somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরা : একটি নাটকীয় ইতিহাস - ৪

৩০ শে জুন, ২০১০ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
দ্বিতীয় পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।
তৃতীয় পর্বের জন্যে এখানে ক্লিক করুন।

নীলমণির তিন সন্তান। বড় সন্তানের নাম রামলোচন। পিতার মৃত্যুর পর সব দায়িত্ব এসে পড়ল রামলোচনের ঘাড়ে।

ততদিনে দর্পনারায়ণও ইহধাম ত্যাগ করেছেন। রামলোচন প্রথমেই দুই ঠাকুর পরিবারের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেললেন। দুই পরিবারের সম্পত্তি এক হয়ে পাহাড়সম হল। রামলোচন গৃহকর্তা হলেন।

কঠোর জমিদার হলেও তিনি উদারতা ও সৌখিনতার দিক দিয়ে বেশ ব্যতিক্রম ছিলেন। সারাদিন কাজকর্ম করে অপরাহ্নে ঘুরতে বের হন। আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ-খবর নেন। রুচির দিক দিয়েও অন্যান্য ধনীদের চেয়ে তিনি ব্যতিক্রম। নিছক বাঈজী-নাচনেওয়ালীর নাচ-গানেই সন্ত্বুষ্ট থাকেন না, শ্যামাসঙ্গীত ও ভক্তির গান শোনার জন্যেও তিনি লোক ভাড়া করেন। বোধকরি তাঁর এ উন্নত রুচি-ই পরবর্তীতে অন্যান্য ঠাকুর সন্তানদের রক্তে পরিলিক্ষিত হয়েছিল।

রামলোচনের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। একমাত্র কন্যাটি জন্মের কিছুদিন পর মারা যায়। তাঁর মেজভাইয়ের চার পুত্র। এর মধ্যে তৃতীয় পুত্রটি দেখতে যেমন বেশ, বিদ্যা-বুদ্ধিতেও কম যায় না। স্ত্রী অলকাসুন্দরীর সাথে আলোচনা করে এই পুত্রকে দত্তক গ্রহণ করেন রামলোচন।

মেজ ভাইয়ের সেই তৃতীয় পুত্রের নাম দ্বারকানাথ ঠাকুর।

রামলোচনের বড় ইচ্ছে ছিল দ্বারকানাথকে নিজের মত করে তুলবেন। অন্য দশজন থেকে আলাদা করবেন। কিন্তু দ্বারকানাথের যখন মাত্র তের বছর বয়স, তখন অকস্মাৎ কালাজ্বরে মারা গেলেন রামলোচন।

অলকাসুন্দরী মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন ছেলেকে মানুষ করার দিকে। দ্বারকানাথের আপন বড় ভাই রাধানাথ ঠাকুর তাঁকে শিক্ষাদানের উদ্যোগ নেন। বস্তুত সে সময় ঠাকুর পরিবারের সব আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে সম্পর্ক বেশ মধুর ছিল।

জোড়াসাঁকো ততদিনে অনেক বিস্তৃত হয়েছে। অভিজাত বংশের মানুষেরা এখানে জমি কিনে ঘরবাড়ি করেছেন। সেখানেই শেরবোর্ন নামে এক সাহেবের বাড়িতে খোলা স্কুলে তিনি শিক্ষা লাভ করতে থাকলেন।

অন্য ধাতুতে গড়া দ্বারকানাথ শিক্ষিত হবার পাশাপাশি দক্ষ হাতে জমিদারী দেখাশোনা করতে লাগলেন। অল্প জমিদারী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার পাত্র তিনি নন। সবকিছুতে প্রথম হতে না পারলে তাঁর স্বস্তি হয়না।

তিনি সরকারের অধীনে কিছুদিন দেওয়ানী করেছেন, পরবর্তীতে ল এজেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। পাশাপাশি জমির পর জমি বাড়িয়ে চলেছেন।

তবে দ্বারকানাথ বুঝেছিলেন ব্যবসা ব্যতীত ইংরেজ জাতিকে টেক্কা দেয়া বাঙ্গালীদের পক্ষে সম্ভব না। তিনি যক্ষের ধনের মত জমি আগলে রাখলেন না, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা কাযে লাগালেন। সদ্য শুরু হওয়া ব্যাংকিং, ইন্সিওরেন্সের পাশাপাশি নীল, কয়লা, জাহাজ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলেন। ইংরেজ সরকারও অতিশয় সুদর্শন এই প্রাণচঞ্চল মানুষটিকে সাহায্য করতে কার্পণ্য করল না। কিছু মানুষকে তারা নিজেদের প্রয়োজনেই কাছে রাখতে চেয়েছিল, দ্বারকানাথ তাদেরই একজন। এমনকি কোম্পানীর সাথে যৌথভাবে এক ব্যবসাও শুরু করলেন তিনি। চিন থেকে জাহাজে মাল আনা-নেয়ার ব্যবসা।

উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক নিজে দ্বারকানাথকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ দিলেন তাঁর উদ্যম ও ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে। কোনো ভারতীয়কে বড়লাট নিজে পত্র পাঠাবেন, একথাটা কয়েকদিন আগ পর্যন্তও ছিল কল্পনা। দ্বারকানাথ তা বাস্তবে রূপ দিলেন।

তখন ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন রুস্তমজী কাওয়াস। তিনি অবশ্য সম্পূর্ণ ভারতীয় নন, পারস্য বংশোদ্ভুত। তিনি অগ্নির উপাসক ছিলেন। "রুস্তমজী টার্নার এ্যণ্ড কোং" ছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর পর সর্ববৃহৎ কোম্পানী। দ্বারকানাথ এঁকে পরাস্ত করতে উদ্যত হলেন। জাহাজের ব্যবসায় রুস্তমজীকে টেক্কা দেয়া অসম্ভব, দ্বারকানাথ তাই প্রতিষ্ঠা করলেন "টেগোর কার কোম্পানী"। রক্ত পানি করা পরিশ্রম করে হুহু করে এই কোম্পানীর প্রসার করে চললেন।

এরপর এক বছরের মাথায় রুস্তমজীকে পেছনে ফেলে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হলেন দ্বারকানাথ।



প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর(১৭৯৪-১৮৪৬)




বেলগাছিয়ায় প্রতিষ্ঠা করলেন "বেলগাছিয়া ভিলা"। ইন্দ্রপুরী বললেও যেন তাকে কম বলা হয়। সাড়ে ছয়শত একরের উপর প্রতিষ্ঠিত এ প্রাসাদের সামনের উদ্যানে এঁকেবেকে গিয়েছে স্বচ্ছ ঝিল, সেখানে দেশ-বিদেশের দুর্লভ সব অর্কিড শোভা পায়। ঝিলের মধ্যে দ্বীপমতন স্থান, সেখানে "সামার হাউস"। উদ্যানের ঠিক মধ্যিখানে মর্মর পাথরের ফোয়ারা, সেখানে আলোকসজ্জিত হয়ে তীর হাতে দাঁড়িয়ে প্রেমের দেবতা কিউপিড। বাড়িটির সবচেয়ে ছোট ঘরটিও হলঘরের ন্যায়। প্রতি ঘরে বেলজিয়ামের আয়না, মীর্জাপুরী, পারস্য গালিচায় মেঝে ঢাকা। ঝাড়বাতিতে ঝুলছে কয়েকশ' মোমবাতি। মখমলে মোড়া প্রতিটি চেয়ার, আসবাবপত্র। দেয়ালে দেয়ালে বহুমূল্য চিত্রকলা। পারস্যের সুগন্ধে পুরো বাড়ি ম ম করছে। মোটকথা, বাড়িটিতে ঢুকলে তার মালিকের রুচি সম্বন্ধে সন্দেহ থাকেনা। বড়লাট কিংবা ছোটলাটের বাসভবন ভেবে ভুল করাও অস্বাভাবিক নয়।

রাজা রামমোহন রায়ের সাথে তাঁর চিন্তাভাবনার প্রভূত মিল ছিল। রামমোহনের তুলনায় তিনি ইংরেজদের সাথে আরো বেশি মিশেছেন, ইংরেজদের বর্বরতা তাঁর চোখে আরো বেশি ধরা পড়েছে। তিনি বুঝলেন, জাত-অলস বাঙ্গালী জাতি যুদ্ধবিদ্যায় ইংরেজদের পরাজিত করতে পারবেন না। শিক্ষিত হইয়ে, বিধ্যা-বুদ্ধিতে সমান হয়ে ইংরেজদের সাথে পাল্লা দেয়াই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

এই ইংরেজ জাতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চেনার উদ্দেশ্যে তিনি অকস্মাৎ বিলেত গমন করলেন। পুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাতে ব্যবসার ভার তুলে দিলেন। রাম মোহন রায় ঘটা করে সমুদ্র পাড়ি দিলেও বেঁচে ফিরতে পারেননি। তাই ভারতীয়দের মনে বিলেত সম্বন্ধে বিরুপভাব কমেনি। জেদি, আধুনিকমনা দ্বারকানাথ এসবের ধার ধারেন না । রামমোহন রায়ের পর তিনিই প্রথম "কালাপানি" পার হয়ে নিজ কোম্পানীর জাহাজে করে ইয়র্কশায়ার বন্দরে পৌঁছলেন।

ঠাকুর বংশের রুপকার, কলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনাঢ্য দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেত গিয়েই জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেলেন। সম্পূর্ণ অন্য এক জগত তাঁর সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও তিনি যে এক ছোট্ট কুঠুরীতে বন্দি ছিলেন, তা বুঝতে তাঁর দেরী হল না। হোটেল প্যালিসিয়ায় দৈনিক শত পাউণ্ডের স্যুইটে বসে নিজ ডায়েরীতে লিখলেন,"The life here is such "Live" we hardly imagine... I have to bind my fate with this sparkling life..."

পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১১ রাত ৯:০৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কৃষ্ণচূড়া আড্ডার কথা

লিখেছেন নীলসাধু, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০২



গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কৃষ্ণচূড়ায় আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা।
বছরের একটি দিন আমরা গ্রীষ্মের এই ফুলটির প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রকৃতির সাথে থাকি। শিশুদের নিয়ে গাছগাছালি দেখা, ফুল লতা পাতা চেনাসহ-... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×