জাকাত’ আরবি শব্দের অর্থ যথাক্রমে: পবিত্র, ন্যায়পরায়ণ, সাধু, ধার্মিক, সত্যপরায়ণ, সত্যবাদিতা, পূর্ণতা; অতঃপর: ভিক্ষা, দান ও কর (ইছলামিক আইন)। ‘জাকাত’ অর্থ: বস্তু নির্যাস, প্রবৃদ্ধি ও বরকত। [দ্র: আরবি-ইংরেজি অভিধান; জে. এম কাউয়ান; আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান; মা. মুহিউদ্দীন খান]
উল্লিখিত আভিধানিক অর্থের আলোকে প্রচলিত জাকাতের অর্থ অস্পষ্ট বা নিষ্ক্রিয়। কিন্তু তার ব্যাখ্যা-তফসীর সক্রিয় যে, বছরের অর্জিত ও জমাকৃত সোনা-গয়না ও অর্থ সম্পদের ২.৫০% (শিয়ামতে ২০%) শতাংশ নিকট গরিব আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী ও এতিম, অসহায় মিসকীনদের প্রদান করা। যা উল্লিখিত প্রধান অর্থের সঙ্গে সঙ্গত নয়। জে. এম. কাউয়ান শেষের ৩টি অর্থ যথা: ভিক্ষা, দান লিখে ব্রাকেটে ‘ইছলামী আইন’ লিখেছেন। অর্থাৎ উল্লিখিত অর্থ ২টির পক্ষে অভিধানের কোনো ভিত্তি নেই, তবে শরিয়তের কথিত পারিভাষিক ভিত্তি আছে। যদিও আমরা ‘জাকাত’কে ভিক্ষা, দান বা কর হিসেবে স্বীকার করি না। কেননা ‘জাকাত’ দেয়ার আগে বা পরে ভিক্ষা ও দান অহরহ করা হয় এবং নিয়মিত করও দেয়া হয়।
অর্থাৎ জাকাতের উল্লিখিত ব্যাখ্যা ও দলীয় পরিভাষা (বিকৃত) ব্যতীত তার কোনো অর্থই স্বীকৃত নয়। উল্লিখিত মুহিউদ্দিন সাহেব যে অর্থ তুলে ধরেছেন তা কাউয়ান সাহেবের প্রণীত অর্থের সঙ্গে সঙ্গত নয়; উপরন্তু প্রচলিত প্রয়োগ-পদ্ধতির সঙ্গেও অসামঞ্জস্য।
‘জাকাত’ কী! কেন দেই! তার বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী! কোরানে তার হার নির্দিষ্ট নেই কেন! চিরকাল সকলের জন্য এর পরিমাণ নির্দিষ্ট কেন! ইত্যাদির কোনো সহজ, সরলার্থ না-থাকলেও শরিয়তের ৫ম স্তম্ভ রূপে শোভা বর্ধন করছে।
কোরানে ‘জাকাত’ শব্দটি বেশ কিছু আয়াতে আছে; কিন্তু অনুবাদে দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ‘ছালাত’ শব্দের সঙ্গে ‘জাকাত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে তার অনুবাদ না করে বরং হুবহু ‘জাকাত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে:
১. ইউকিমুনাচ্ছালাতা অ ইউতুনাজ্জাকাতা...। [৫: মায়েদা-৫৫] অর্থ: ছালাত কায়েম করে ও জাকাত দেয়।
২. অ আকিমুচ্ছালাত অ তুজ্জাকাত...রাকেইন [২: বাকারা-৪৩] অর্থ: এবং নামাজ পড় এবং জাকাত দাও...।
৩. অ আকামাচ্ছালাতা অ আতাজ্জাকাতা... [২: বাকারা-১৭৭] অর্থ: ছালাত কায়েম করলে ও যাকাত প্রদান করলে...।
৪. অ আকামুচ্ছালাতা অ আতুজ্জাকাতা... [২: বাকারা-২৭৭] অর্থ: ...ছালাত কায়েম করে এবং জাকাত দেয়...।
পক্ষান্তরে ‘ছালাত’ শব্দটি ব্যতীত অন্য শব্দের সঙ্গে ‘জাকাত’ যেখানে ব্যবহৃত হয়েছে, সেখানে তার অর্থ করা হয়েছে ‘পবিত্র‘ (যথার্থ):
১. অ ইউআল্লেমুল কেতাবা অল হেকমাতা অ ইউজাক্বীহিম...। [২: বাকারা-১২৯] অর্থ কেতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে।
২. ইয়াতলু...ইউজাক্বিহিম [২: বাকারা-১৫১] অর্থ: আমাদের বাণীসমূহ তোমাদের নিকট আবৃত্তি করে ও তোমাদিগকে পবিত্র করে।
৩. ইউযাকুনা-ইউযাক্বি মাইয়াশা-উ-। [৪: নিছা-৪৯] অর্থ: তুমি কি তাদের দেখেছ? যারা নিজেদেরকে পবিত্র বলে দাবি করে? তা অবান্তর ধারণা মাত্র। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে পবিত্র করেন-।
৪. ক্বাদ আফলাহা মান তাজাক্বা। [৮৭: আলা-১৪; ৯১: শামস্-৯] অর্থ: সাফল্য লাভ করবে যে পবিত্রতা অর্জন করে।
উল্লিখিত দুটি উদাহরণের প্রথমটিতে জাকাত অর্থে ‘২.৫০% টাকা পয়সা’ এবং দ্বিতীয় উদাহরণে জাকাত অর্থে পবিত্র; অর্থাৎ একই শব্দের পরস্পর অসামঞ্জস্য অনুবাদের কোন ব্যাখ্যা বা ফুটনোটও নেই।
মূলত জাকাত শব্দের সঠিক অর্থ হল পবিত্র; ‘অ আকিমুচ্ছালাত অ তুজ্জাকাত’ অর্থ: প্রার্থনা (নামাজ) বলবৎ রাখ এবং পবিত্র হও; অর্থাৎ প্রার্থনা অনুযায়ী কর্ম করলেই পবিত্রতা অর্জিত হয়। ২.৫০% অর্থ প্রদানের কথা কোরানে নেই। বরং কোরানের বিপরীতে হারাম সম্পত্তি রক্ষার অপকৌশল মাত্র। প্রার্থনা (নামাজ) মানেই চাওয়া-পাওয়ার আবেদন নিবেদন। প্রার্থনার বক্তব্য, আশা-আকাক্সক্ষা কর্মে বাস্তবায়ন করলেই পাপ খণ্ডন হয়ে পবিত্র হওয়া যায়।
একটি ছোট্ট উদাহরণ লক্ষণীয়
চোর চুরি করে অপবিত্র বা দোষী হয়, অতঃপর আইনের ভয়-ভীতি, শোক-তাপ নিয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত্র থাকে, কখন ধরা পড়ে যায়; তাই হৃদয়-ভরা হাহুতাশ, জ্বালা-যন্ত্রণা নিয়ে সর্বদা পালিয়ে বেড়ায়। কিন্তু সে যদি সহসা মনিবের বাড়ি গিয়ে চুরির সম্পদ ফেরত দিয়ে অথবা মনিবের গুণ কীর্তন করে ক্ষমা চায়, আর চুরি না-করার শপথ করে এবং তা পরবর্তী জীবনে রক্ষা করে চলে, তবে সহসাই তার শোক তাপ, ভয়-ভীতি, হৃদয়ের সমূহ জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণের মতো নির্ভয়, নিষ্কলুষ ও সজীব হয়ে ওঠে; অন্তত সে চুরির বিষয় ধার্মিক হয়ে ওঠে; তাকে আর শোক-সন্ত্রস্ত অবস্থায় পালিয়ে বেড়াতে হয় না। তখন মনিবের রোষানল এমনকি দয়ায় পরিণত হয়। এর নামই ‘আকিমুচ্ছালাত অ তুজ্জাক্বাত।’ স্তুতিবাদ, আনুগত্য ও শপথের নাম নামাজ এবং তা রক্ষা করে চললেই পবিত্র হওয়া সম্ভব বটে!
পবিত্র হওয়ার অন্যতম প্রধান সূত্র হল: ‘অল হেকমাতা অ ইউযাক্বিহিম’ অর্থ: এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, কলা-কৌশল আয়ত্ত করে পবিত্র হবে।
বাস্তবিকই জ্ঞান-বিজ্ঞান-সূত্র ও কলা-কৌশল শিক্ষায় মানুষের অভাব ও চাহিদা পূরণ করে থাকে বলেই মক্কার ১ মাসের পথ ৪ ঘণ্টায় এসেছে, গুহা জঙ্গলের মানুষ আজ অন্য গ্রহেও হাত বাড়িয়েছে; জ্ঞান-বিজ্ঞানের দান কাগজে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। যাবতীয় অভাব, অজ্ঞানতা, অলস-কর্মবিমুখতাই অপবিত্র, কলঙ্ক ও নাপাক হেতু কোরানে বিশ্বস্ত ও সৎ পরিশ্রমীদের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছে। [৯৮: বাইয়েনা-৭]।
অতঃপর প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থসম্পদ চূড়ান্ত অপবিত্র ও হারাম। অতিরিক্ত অর্থসম্পদ অপ্রয়োজন, এটা শোষণ ও সুদব্যবসাকে ইন্ধন যুগিয়েছে, ব্যক্তি ও সমাজকে অভাবী করে রেখেছে, উন্নয়নে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে। এই অতিরিক্ত সম্পদই আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর অভাব, শোক, তাপ, হাহাকার অবশেষে শত্রুতার রূপ নেয়, অতঃপর সমাজে অশান্তি ও জীবনের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
...অ ইয়াছালুনাকা...তাতাফাক্বারুন। [২: বাকারা-২১৯] অর্থ: ...লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, কী তারা ব্যয় করবে? বল! যা অতিরিক্ত। এভাবে আল্লাহ্ তার বিধান তোমাদের জন্য পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করো।
আয়াতটির আলোকে মুছলিম বা নিবেদিত, আদর্শবানদের জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ ছাড়া প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ সম্পদ ধারণ তথা আরাম আয়েশ, ভোগবিলাসের অধিকার নেই। প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থসম্পদ মানেই অন্যের সম্পদ, যার নেই বা প্রয়োজন তার। এজন্য মহানবী স্বয়ং এবং তার ছাহাবাগণ স্ব-স্ব অতিরিক্ত অর্থসম্পদ সরকারি মালখানায় জমা দেন। এমনকি অনেক ছাহাবা ছিলেন যারা সমূহ ধন-সম্পদ বায়তুল মালে জমা দিয়ে মানবেতর জীবন ধারণ করেন। কথিত হয় যে, মহানবী প্রশ্ন করলেন, ‘নিজের জন্য কী রেখে আসলে?’ উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ ও তার নবীই আমাদের জন্য যথেষ্ট!’ এভাবে প্রতি বছর স্ব-স্ব অতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ বায়তুল মালে জমা হতে থাকে; আর তাই বলে মাত্র ২৩ বছরের মধ্যেই আরব বেদুঈনদের মধ্যে সম্পদের ঘৃণ্য প্রতিযোগিতা স্তব্ধ হয়ে সমতা, ত্যাগ ও সেবার প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হয়; জনগণের জন্মগত অধিকার খাদ্য বাসস্থান ও নিরাপত্তার সমতা স্থিতিশীল হয়। ফলে দলে দলে লোক ইছলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে থাকে; রাজ্যের সীমানা ত্বরিত বেগে প্রসারিত হতে থাকে; যা মুষ্টিমেয় আরবদের কথিত ও কাল্পনিক ২.৫০% শতাংশ জাকাতে কোনোদিনও সম্ভব ছিল না। দ্বীনের নবী বিবি খাদিজাকে বিয়ে করে আরবের শ্রেষ্ঠ ধনী হন, পক্ষান্তরে তার ওফাতের পর সহায়-সম্পত্তি হিসাব করে পাওয়া যায়: ১টি তরবারি, ১টি উষ্ঠ্রী, ১টি বর্ম, একটি অঙ্গুরী ও ১/২টি জামা আর একখণ্ড দানপ্রাপ্ত জমি।
অতএব প্রয়োজনাতিরিক্ত হারাম ধন-সম্পদ ত্যাগ না করা পর্যন্ত, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবদের সাহায্য-সহযোগিতা তথা অভাব পূরণ না করা পর্যন্ত জীবনভর নামাজ রোজা, আকার-আকৃতিতে মহানবীর নকল সাজা এবং হাজার হজ্জেও জাহান্নামের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এসম্বন্ধে কোরানের বজ্রকঠিন হুশিয়ারি লক্ষণীয়:
১. আরাইতাল্লাজীনা...মাউন। [১০৭: মাউন:১-৭] অর্থ: তুমি কি তাকে চিনো? যে ধর্মকে অস্বীকার করে? সে ঐ ব্যক্তি যে অসহায়দেরকে অন্যায়ভাবে তাড়িয়ে দেয়! অভাবীদের অভাব পূরণ করে না! অতএব শোচনীয় অবস্থা সেই নামাজীদের, যারা নিজেদের নামাজ সম্বন্ধে বে-খেয়াল! এরা শুধু নামাজের অভিনয় (লোক দেখানো) করে! এরা পাড়া-প্রতিবেশীদের সাহায্য-সহযোগিতা করে না।
২. আল...আনিন্নাঈম। [১০২: তাকাছুর ১-৮] অর্থ: তোমরা অর্থ-সম্পদের প্রতিযোগিতায় মৃত্যু পর্যন্ত মোহগ্রস্ত হয়ে থাকো। না ! শীঘ্রই তার শাস্তি ভোগ করবে। পুনঃ হুঁশিয়ার করি! অবশ্যই তার শাস্তি ভোগ করবে। বোধোদয় হলে অবশ্যই উপলব্ধি করতে। অতঃপর সেদিন অর্জিত ধন সম্পদের বিষয় অবশ্যই অভিযুক্ত করা হবে।
৩. অইলুল্লি কুল্লি...ফী আমাদিমুম্মাদ্দাদাহ। [১০৪: হুমাযাহ: ১-৯] অর্থ: কঠিন শাস্তি প্রত্যেকের জন্য যে ঘরে-বাইরে পরনিন্দা করে এবং যে ধনসম্পদ কুক্ষিগত করে ও বার বার গুনে দেখে। সে ধারণা করে, অর্থ-সম্পদই তাকে রক্ষা করবে! কিন্তু তা কখনই সম্ভব নয়। সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায়! হুতামা কী তা জানো? তা আল্লাহর তৈরি যন্ত্রণা, যা হৃদয়ের জ্বালা। নিশ্চয়ই তা তাদের কঠিনভাবে ঘিরে ধরে।
৪. অল আদিইয়া...মায়েজিল্লাখাবীর। [১০০: আদিয়াত: ১-১১] অর্থ: ধাবমান অশ্ব-মানুষ অবশ্যই তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ এবং এটা সে অবশ্যই অবহিত। এবং সে সম্পদ প্রতিযোগিতায় বিভোর...।
পক্ষান্তরে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, আলেম, পীর, ব্যবসায়ী, সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মুছলিম-অমুছলিম (সকলে নয়) সেবার নামে, রাজনীতির নামে, ধর্মের নামে জীবনের যাবতীয় ধর্ম-কর্মের নামে রাশি রাশি সোনা গয়না, অর্থসম্পদের প্রাসাদ-পাহাড় গড়ে তুলেছেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ক্ষমতা ও অর্থের প্রতিযোগিতায় মত্ত রয়েছেন। তারা ভাবেন অর্থসম্পদই তাদের রক্ষা করবে। যদিও তারা জানেন যে, শান্তি-অশান্তি, জীবন-মৃত্যু একই ঘরে, একই দেহে পাশাপাশি বাস করে।
আতশ, বাত, আব ও খাক বা আলো, বাতাস, পানি ও মাটির তৈরি মানুষ; দিনমজুর হোক আর রাজা-বাদশাই হোক উভয়ের দেহের উপাদান এবং চাহিদায় তিলপরিমাণও পার্থক্য নেই; দুটো অন্তর, দুটো পেট-পিঠ কারো নেই; সকলের হৃদয়ে একাকার আল্লাহর বাস; অতএব প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ-সম্পদ ধারণ, অসম বণ্টন, ভোগ-বিলাসীদের মুছলিম দাবি অবৈধ। সবিশেষ করে প্রকৃতির দান আলো, বাতাস, মাটি, পানি ভোগে বস্তি-গাছতলা আর বিশ তলার পার্থক্য ধারণ চরম কুফুরি। প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদগুলো পীর-মুরশিদ বা নেতাগণ সৃষ্টি করেন না এবং এ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যও চূড়ান্ত হারাম।
একজন মানুষের দরকার ১ বা ২টি কক্ষ পক্ষান্তরে সে ব্যক্তি সামাজিক দুর্বলতার সুযোগে দখল করেছে ২০, ৫০ বা ১০০টি তাই ১০০ জন আপন জ্ঞাতি-গোষ্ঠির আশ্রয় নিতে হয়েছে বস্তি বা গাছতলায় অথবা বাধ্য হয়েছে চোর, ডাকাত, ঘুষখোর বা সন্ত্রাসী হতে। কিসের যুক্তি এবং কোন্ অধিকারে বেতন-ভাতার পার্থক্য হয় হাজার থেকে লক্ষ টাকায়! বিশ তলা থেকে গাছ তলা! সর্বত্রই অন-ইছলামিক অসম বণ্টনের ফলে আপন কক্ষ এমনকি ক্রয় করার অধিকারও চিরতরে হরণ করেছে।
প্রধানত বঞ্চিত সম্পদ বিনয় করে চাইলে হয় ভিক্ষুক, না বলে নিলে হয় চোর, জোর করে নিলে হয় ডাকাত এবং এদের শাস্তি তৎনগদ! কিন্তু ধর্মের নামে, জনগণের মুক্তির নামে, সেবার নামে যারা প্রয়োজনাতিরিক্ত এবং অন্যায়ভাবে অযথা রাশি রাশি অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, রাশি রাশি অর্থ দেশ-বিদেশে পাচার করছে! জন্মগত অধিকার পুনরুদ্ধারে ভিক্ষুক, চোর, ডাকাত হতে যারা ক্ষেত্র তৈরি করেছে! তারা কোরানের আলোকে নিমকহারাম, মোনাফেক, প্রতারক ও ভণ্ড কাফের! অথচ তারা সকল সময় যাবতীয় আইনের উর্ধ্বে থাকে।
ইছলামিক বা শান্তিবাদী রাষ্ট্র অথবা স্বাধীনতার অর্থ যোগ্যতা অনুযায়ী দায়িত্ব-কর্তব্যে পার্থক্য যাই-ই থাক কিন্তু ভোগের চুলচেরা সমাধিকার জরুরি; দায়িত্ব যত বাড়ে অধিকার, ভোগ তত কমতেই হবে, এটাই নেতৃত্বের প্রধান মাপকাঠি। প্রত্যেক রাছুল-নবীই তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে প্রধানত সমগ্র মুছলিম দেশের নেতাদের দায়িত্ব যত বাড়ে অধিকার ও ভোগ বাড়ে তার লক্ষ-কোটি গুণ বেশি। যে যত সম্পদশালী সে তত বড় নেতা; যে যত বড় নেতা সে তত সম্পদশালী।
এ মুহূর্তে কয়েক টুকরা সাদা কাপড় আর সাড়ে তিন হাত জায়গার অধিকারের কথা স্মরণ করে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মাথাপ্রতি স্থান ও আয়ের সমতা রক্ষা করলে বুলেটপ্র“ফ গাড়ির দরকার হয় না; তালা-চাবির প্রয়োজন হয় না; সৈন্য আর গোলা-বারুদের পিছনে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি সম্পদ ও মনুষ্যরক্তের অপচয় হয় না। ইসরাইল-প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর আর ধর্ম সমস্যাসহ আন্তর্জাতিক সকল সমস্যা মুহূর্তের মধ্যে সমাধা হওয়া সম্ভব।
মহানবীর সময় ছাহাবাদের স্ব-স্ব অতিরিক্ত সহায়-সম্পত্তি বায়তুল মালে জমা হতো অতএব তারা ২.৫০% শতাংশ জাকাত কোথা থেকে দিতো! তা ভেবে দেখা দরকার। এরপরেও যদি কেউ বলেন যে, ‘অবশ্যই মহানবীর সময় ২.৫০% শতাংশ জাকাত নামে অর্থ প্রদানের বিধান ছিল এবং ছাহাবাগণ তা প্রদান করতেন; যা বায়তুল মালে জমা হতো।’ তাদের ভেবে দেখা দরকার যে, ঐ ২.৫০% শতাংশ জাকাত দেয়ার পরে আমাদের মতো পুনঃ ট্যাক্স দিতো কিনা! যদি না দেয় তবে আমরা ক্রয়-ট্যাক্স, বিক্রয়-ট্যাক্স, সম্পত্তি ট্যাক্স, আয়-ট্যাক্স ইত্যাদি নানা ধরনের জাকাত দিয়ে থাকি, যা একুনে ২.৫০% শতাংশের অনেক অনেক উর্ধ্বে এবং যা বায়তুল মালেই জমা হয় এবং জনগণের জন্যই তা ব্যয়িত হয়। অতঃপর রোজার শেষে পুনঃ ধর্মের নামে ২.৫০% শতাংশ জাকাত দেয়ার তাৎপর্য কী!
কোরানের মতে প্রকৃত মুছলিমদের সামান্যটুকুও প্রয়োজনাতিরিক্ত সহায়-সম্পত্তি থাকতে পারে না। অতএব তারা কোথা থেকে কথিত জাকাত দেবে! কোথা থেকে মুক্ত হস্তে মসজিদ-মাদ্রাসায় অগ্রিম দান করে বেহেস্তের জায়গা ক্রয় করবে! কোথা থেকে পীর-নেতাদের বাড়ি-গাড়ি, উড়োজাহাজ ভাড়া, এতিমদের দোহাই দিয়ে সদ্কা-ভিক্ষা করা; অতঃপর সংসার পালনের নজরানা, সম্মানী ও অফুরন্ত ভোগ-বিলাসের যোগান দেবে! যেহেতু কোরানে তা নিষিদ্ধ ও হারাম [২: বাকারা: ১৭৪-১৭৬]।
অর্জিত ও জমাকৃত অতিরিক্ত হারাম অর্থ-সম্পদের বছরান্তে ২.৫০% শতাংশ দান করে, বাকি ৯৭.৫০% শতাংশ হারাম সম্পত্তি হালাল করার সূত্র আল্লাহ-রাছুলের সঙ্গে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
কোরানের ইংরেজি অনুবাদে কোথাও জাকাত ‘চ্যারিটি’ বলা হয়েছে। যার মূলার্থ নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত ত্যাগ বা সাহায্য করা। কাদেরকে করবে, তা-ও কোরানের অসংখ্য আয়াতে উল্লেখ আছে, [দ্র: বাকারা-১৭৭] অবশ্যই মসজিদ আর পচা লাশের প্রাসাদ করার জন্য নয়! নেতা, পীর-ইমামের ভরণ-পোষণের জন্য নয়।
কোরান সাম্যবাদের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্ব-স্ব জ্ঞান, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সৎ ও প্রচণ্ড পরিশ্রম; সকলের অধিকার পেট ও পিঠ পর্যন্ত সমানে সমান। পক্ষান্তরে প্রতিষ্ঠিত ২.৫০% শতাংশ জাকাতের ছায়াতলে হারাম অর্থ হালাল করার সহজ পন্থা উদ্ভাবন করত ভোগ-বিলাস ও পুঁজিবাদ কায়েম করে বিশ্বময় শোষণ ব্যবস্থা পাকা পোক্ত করেছে।
মুদ্রার প্রচলন হয়েছিল মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য, কল্যাণ হচ্ছেও। কিন্তু পুঁজিবাদ, সুদ, শোষণ ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিষ্ঠায় এই মুদ্রা শ্রেষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। ফলে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ জন্মগত অধিকার, পেট ও পিঠের প্রয়োজন থেকে বঞ্চিত রয়েছে। মুদ্রাব্যবস্থা আদর্শবান সুশীল সমাজে প্রযোজ্য! সুতরাং এ মুহূর্তে অন্তত কিছুকালের জন্য হলেও মুদ্রাব্যবস্থা রহিত করলে সমাজের অসহায়, দুর্বল, গরিবদের হারানো অধিকার পুনঃফেরত পেতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতো এবং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদব্যবসাও রহিত হতো।
পীর, ইমাম-নেতাগণ এক্ষণে তাদের কাড়ি কাড়ি অবৈধ ধনসম্পদ ত্যাগ করে অতঃপর অনুশোচনা, অনুতপ্ত হয়ে ‘নিবেদিত’ অর্থাৎ মুছলিম হয়ে ত্যাগ, সেবা ও জ্ঞানের প্রতিযোগিতা করলে, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মহানবীর প্রতিষ্ঠিত শান্তিবাদী রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বিচিত্র নয়।
আজকের যাবতীয় জনসেবা, রাজনীতি তথা ধর্ম-কর্মের প্রধান ও মূল লক্ষ্য অর্থ-সম্পদের প্রতিযোগিতা। এই অর্থের সীমিত ভোগ ও সমঅধিকারের সীমানা নির্ধারণ করতে পারলে খুন-গুম, অন্যায়, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা ও ঘুষসহ সমাজের ৯০% শতাংশ যাবতীয় অনাচার নির্মূল হতে পারে।
জামাতের মতো একটি সু-শৃংখলিত দল এমন দর্শন বাস্তবায়নে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসা উচিত। তাদের সে সুযোগ আছে, অন্তত নিজ দলের রোকন পর্যন্ত কোরানিক বিধানটি বলবৎ করতে পারলে, দেখা যেত মহানবীর সময়ের মতো দলে দলে লোক স্বতঃর্স্ফূতভাবে জামাতের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে। কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ নয়, ঘৃণ্য রাজনৈতিক ইস্যুও নয়; বিদেশি ভিক্ষারও দরকার হয় না; বরং অর্থপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ, নীরব আত্মিক জিহাদ। ইছলাম বা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অন্যান্য দল-উপদলগুলিও শেষ বারের মতো বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে পারে