somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি ফরহাদ মজহার-এর সিরিজ পোস্ট (৬ষ্ট পর্ব) : করোনার তথ্য লুকানোর রাজনীতি এবং সরকারের প্রতি অনাস্থা

০৪ ঠা মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
৫ম কিস্তি এখান থেকে পড়ে আসুন



যারা সরকার তথ্য লুকাচ্ছে বলে আওয়াজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে আমি একমত না। তাদের অভিযোগ মিথ্যা সেটা বলছি না। এখন তথ্য লুকানো হোক বা নাহোক সেটা কোন ইস্যুই না। এটাই হবার কথা। জনগণকে বিকল্প নির্ভরযোগ্য তথ্যের কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।

দ্বিতীয়ত সরকারী তথ্যে জনগণের এক তিলও বিশ্বাস নাই। ফলে তথ্য লুকানো হোল নাকি হোল না তাতে কিছুই আসে যায় না। আমাদের বাঁচা আমাদেরই বাঁচতে হবে।

তৃতীয়ত পাশ্চাত্য দেশ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা যা তথ্য পাচ্ছি সেটা সম্পূ্র্ণ তথ্য নয়। এটা বুঝতে পারছি কোভিড-১৯ ভয়ানক একটি ভাইরাস, যার উৎপত্তি কিম্বা উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে যারা জানে তারা তথ্য দিচ্ছে না। দেবে না। শুধু দেখছি চিন কোভিড-১৯ মোকাবিলাকে রীতিমতো যুদ্ধ হিশাবে নিয়েছে। রীতিমতো যুদ্ধ করে আপাতত ঠেকিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন এবং ইরান কভিড-১৯-এর উৎপত্তি নিয়ে ঝগড়া করছে। পরস্পরকে দোষারোপ করার পেছনে আরও বৃহৎ পরিসরে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে। আমাদের অবস্থা হয়েছে মশার মতো। হাতিঘোড়া গেলো তল মশা বলে কতো জল।

তথ্য লুকানো আসল বিপদ না, সরকারকে কেউই বিশ্বাস করছে না, সেটাই মহা বিপদের জায়গা। তথ্য কেন্দ্রীভবন, লুকানো এবং ক্রমাগত মিথ্যা বলার ফলে আতংক তৈরি হয়েছে। মহামারী মোকাবিলা এতে কঠিন হয়ে পড়েছে। সংক্রমণ, অসুস্থতা এবং মৃত্যুর জন্য সরকারকেই নাহয় আমরা দায়ী করলাম। কিন্তু জনগণের আস্থা রয়েছে এমন কোন কেন্দ্রীয় তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা ছাড়া এই মহামারী আমরা কিভাবে মোকাবিলা করব? সঠিক তথ্য সংগ্রহ, যাচাই এবং সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে জনগণকে জানাবার ব্যবস্থা অবিলম্বে গড়ে তোলা না গেলে বাংলাদেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ব।

কিন্তু আমাদের নিজেদেরও কিছু মারাত্মক দোষ আছে। শুধু কোভিদ-১৯ না, আমরা ভান করি আমরা যেন কিছুই জানি না। জেনেও স্টুপিড প্রশ্ন করি।

ধরুন এই তথ্য যে বাংলাদেশে কি আদৌ 'জনস্বাস্থ্য' ব্যবস্থা নামক কোন কিছুর ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট আছে? 'জনস্বাস্থ্য' নামক কোন কিছু বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক, এমনকি ধারণা হিশাবেও 'জনস্বাস্থ্য' আমরা বুঝি কি? তবুও আমি আপনাদের এই ভয়ানক করোনার কালে আরেকবার এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বলব।

না, নাই। যদি না থাকে তাহলে আপনি কিভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করবেন? ঠিকই বলছেন, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণে কয়জন আক্রান্ত হোল এবং কয়জন মরল সেই তথ্য ক্ষমতাসীনরা লুকাচ্ছে। আরে! লুকাবে না কেন? ক্ষমতাসীনদের জন্য তথ্য নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কেন আশা করেন তারা আপনাকে সব বলে দেবে! তাছাড়া তাদের কাছে তথ্য থাকবে কোথা থেকে? 'জনস্বাস্থ্য' ব্যবস্থা থাকলে তথ্য থাকবার সম্ভাবনা ছিল। এখন সরকারি বা বেসরকারি গুজব শুনে সন্তুষ্ট থাকুন।

তাছাড়া তথ্য দেওয়া বা না দেওয়া রাজনীতি ও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। এর মীমাংসা রাজনৈতিক ভাবে বা পালটা ক্ষমতার চ্যালেঞ্জ দিয়েই হতে হবে। আর কোন বিকল্প নাই। সেই হিম্মত জনগণের নাই। ওবায়দুল কাদের ঠিকই বলেছেন, আমরা করোনভাইরাসের চেয়েও অধিক শক্তিশালী। মাশাআল্লাহ, তিনি বলেছেন! এই হিম্মতই বা কার আছে?

তবু বলি, 'জনস্বাস্থ্য' ব্যবস্থা নামক কোন কিছুর ছিটেফোঁটা বাংলাদেশে অবশিষ্ট না থাকা পুরাপুরি ক্ষমতাসীনদের দোষ না। এর জন্যে আমরাও যথেষ্ট পরিমান দোষী। কিছুটা হলেও যা অবশিষ্ট ছিল তাকে যখন ধসিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের বলে কয়ে, আমরা তার বিপদ বুঝি নি। স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট, অবাধ বাজার ব্যবস্থা, ফ্রি মার্কেট, রাষ্ট্রীয় খাতে বিনিয়োগের বিপরীতে ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগ প্রধান করে তোলা এবং বাজারকে সব কিছু সমস্যার উপায় গণ্য করার মাজেজা বোঝার কোন চেষ্টা আমামদের ছিল না। আমরা যারা একটু বোঝাবার চেষ্টা করেছি, বাজার ব্যবস্থার শত্রু কিম্বা কমিউনিস্ট বলে নিন্দিত হয়েছে। এখন কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকের ফল সকলেই ভোগ করুন।

জনস্বাস্থ্যের বাস্তবোচিত ধারণার ক্ষয় এবং 'জনস্বাস্থ্য' ব্যবস্থা বিনাশের জন্য প্রধানত দায়ী আন্তর্জাতিক দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সাহায্য সংস্থা। এই সংস্থাগুলোই বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে উন্নয়নের 'নিউ লিবারেল পলিসি' গিলতে বাধ্য করেছে। এমনকি যে সকল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কম বেশি হোক জনস্বাস্থ্য নিয়ে ভেবেছে সেই সকল প্রতিষ্ঠানকে যথেষ্ট অর্থ দিয়ে সহায়তা করে নি। যেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমাদের, বিশেষত গরিব দেশগুলোকে এখন এই সংস্থাটির ওপরই প্রধানত নির্ভর করতে হয়েছে।

মধুর বাংলায় 'নিউ লিবারেল পলিসি' হচ্ছে কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থা। কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন দায় থাকবে না, এইগুলা বাজারই ঠিকঠাক করে দেবে। খেয়াল করুন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলি নি, দায় বলেছি। অর্থাৎ পুরানা বা প্রাচীন সমাজতন্ত্রীদের মতো বলছিনা এইগুলা সকলের জন্য রাষ্ট্রকেই করে দিতে হবে। না, তা বলি নি। কিন্তু কিভাবে সেটা করা হবে--কতোটা সরকারি কতোটা বেসরকারি -- কিম্বা এই ক্ষেত্রে কি ধরনের বাজার ব্যবস্থা উপযোগী তা নির্ণয় ও নিশ্চিত করার দায় সরকার ও রাষ্ট্রের।

বাজারই যদি সব করে তাহলে হারামজাদা রাষ্ট্রের কী দরকার! দায় না থাকলে জবাবদিহিতা থাকে না। তাই সরকার কেন তথ্য লুকাচ্ছে তার জবাব দেওয়ার জন্য সরকার বাধ্য না। জবাব দেবার দায় থেকে আমরাই সরকারকে নিউ লিবারেল পলিসি মেনে নিয়ে মুক্ত করে দিয়েছি। সরকার আমাদের এখন জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। নিজেদের দোষ আগে স্বীকার করুন।

নিউ লিবারেল পলিসির আগে স্বাস্থ্য একটি সামষ্টিক স্বার্থ রক্ষার বিষয় বলেই আমরা গণ্য করতাম, তাই এখনকার মতো স্বাস্থ্য খাতকে প্রাইভেট বিনিয়োগের খাত গণ্য না করে জনস্বাস্থ্য খাত হিশাবে বিবেচনা করা হোত। অর্থাৎ স্বাস্থ্য এমনই একটি খাত যাকে বাজারের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রকে এই দায় থেকে রেহাই দেওয়ার অর্থ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করবার দায় থেকে রাষ্ট্রকে মুক্তি দেওয়া। সেই হিশাবে সরকারকেও। এই সিদ্ধান্তে আমরা নিজেরাই সম্মতি দিয়েছি। ধরে নিয়েছি স্বাস্থ্য সেবা দেবে প্রাইভেট ডাক্তার, প্রাইভেট ক্লিনিক, প্রাইভেট হাসপাতাল, প্রাইভেট ওষুধ কোম্পানি। অর্থাৎ দেশীবিদেশি ব্যবসায়ীরা। বলাবাহুল্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গুটি কয়েক বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে গিয়েছে।

এখন কান্দো কেন চাঁন্দু? তুমিই না এই পথে নিজের ইচ্ছায় এয়েছো? এবার আমি এসেছি কোভিড-১৯। আমারে ঠেকাও।

চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৫
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×