somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরা : একটি নাটকীয় ইতিহাস - ৫

৩০ শে জুন, ২০১০ রাত ৯:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
দ্বিতীয় পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
তৃতীয় পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
চতুর্থ পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।

ইংল্যাণ্ডেশ্বরী রাণী ভিক্টোরিয়া, ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স থেকে শুরু করে ডিউক অভ ডেভনশায়ার, ব্রিটিশ আর্মির প্রধান প্রমুখ ব্যক্তির সাথে দিন কাটল দ্বারকানাথের। এঁদের ব্যবহারে তিনি অত্যাশ্চর্য হয়ে গেলেন। স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়া তাঁর সাথে দুবার মধ্যাহ্ন ভোজ সেরেছেন। ইংরেজরা যে সত্যি রাজাত জাত, তা তাঁর বুঝতে অসুবিধা হল না।

তিনি আরও বুঝলেন, ভারতে আগত বেশিরভাগ ইংরেজই তৃতীয় শ্রেণীর বণিক ছাড়া কিছুই নয়। তারা ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝেনা। অথচ ইংল্যাণ্ডের লোকেরা কল্পনাও করতে পারবেনা, তাদের জাতভাইরা ভারতীয়দের উপর কতটা বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে। তিনি আরও অবাক হয়ে দেখলেন, বেশিরভাগ ইংরেজই ভারতবর্ষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করে। তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা সে দেশের সংস্কৃতিকে তারা মোটেই খাটো করে দেখেনা। এমনকি এক লর্ড তাঁকে কালীপ্রসাদ সম্বন্ধেও জিজ্ঞেস করেছিলেন!

তবে একটা ব্যাপারে দ্বারকানাথ যেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন, তেমনি হতাশ হলেন। বেলগাছিয়ায় তাঁর প্রাসাদটিকে তিনি মনে মনে যে কোনো ইংরেজ ব্যারন, কাউণ্টের বাসভবনের সাথে তুলনা দিতেন, তাঁর সে ধারণা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। রুচির সর্বোত্তম ব্যবহার ইংল্যাণ্ডের বাড়িতে বাড়িতে দেখতে পেলেন। সেখানে অতিশয় জাঁকজমক নেই, কিন্তু সূক্ষ্ণ রুচিবোধের তীব্র প্রকাশ আছে। এক ডিউকের বাসায় তিনি ফায়ারপ্লেস নামক চমৎকার একটি জিনিস দেখলেন, পাপোষ হিসেবে ভালুকছাল ব্যবহার হতে দেখলেন। অনিন্দ্যসুন্দর সব ফুলের বাগানের কাছে তাঁর লক্ষাধিক মুদ্রা ব্যয়ে নির্মিত বাগান তুচ্ছ মনে হল। তিনি পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখলেন,' অর্থ শুধু উপার্জন ও খরচ করিলেই হয়না, তা ব্যবহার করিবার পন্থা জানিতে হয়, রুচির ব্যবহার জানিতে হয়। আমার মন বলিতেছে ইংলণ্ডের উদ্যানগুলিতে ঘুরিয়া অবশিষ্ট জীবন কাটাইয়া দেই। এখানে কোনোরূপ অশান্তি নাই, কলঙ্ক নাই। সবকিছুই অত্যধিক পবিত্র, অত্যধিক স্নিগ্ধ।'

সবচেয়ে চমৎকৃত করল তাঁকে ইংরেজদের নিজ দেশ, নিজ সংস্কৃতির প্রতি গভীর সম্মান। তারা যে কোনো মূল্যে নিজ দেশের আসবাব, গৃহস্থালি ব্যবহার করে। অতি উৎকৃষ্ট সুগন্ধি এখন লণ্ডনেই তৈরী হচ্ছে, তারা আর ভুলেও ফরাসী সুগন্ধি ব্যবহার করেনা। নিজ বাসস্থানের কথা চিন্তা করে লজ্জা হল দ্বারকানাথের। সেখানে হিন্দুস্থানে তৈরী একটাও আসবাব নেই। তিনিতো দেশীয় জিনিস নিজ ঘরে রাখতে লজ্জাই বোধ করেন। এখানে এসে তাঁর বড় একটি ভুল ভাঙল। এছাড়া ট্রেন নামে সদ্য আবিষ্কৃত এক অত্যাশচর্য বস্তু দেখলেন। বিরাট হাঁ-এর মধ্যে কয়লা গলাধঃকরণ এ বস্তু, তারপর যেন চিবিয়ে চিবিয়ে তা থেকে সব শক্তি নিঃসরণ করে বিরাট এক যান টেনে যায়। কয়লা ভক্ষণের তাপে ট্রেনের উপর দিয়ে ধোঁইয়া ভলকে ভলকে বের হয়। 'আমাদের ভারতবর্ষেও তো এই বস্তুকে স্থাপন ক্রয়া যেতে পারে,' ভাবলেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি ঠিক করলেন, দেশে গিয়েই বড়লাটকে পত্র মারফত প্রস্তাব পেশ করবেন। কোম্পানী সরকার প্রয়োজনে লক্ষাধিক মুদ্রা দিয়ে সহায়তা করবেন।

ইংলিশ নারীদের অবাধ বিচরণ তাঁকে মুগ্ধ করল। পুরুষের পাশাপাশি তারাও সকলে কাজে অংশ নেয়, হাট-বাজারে যায়। পড়াশোনা করে, বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করে। সাহেবদের স্ত্রীগণ অতিশয় মিশুক, তাঁদের আন্তরিকতায় দ্বারকানাথ মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের কন্যারা বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, থিয়েটার নামক অভিনব এক ধরনের নাট্যস্থানে ছেলেদের পাশাপাশি গলা কাঁপিয়ে শেক্সপীয়ার আবৃত্তি করে। সে তুলনায় ভারতের অন্তঃপুরবাসিনীদের কথা চিন্তা করে তিনি আপনমনেই শিউরে উঠলেন।

দেশে ফিরেই তিনি বড়লাট সহ সকল ইংরেজ বড় বড় কর্মকর্তাকে দাওয়াত করে বিরাট এক নৈশভোজের আয়োজন করলেন। দেশীয় পণ্ডিত ও সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও বাদ পড়লেন না। ইংরেজ এবং ভারতীয়দের একই সাথে একই অনুষ্ঠানে দাওয়াত করার ঘটনা সেটিই প্রথম। বিলেত হতে সর্বপ্রথম জীবিত ফেরা মানুষটিকে দেখার উদ্দেশ্যে সকলেই উপস্থিত হল। বড় বড় ইংরেজ কর্মকর্তারা দ্বারকানাথের অভিজ্ঞতার কথা শুনে চোখ কপালে তুললেন। ইংরেজ জাত হয়েও তাঁরা কখনো সরকারী মহলের দেখা পাননি, আর ইনি স্বয়ং ভিক্টোরিয়ার সাথে ভোজ করে এসেছেন! রাণীর সিলমোহরাঙ্কিত বিভিন্ন উপহার দেখেও তারা বিস্ময় প্রকাশ করলেন। দ্বারকানাথের প্রতি ইংরেজদের বেশ সম্ভ্রম জেগে উঠল। বোধকরি শুধু দ্বারকানাথ নয়, সমগ্র ভারতীয়দের প্রতিও তাদের চিন্তা কিঞ্চিৎ হলেও নমনীয় হল।

কিন্তু যখন তিনি বেলগাছিয়ায় আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে শ্যাম্পেন পানের সাথে মৃদু কণ্ঠে খোশগল্পে মত্ত ছিলেন, তখন তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ বেলগাছিয়ার নৈশভোজ থেকে পিতাকে কিছু না বলেই জোড়াসাঁকোয় চলে এসেছেন। বাড়ির উঠোনে একটা আরাম কেদারায় বসে স্থির চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দুচোখ বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে যাচ্ছে। পিতার মতোই দীর্ঘ গড়নের তিনি, গৌরবর্ণ, মুখখানিতে প্রবল পৌরষের ঔজ্জ্বল্য। এমন মুখে অশ্রু মানায় না, কিন্তু তিনি নিজেকে কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারছেন না। "জীবন উদ্দেশ্য কী" প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি রাতের পর রাত নির্ঘুম ছিলেন, অতুল বৈভবের মধ্যে থেকেও ছটফট করেছেন। বিষয়সম্পত্তির ঝনঝনানি, পাখির পালকের বিছানা, পারস্যের সর্বোৎকৃষ্ট শিভাস রিগ্যাল, বত্তিচেল্লীর নগ্ন নারীমূর্তি থেকে তাঁকে নক্ষত্রখচিত নীল আকাশ অনেক বেশি আকর্ষণ করে। অজানা কারও উদ্দেশ্যে তিনি দিনের পর দিনের ক্রন্দন করে চলেছেন। তাঁর মুক্তি চাই। রাজকুমার সিদ্ধার্থের মত মুক্তি। তাই বেলগাছিয়ার মদ, সুরা, বাঈজীর কাছ থেকে দূরে সরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে চলেছেন।
মূলত নিজ চোখের সামনে ঠাকুমাকে মৃত্যু করতে দেখার দেখার পর থেকেই দেবেন্দ্রের পরিবর্তন শুরু হয়।

আজ জীবনের সবচেয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন দেবেন্দ্র। পিতার সাথে তিনি সরাসরি কথা বলবেন। পার্থিব ধন-সম্পদ, জমিদারী, ব্যবসা ত্যাগ করবেন দেবেন্দ্র।

দ্বারকানাথ চুপ সব শুনলেন। মুখের অভিব্যক্তিতে কিছু বোঝা না গেলেও তার অন্তর যে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল, তা দেবেন্দ্র বুঝবেন কিভাবে? ছোটকাল থেকে তাঁর বিপুল সম্পত্তি পরিচর্যার জন্যে দেবেন্দ্রনাথকে পর্যাপ্ত শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন তিনি। তরুণ বয়সে ছেলে একটু আনন্দ ফূর্তি করুক তাঁর আপত্তি নেই, কিন্তু এই বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনায় দেবেন্দ্র যাতে কোনো ভুল না করে, সেজন্যে তিনি নিজে তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন। ব্যবসা, জমিদারি হাতে-কলমে বুঝিয়েছেন। দেশ-বিদেশের সংস্কৃতি বিষয়ে দেবেন্দ্রকে শিক্ষা দিয়েছেন। সেই দেবেন্দ্র আজ বলছে তাঁর কিছুই দরকার নেই! তাহলে এই অতুল ঐশ্বর্য, জমিদারি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কি হবে? নিজ চেষ্টায় তিনি এতোদূর এসেছেন, মৃত্যুর পর দশ ভূতে তা লুটে-পুটে খাবে? পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ তাঁর অন্যতম ঘৃণার কাজ, আর তাঁর পুত্র তা-ই করতে যাচ্ছে? তাঁর সারাজীবনের কষ্টের কোনোই মূল্য নেই?



দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

রাগে, দুঃখে সারাজীবনের মতো বিলেতে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বারকানাথ।

পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১১ রাত ৯:০৪
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেচ্ছাপ করি আপনাদের মূর্খ চেতনায়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৩৮

আপনারা হাদি হতে চেয়েছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন নিরীহ হিন্দু গার্মেন্টস কর্মীর হত্যাকারী।
আপনারা আবাবিল হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়াতে চেয়েছিলেন, অথচ রাক্ষস হয়ে বিএনপি নেতার ফুটফুটে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মারলেন!
আপনারা ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুল পরিবারের প্রশ্ন: উগ্রবাদী হাদির কবর নজরুলের পাশে কেন?

লিখেছেন মাথা পাগলা, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:০১



প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে কাজী নজরুল ইসলামের দেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে। শনিবার বাংলাদেশের স্থানীয় সময় বিকেল ৪টে নাগাদ সেখানেই দাফন করা হল ভারতবিদ্বেষী বলে পরিচিত ইনকিলাব মঞ্চের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×