somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি ফরহাদ মজহার-এর সিরিজ পোস্ট (৫ম পর্ব) : করোনাভাইরাসের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ - কে নেবে জৈব মারণাস্ত্রের দায়?

০৪ ঠা মে, ২০২০ রাত ৩:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
চতুর্থ কিস্তি এখান থেকে পড়ে আসুন



'নতুন করোনাভাইরাস কোন কৃত্রিম উপায়ে না, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে'--এই কথা আমরা কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মারি শুরুর প্রথম দিন থেকেই শুনে আসছি। বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় দেখলাম স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (The Scripps Research Institute বা সংক্ষেপে Scripps Research) বরাতে একই শিরোনামে একটি খবরও ছাপা হয়েছে।

স্ক্রিপ ইন্সটিটিউট একটি অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বৈজ্ঞানিক মহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেউ কেউ দাবি করেছিল উহানের ল্যাবরেটরিতে জেনেটিক কারিগরির মাধ্যমে এই ভাইরাস চিনই তৈরি করেছে। দুর্ঘটনা বশে বেরিয়ে গিয়ে এই মহা বিপদ ঘটেছে। বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুরু থেকেই এই মতৈক্য ছিল যে কোভিড-১৯ কোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি ভাইরাস না।

তবে তথ্য হিশাবে জানানোর চেয়েও কথাটা বারবার প্রচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জৈব মারণাস্ত্র সংক্রান্ত তর্ককে আড়াল করা, ধামাচাপা দেওয়া। প্রকারান্তরে দাবি করা যে যেহেতু রসায়নাগারে তৈরি হয় নি, অতএব কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র নয়। অথচ এটি জৈব মারণাস্ত্র কিনা কিম্বা কোন দেশ থেকে এই ভাইরাসের উদ্ভব ঘটেছে সেই তর্ক বিশেষ ভাবে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে তীব্র ভাবেই চলছে। কোভিড-১৯ বিজ্ঞানাগারের তৈরি না কথাটার প্রচার এই গুরুত্বপূর্ণ তর্ককেও আড়াল করছে।

আমাদের সকল পক্ষের কথা শুনতে হবে। ল্যাবরেটরির বানানো ভাইরাস নয় বলে কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র নয় বলা যায় না। কিম্বা কোন দেশ থেকে এর উদ্ভব ঘটেছে সেই তর্ক আড়াল করাও ঠিক নয়। কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র হওয়া না হওয়ার সঙ্গে ল্যাবরেটরিতে বানানো বা না বানানোর কোন সম্বন্ধ নাই। ঠিক যে আধুনিক কালে সমরাস্ত্র গবেষণায় ল্যাবরেটরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আজ অবধি যে সকল জৈব মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে তার প্রায় সবই প্রাকৃতিক। তাই আমদের উচিত মার্কিনী প্রপাগান্ডার প্রচারপত্র না হয়ে চিন এবং ইরানের বক্তব্যও পাশাপাশি প্রকাশ করা। পাঠক তার নিজের মতো বুঝে নিক কি হচ্ছে। অনুমাননির্ভর হয়ে বা গালগল্প দিয়ে আমরা আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে পারব না। এই ধারণা ঠিক না যে এটম বোমার মতো জৈব মারণাস্ত্রও শুধু ল্যাবরেটরিতেই বানানো হয়।

অনেকে কেন জৈব মারণাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে চান না, সেটা বুঝি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আমি একমত নই। তাঁরা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে ঘটনাঘটনের ব্যাখ্যা করতে চান না, তাঁদের এই উৎকন্ঠার সঙ্গে আমরা একমত। জটিল বিষয়কে ব্যাখ্যা করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে কিম্বা বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্য জনিত সস্তা অনুমানের কারনে 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' পয়দা হয়।

কিন্তু অন্যদিক থেকে ভেবে দেখুন। জৈব মারণাস্ত্র নিয়ে নিরপেক্ষ আলোচনা পর্যালোচনার অনুপস্থতিও চরম অজ্ঞতা তৈরি করতে পারে। এর ক্ষতি বুদ্ধিবৃত্তিক আলস্যের চেয়েও শতগুণ বেশী ক্ষতিকর এবং বিপজ্জনক। তাই মনে রাখতে হবে এই পর্যন্ত ইতিহাসে আমরা যেসব জৈব মারণাস্ত্রের ব্যবহার দেখেছি তার অধিকাংশই প্রাকৃতিক। ল্যাবরেটরির পয়দা নয়। তাই বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের খবর পাঠ করে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে যেহেতু ল্যারেটরিতে তৈরি হয় নি অতএব কোভিড-১৯ জৈব মারণাস্ত্র না--তারা মহা ভুল করবেন। তথ্যটি জৈব মারণাস্ত্র সম্পর্ক অজ্ঞ ও অসচেতন থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল।

প্রাচীন কালের যুদ্ধের কথাই ধরুন। প্লেগ আক্রান্ত রোগীকে যুদ্ধে কুপে ফেলে প্রতিপক্ষকে বিষাক্ত পানি খাইয়ে প্লেগ আক্রান্ত করা ও পরাজিত করার নজির আছে। প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায় সেটা ঘটেছে। এই ক্ষেত্রে প্লেগ আক্রান্ত লাশ জৈব মারণাস্ত্রের ভূমিকা পালন করেছে। সম্রাট বারবারোসা খ্রিস্টীয় ১১৫৫সালে এই প্রকার জৈব মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। ১৩৪৬ সালে মোঙ্গলরাও প্লেগ আক্রান্ত শরীর দিয়ে প্রতিপক্ষের মধ্যে প্লেগ ছড়িয়ে পরাজিত করতে চেয়েছিল। স্পেনিশরা তাদের দুষমণ ফরাসিদের বিরুদ্ধে রক্তের সঙ্গে কুষ্ঠ রোগীর রক্ত মিশিয়ে তাদের কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত করতে চেয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যরা চিনা গ্রামগুলোতে কম পক্ষে এক হাজার কূপ দূষিত করেছে। তারা দেখতে চেয়েছে কিভাবে কলেরা ও টাইফাস ছড়ায়। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাঁর একটি সাম্প্রতিক লেখায় আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ঢাকার মহাখালির কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কলেরা জীবাণুর মাধ্যমে জীবাণু যুদ্ধের বিস্তারের জন্য ব্যাপক গবেষণা করেছিল। যা এখন আইসিডিডিআর,বি নামে পরিচিত। ভুলে যাবেন না, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থেকেই--অর্থাৎ ষাট দশক থেকেই বাংলাদেশ জীবাণু যুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্র। সেইসব চলে জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার নামে। দাতাদের পয়সায়।

কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর প্রথম দিন থেকেই তর্ক রয়েছে কোথা থেকে এই ভাইরাস এলো। মিউটেশানের মধ্য দিয়ে এর বর্তমান ভয়ংকর রূপের কারন কি? এ নিয়ে চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে তীব্র তর্কবিতর্ক চলছে। ইরান কোভিড-১৯ মহামারিতে বিধ্বস্ত। ট্রাম্প নানান ভাবে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর টালবাহানা করছিল। ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ জারি রয়েছে। ইরানকে এই মহামারির বিরুদ্ধে ভয়ংকর অর্থনৈতিক চাপের অধীনে থেকে লড়তে হচ্ছে।

আজ নিউজ উইক পত্রিকায় দেখলাম পরস্পরকে দোষারোপ করার মাত্রা এখন আগের চেয়ে আরও তীব্র হয়েছে। চিন দাবি করেছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের উৎপত্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর জন্য চিন অনুসন্ধান বা তদন্তের দাবি জানিয়েছে। ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেক্রেটারি আলী শামখানি একটি টুইটার বার্তায় কোভিড-১৯-এর জন্য চিন এবং ইরানকে মহামারী ছড়িয়ে যাবার জন্য দায়ি করার জন্য তীব্র সমালোচনা করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প আরো উস্কানি দেবার জন্য কোভিড-১৯-এর নাম দিয়েছে 'চিনা ভাইরাস'। শামখানির দাবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিন ও ইরানের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে, কারন আন্তর্জাতিক ভাবে জোরদার দাবি উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র ভাইরাস নিয়ে যেসব গবেষণা এতোকাল চালিয়েছে সেই সবের আন্তর্জাতিক তদন্ত হোক। ডনাল্ড ট্রাম্প জৈব মারণাস্ত্র তদন্তের দাবি নাকচ করতে বদ্ধ পরিকর। অতীতে মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের কুকর্মের বিস্তর প্রমাণ রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক তদন্ত খুবই যুক্তিসঙ্গত দাবি। এর আগে চিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র দাবি করেছে কোভিড-১৯ ভাইরাস উহানে মার্কিন সেনাবাহিনীই এনেছে।

বিশ্বব্যাপী বিপর্যয়ের কালে পরস্পরকে ঘায়েল করবার এই প্রচার যুদ্ধকে আমরা নানান দিক থেকে বিচার করতেই পারি। কিন্তু জীবাণু মারণাস্ত্রের প্রশ্নকে ভুলে যাওয়া, উপেক্ষা অরা কিম্বা আড়াল করার মধ্যে বিশ্ববাসীর কোন মঙ্গল নিহিত নাই। সে কারণে জৈব মারণাস্ত্রের প্রশ্ন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জন্ম বা উদ্ভব কোথা থেকে?

চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×