somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার মমতাময়ী মা এবং 'বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস'।

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০০১/০২ সালের কথা। চিকিৎসার নিমিত্তে আমার মমতাময়ী মা-কে টাঙ্গাইল মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে নিয়ে গেছি। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার সিরিয়াস ভঙ্গিতে জানালেন যে, উনার ডায়াবেটিস নাকি ১২। আমি তখনো জানিনা যে, ডায়াবেটিসের স্বাভাবিক মাত্রা আসলে কত। কিন্তু যখন আমাদের জানানো হলো যে, মা-কে নাকি কমপক্ষে ৫দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে তখন আমরা মা-বেটা দু’জনেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। বিশেষ করে মা তো হাসপাতালে থাকতে কোনক্রমেই রাজী হচ্ছিলেন না। কিন্তু ডাক্তারদের কড়া হুকুমে অবশেষে মাকে রাজী হতেই হল। সমস্যা আরও প্রকট হলো যখন জানলাম যে, শুধুমাত্র রোগীকেই হাসপাতালে থাকতে হবে। মা আবারও বেঁকে বসলেন। জীবনে কখনো পুরো একটা দিন হাসপাতালে না থাকা আমার মমতাময়ী মা হয়ত ভেবেই পাচ্ছিলেন না যে, ৫দিন একাকী তিনি কিভাবে হাসপাতালে থাকবেন। এবারও উনাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজী হতেই হল।

হাসপাতালে ভর্তি সম্পন্ন হল। অতঃপর বিদায়ের পালা। আমার মমতাময়ী মা ছলছল চোখে গ্রিলের ঐপাশ থেকে আমাকে বিদায় জানালেন। এভাবে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে সাংঘাতিক কষ্ট হচ্ছিল। পা আর সরছিল না। পা যেন মাটিতে আটকে আছে। অবস্থা বেগতিক দেখে এবার মা বলতে লাগলেন, ‘আরে বেটা, মাত্র ৫দিন! এরা (নার্স) আমার দেখাশোনা করবে। তুমি চিন্তা কর না’। অগত্যা পরের দিন আবার আসার কথা বলে একবুক কস্ট নিয়ে পা বাড়ালাম। বারবার পেছন ফিরে মাকে দেখছিলাম। ঢাকায় এসে মনটা একদম বিষন্ন হয়ে গেল। মানসপটে বারবার মায়ের মুখটা ভেসে উঠছিল। রাতে ঘুমাতেও কষ্ট হলো। সত্যিকারার্থেই আমার জন্য সেই রাতটি অনেক দীর্ঘ ছিল।

পড়াশোনা শেষে মাত্রই চাকুরিতে ঢুকেছি। জীবনের প্রথম চাকুরি। হলও ছাড়িনি। যাইহোক, অফিস শেষে মহাখালি থেকে সোজা কুমুদিনীর উদ্দেশ্যে গাড়িতে চেপে বসলাম। দুই-আড়াই ঘন্টায় মির্জাপুরে পৌঁছে গেলাম। মাকে স্লিপ মারফত খবর দিলাম। মা খবর পাওয়া মাত্র উড়ে এলেন যেন! দূর থেকে মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখে কস্ট কিছুটা লাঘব হল। মা আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। অবশেষে মা-বেটার মিলন হল! আমি লক্ষ্য করলাম এরই মধ্যে তিনি বেশ কয়েকজনের সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলেছেন। তাদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবার সাথে আলাপ-পরিচয় হল। আমি মায়ের কাছে ‘হাসপাতালে একরাত্রি’র অভিজ্ঞতা জানতে চাইলাম। মা যা বললেন তার সারকথা হল, তিনি ভাল ছিলেন। কোন অসুবিধাই হয়নি। দুশ্চিন্তা আরও কমল। যাইহোক, রাত ৮টা বাজতেই সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে এলো। আবারও ছলছল চোখে বিদায়। তবে এবার দু’জনেই অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত আচরণ করলাম। পরের দিন আবার আসার কথা বলে বিদায় নিলাম। মা অবশ্য আমার অসুবিধা বিবেচনা করে একেবারে শেষদিন আসতে বললেন। আমি কিছু বললাম না। হলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় এগারটার মত বেজে গেল।

মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও পরেরদিন যথারীতি হাজির হলাম। এইভাবে পরপর চার দিনই গিয়েছিলাম। এই কয়দিনে মায়ের ডায়াবেটিসের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছিল। পঞ্চমদিনে প্রেসক্রিপশান, অনেক নিয়ম-কানুন পালন করার প্রতিজ্ঞা করিয়ে মাকে রিলিজ দেয়া হলো। মাকে বাড়ি চলে গেলেন। তিনি নিয়ম মত চলতে লাগলেন।

সেই সময় থেকেই আমার মায়ের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হল। পরিমিত খাওয়া-দাওয়া, হাঁটাহাঁটি করা ইত্যাদি সবই করতে হল। তিনি চরম সংসারী মানুষ। একবেলাও উনাকে ছাড়া চলে না। তবু শত কাজের মাঝেও তিনি প্রতিদিন হাঁটতেন, নিয়মিত ঔষধ খেতেন। সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলার যথাসাধ্য চেস্টা করতেন।

এভাবেই ভাল চলছিল মায়ের জীবন। প্রথম ৫/৬বছর তেমন একটা সমস্যা দেখা দেয়নি। সমস্যা দেখা দিল যখন শারীরিক দূর্বলতার কারণে মায়ের হাঁটতে সমস্যা হল। এ সময় ঔষধের সাথে নতুন করে যোগ হল ইনসুলিন। পরিমিত খাওয়া-দাওয়া, হাঁটাহাঁটি, নিয়মিত ঔষধ সেবন, মাসিক ভিত্তিতে ডায়াবেটিস সেন্টারে গমন ইত্যাদি করে আরও কয়েক বছর চললেন তিনি। ডায়াবেটিসের কারণে দিনে দিনে মায়ের অন্যান্য উপসর্গগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল। ডায়াবেটিসের মাত্রাও মাঝে মাঝে ভয়ানক রকম বেড়ে যেত। আমরা তখন ভয়ে শুকিয়ে যেতাম। এভাবে এক পর্যায়ে উনার জীবন সত্যি অসহনীয়, অসহ্য হয়ে উঠল। অবশেষে ২০১৪ সালের মে মাসে আমাদের প্রাণপ্রিয় মা রোগ-শোকের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহে আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়ে অনন্তকালের দিকে যাত্রা করলেন। হে দয়াময় আল্লাহ! মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আমিন।



এখনও ডায়াবেটিস রোগীদের হাঁটতে দেখলে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। তখন মনের অজান্তেই চোখটা ভিজে উঠে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। তখন আমি অনবরত “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগীরা” পড়তে থাকি। বয়স্ক সকল মানুষের মাঝে আমার মাকে খুঁজে বেড়াই। হে দয়ার আল্লাহ! রোগ-শোকে ভোগা অসহায় মানুষদের প্রতি তুমি দয়া করো।

আজ বুধবার ১৪ই নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। সেজন্য আমার মায়ের কথা আবারও মনে পড়ে গেল। সবাই আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।

সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২২
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×