দেবে নাকি? সন্দেহ করছেন বা চিনে ফেলেছেন বুঝতে পারলে বিপদ। তাছাড়া নাম্বারটাও তো তিনি জানেন না মনে পড়ল তাঁর।ঠিক এই মূহূর্তেই টাকাবিহীন থাকার দরকার ছিল নাকি মোবাইলটার! তিক্ত মনে ভাবলেন তিনি।
মজার ব্যাপার হলো এত কিছু ভাবছেন তিনি, মনে চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু চোখ কিন্তু ইদ্রিসের দিকেই ফিক্সড হয়ে আছে তাঁর, ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিতে স্রেফ একেবারে অক্ষম তিনি।
সাপ যখন তার শিকারকে খায় তখন নাকি সম্মোহিত শিকার স্হির শিকারীর দিকে তাকিয়ে থাকে, বাধা দেয় না, সাপ নির্বিঘ্নে তাকে গলাধকরন করে। কতটা সত্য রমিজ সাহেব তা জানেন না, কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হল সত্যি।তিনিও তাঁর সম্ভাব্য ঘাতক ইদ্রিসের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছেন না।
বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলেন গালকাটা ইদ্রিস কোমড়ের কাছ থেকে একটা ছুরি বের করলো।চকচকে ছুরিটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো ক্ষীণ আলোর রেখায়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওটাকে দেখছে ইদ্রিস। কি ক্রুর তার চোখের দৃষ্টি! এইটা দিয়েই সে তার সাম্প্রতিক খুনটা করবে, রমিজ সাহেবকে।
আতঙ্কিত হয়ে ওর দিকে চেয়ে আছেন রমিজ সাহেব, মাঝে কতক্ষণ পার হয়ে গেছে জানেন না তিনি।সময়ের হিসেব নেই হয়ে গেছে তাঁর কাছে।
একসময় তাঁর ভীত দৃষ্টির সামনে গালকাটা ইদ্রিস উঠে দাঁড়ায়। ছুরি নাড়াতে নাড়াতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে সে। ধারালো ছুরিটা থেকে আলো ঠিকরে ঠিকরে ওঠে। আতঙ্কের শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া রমিজ সাহেবের দৃষ্টি নিবদ্ধ না ইদ্রিসের আর না ছুরির দিকে, ওদের উভয়েয় দিকে দৃষ্টিসীমা থাকলেও দৃষ্টি ক্ষমতার মধ্যে নেই।
একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ইদ্রিস। মুখে নিষ্ঠুর কঠিন হাসি , ছুড়িটা ধীরে ধীরে রমিজ সাহেবের দিকে ঘুরিয়ে আনতে থাকে সে........
এই শেষ............
'স্যার একটু সুপারি হবে আপনের তন?'
হতবাক হয়ে "ইদ্রিসের" দিকে তাকান রমিজ সাহেব।কাছ থেকে বুঝতে পারেন মিলটা চেহারায় পুরোপুরি নেই, অমিলের অংশটাই বেশী। পাশ থেকে দেখলে অবশ্যই সেটা অতটা বোঝা যায় না।দেহের গড়নে তো বিরাট অমিল , ছোটখাট একটু গোলগাল গড়নের ইদ্রিসের সাথে লম্বাটে শুটকা এই লোকটার মিল নেই, কিন্তু দেহের দিকে তাকিয়ে তখন কে ভেবেছিল? তিনি তো শুধু মুখই দেখেছিলেন।
আবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করে সে।
'স্যার আমনের কাছে সুপারি থাকলে একটু দিবেন স্যার। ন খাইলে থাকতাম পারি না,একদম নিশা স্যার, শেষ হইয়া গেছে, এখনই লাগব, থাকলে একটু যদি দিতেন ।'
লাজুক হেসে হাতে থাকা শেষ টুকরাটা যত্ন করে হাতের ছুরি দিয়ে কেটে মুখে পুরে সে।
"ইদ্রিসের" হাতের ছুরিটার দিকেও চোখ যায় তাঁর এবার। এই নিত্তান্ত নিরীহ ছুরিটা মানুষ কাটবে কি? একটা ফল কাটার জন্যও তো সে যথেষ্ট না।
এমন ভুল কিভাবে হল তাঁর?এরকমও হয় নাকি মানুষের?আশ্চর্য!
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে টের পান রমিজ সাহেব।
'ইয়ে, তোমার নাম কি?'
মুখ দিয়ে বের হয় তাঁর।
'ইয়াকুব।'
'ইয়াকুব, আমি তো সুপারি খাই না, কাছেই একটা চায়ের দোকান আছে, ওখানে এইসব পাওয়া যায়, ওখন থেকে নিয়ে নিও।'
ইয়াকুব তাকে ভালই বেকুব বানিয়েছে।নিজের বোকামিতে নিজেই লজ্জ্বিত রমিজ সাহেব মনে মনে
ভাবলেন , ভাগ্যিস কেউ টের পায় নি, হাসাহাসি পড়ে যেত, একাকি মানুষের ভালো সুবিধা আছে।আপন মনে মুচকি হেসে ভাবলেন , কয়েক লাখ টাকা পেতে পেতে হাতছাড়া হয়ে গেল তাঁর, সত্যিকারের ইদ্রিস হলে অবশ্য ধরিয়ে দেবার সামর্থ তাঁর থাকতো কিনা সন্দেহ। সে যাই হোক........।
ইস! এমন বোকামিও কখনও কেউ করে?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১০:২৫