এই কারণে বক্তারাও ইউটিউবের প্রতি ঝুঁকছে ইদানীং। তারা ইউটিউব দেখছে নিয়মিত। সেখানকার পাবলিক কমেন্টগুলা পড়ছে। এরপর সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী বয়ানের কন্টেন্ট রেডি করে ফেলছে। এটা স্বীকার করার মতো ব্যাপার যে, এদেশের বক্তারা খুব সহজেই ইউটিউব দর্শকদের মানসিকতা আত্মস্থ করতে পেরেছে। যার কারণে ‘বেবি কন্টেন্ট’-এর পর সবচেয়ে জনপ্রিয় কন্টেন্ট হচ্ছে ওয়াজ মাহফিলের ভিডিও।
কিছুদিন আগে শুনেছিলাম, বক্তারা নাকি স্টুডিওতে গ্রিনস্ক্রিন বসিয়ে উন্নত ভিএফএক্স ব্যবহার করছে, তারপর জায়গামতো শ্রোতাদের সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ঠিক, নারায়ে তাকবির—এসব বসিয়ে তাদের প্রতি জনতাদের উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তি জাহির করে ইউটিউবে আপলোড দিচ্ছে। ফলে ইউটিউব থেকে আর্ন করার পাশাপাশি অফলাইনেও নাকি ভালো সাড়া পাচ্ছে!
আর সবচেয়ে আপত্তিকর ব্যাপারটা ছিল, এখনকার ওয়াজ মাহফিলের সংস্কৃতিতে একটা প্রথা চালু হয়ে গেছে, মোটামুটি প্রতাপশালী কেউ হলে বক্তাদের ভুল ধরবে কিংবা তাদের ওয়াজে বাধা দিবে। এই সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বও করছে ইউটিউব। কারণ ধরুন, জনবিচ্ছিন্ন এক গ্রামে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল। সেটার এইচডি ভিডিও পরদিন আপলোড হচ্ছে ইউটিউবে। ফলে এই ভুল ধরার প্রবণতা অনেক প্রতাপশালীর মধ্যেই চাউর দিয়ে উঠছে।
কিছু জায়গায় শুনলাম, এসবও নাকি হচ্ছে স্ক্রিপ্ট রেডি করে। মানে লোকচক্ষুর আড়াল থেকে পূর্ব পরিকল্পনামতোই ভিডিওর ভিউ কিংবা ভাইরাল করার জন্য ওয়াজ মাহফিলে এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে অনেকে। উদাহরণত, একটা পরিচিত ঘটনা বলি, হাফিজুর রহমান সিদ্দিক সাহেবের মাহফিলে যে ছেলেটি ‘ওরে বাটপার’ বলে চিল্লানি দিছিল, সেটা ভিডিও কন্টেন্টের একটি অংশ হিসেবে পুরোপুরি স্ক্রিপ্টেড ছিল।
আর এখন তো বাজারে এসেছে, জুতা নিক্ষেপ। এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এগুলো কিন্তু আগেও ছিল, কিন্তু এগুলোর প্রচার ছিল না। দুয়েকটা জায়গায় ঘটলেও সেখানে সুরাহার মাধ্যমে এর একটা বিহিত করা গেছে। কিন্তু এখন যেটা ঘটছে, সেটা তো রীতিমতো সংস্কৃতি পর্যায়ে চলে গেছে। এর লাগাম কি ধরা যাবে?
আগে একটা মাহফিলের ওয়াজ রেকর্ডিং বাজারজাত হয়ে শ্রোতা-দর্শকদের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সপ্তাহ-মাস লেগে যেত। এখন এইচডি লাইভ হচ্ছে কিংবা ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই ইউটিউবে আপলোড হচ্ছে। যার কারণে দ্রুত বক্তাদের কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে এবং আড়াল থেকে একটা ওয়ায়েজ গ্যাংয়েরও দেখা মিলছে। এই ওয়ায়েজ গ্যাংদের কথা পারস্পরিক অনুকৃতি করা। মাঝেমধ্যে এদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও ইউটিউবে প্রচুর হাস্যরস যোগায় এবং দর্শকরা বিনোদিত হয়। বক্তারা এসবকে তাদের পপুলারিটির স্বাস্থ্যগত উন্নতি বলে মনে করছে!
হক কথা সবাই বলার অধিকার রাখে। তাই মাওলানা মামুনুল হক যা বলেন, রফিকুল ইসলাম মাদানিও তা বলতে পারেন। এতে যদিও নীতিগত কোনো প্রতিবন্ধকতা নাই, কিন্তু অনুকৃতি করতে যেয়ে বিপত্তিটা ঘটছে তখন, যখন বনের ‘ইঁদুর’টি ‘বাঘ’ হবার চেষ্টা করছে। ওয়াজের ময়দানে মাওলানা মামুনুল হক বহুল প্রচারিত এবং আলোচিত। অনেকে তার কন্টেন্ট, আলোচনাসহ বচন ও বাচনভঙ্গি অনুকরণ করতে গেয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন। এটাও হচ্ছে ইউটিউবের কারণে।
ওয়াজের ইখলাসানা ময়দান কি ইউটিউবের এই প্রশ্নবিদ্ধ কামাই থেকে মুক্ত হবে? ওয়ায়েজরা এত এত কন্টেন্টে কথা বলে, ইউটিউবের এডসিন্স থেকে উপার্জিত অর্থের ব্যাপারে কোনো কথা বলে না। এটা নিয়ে কথা বলার সময় তো এখনই। নয়ত এভাবে যদি ইউটিউবের প্রতিনিধিত্বে এদেশের ওয়াজ মাহফিলের সংস্কৃতি চলতে থাকে, তাহলে আগামী প্রজন্ম এই ওয়াজ মাহফিলের দ্বারা নিজের চরিত্র শুধরাতে নাকি বিগরাবে, তা হয়ত ভবিষ্যতেই বলে দিবে।