somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শান্তি কর বরিষন নীরব ধারে....

১৭ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলায় শিখেছিলাম কবরস্থানের পাশদিয়ে যাওয়ার সময় এই দোয়াটি পড়তে হয়-"আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুরি ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম আনতুম সালাফুন ওয়া নাহনু বিল আছারি..." স্বভাবতই অভ্যাসের বশে আমি কবরস্থানের পাশদিয়ে যাওয়ার সময় এই দোয়াটা পড়তাম। তেমনি ভাবে কোন শ্মশানের পাশদিয়ে যাওয়ার সময়ও একই দোয়া পড়তাম। আমার শিশুমনের যুক্তি ছিল এই, যেহেতু কবরখানায় শায়িত মৃত মানুষের আত্মার শান্তির জন্য এই দোয়া পড়তে হয়, সেহেতু একই দোয়া শ্মশানের মৃতদের জন্যও প্রযোজ্য। ঘটনাক্রমে একদিন শ্মশানের পাশদিয়ে যাবার সময় আমি হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙিতে একই দোয়া পড়লাম, সাথে ছিল আমার বয়সে বড় এক চাচাতো বোন। সে আমার এহেন কুকর্ম (তার দৃষ্টিতে) দেখে থু থু দিতে দিকে ধিক্কার দিলেন। আমি তাকে আমার যুক্তিটা বললাম ঠিকই কিন্তু কতটা সে বুঝতে পেরেছে বা আমি কতটা বুঝাতে সক্ষম হয়েছি জানি না। সে বাড়ি ফিরে দাদির কাছে নালিশ দিল। দাদীর কাছে সেদিন ঝাড়ি খেয়ে কথা দিতে হল আর কোনদিন এমন কাজ করব না। কিন্তু আমি করেছি....

আমার/আমাদের শৈশব কেটেছে মামাবাড়িতে। আমার মা'রা ছিলেন চার বোন চার ভাই। মামাদের গ্রামে পাশাপাশি বসবাস করত মুসলিম, হিন্দু(মূলত জেলে), বৌদ্ধ এবং কয়েকঘর খ্রিষ্টান। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি মামাদের বন্ধু বলে যারা বাড়িতে আসতেন তাদের অধিকাংশই হিন্দু, বড়ুয়া। তারা ঘরের ছেলের মতই মামাদের সাথে একই বিছানায় থেকেছেন বহুদিন, একই থালাবাসনে খাবার খেয়েছেন। সেজ মামা আর রঞ্জন মামাকে দেখে মনে হত সহোদর। আমার নানী ছিলেন জাঁদরেল মহিলা। কিন্তু এসব ধর্ম, জাতফাতের ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি দেখিনি কোনদিন। খালাম্মার সাথে কিংবা মামার সাথে যেসব অমুসলিম বন্ধু-বান্ধবীর সখ্য নানী তাদের মামাদের থেকে আলাদা করে দেখেছে এমনটা দেখিনি। ছোটমামার সাথে এক হিন্দু বন্ধু আসতেন পরবর্তীতে সে পরিবারের সাথে আমাদের যে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় তা দেখে পাড়ার অনেকেই রীতিমত ঈর্ষা করত। ঈদ, পূজা-পার্বণে সকল ধর্মের মানুষ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। রঞ্জন মামা গরুর মাংস খেতেন, নানিকে দেখেছি তাঁর জন্য বাটিভরতি গরুর মাংস রেখে দিতে।
আমার নানী হজ্ব করেছেন, নামাজ না পড়ে ভাত খেতে তাঁকে দেখিনি কোনদিন, ঘরের সকল ছেলেমেয়ে, বউদের নামাজ পড়া ছিল বাধ্যতামূলক । আবার সে নানীই পাড়ার মাছ বিক্রি করতে আসা জেলে মহিলার সাথে রান্নাঘরে বসে গল্প করতে করতে আপ্যায়ন করেছে। আমার বড়মামা, মেজমামা একাধিকবার হজ্ব করেছেন। তাদের দেখিনি কোনদিন কাউকে দেখে নাক সিঁটকাতে !

বাবু দিলুতোষ চৌধুরী-আমার শিক্ষক; মানুষ হিশেবে আমার আদর্শ। আমাদের বাংলা এবং সমাজ বিষয়ে ক্লাস নিতেন। আমার হাইস্কুলে পড়ার সময়কালীন অদ্ভুত কারণে তিনি আমাকে পিতৃস্নেহ দিয়েছেন। তাঁকে ভালবাসত না এমন ছাত্র-ছাত্রী সে স্কুলে ছিল না। আমার এই যে এপর্যন্ত আসার পেছনে জীবন শুরুর যে পিলার সেটা তিনিই গড়ে দিয়েছেন। আমি বলি- জীবন আসলে কারো একার নয়; অনুভূতি একার, জীবনের ভেতরকার প্রাণটা একার। জীবনটা আসলে টুকরো টুকরো করে অনেক মানুষের। একটা জীবনের পেছনে অনেকের অবদান মিশে থাকে। আমি স্যারকে এ জীবনের অংশ হিসেবে জেনে এসেছি। যেদিন স্যার ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন সেদিন দ্বিতীয়বারের মত পিতৃবিয়োগ হয়েছে আমার। অথচ স্যার ছিলেন হিন্দু.....

স্কুল থেকে কলেজ অব্ধি আমাদের বারো জনের একটা বন্ধু সার্কেল ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল অমুসলিম। বিভিন্ন সংকটকালে তাঁরা আমার পাশে ছিল, সে কথা ভুলবার নয়। খাতা-পেন ফুরিয়ে গেছে তো কেউ একজন নিয়ে এসে হাজির। পিকনিকে যাব তো সবাই মিলে আমার ভাগের টাকাটাও দিয়ে দিয়েছে নীরবে। মিল্টনের যেদিন ক্যান্সার ধরা পড়ার খবর শুনলাম নামাজে বসে মোনাজাতে তার জন্য কেঁদে কেঁদে রোগমুক্তির জন্য দোয়া করেছিলাম, আমার মনে আছে। অথচ মিল্টন ছিল বড়ুয়া। আজ অনেকদিন তাদের সাথে যোগাযোগ নেই, কিন্তু তারা আছে, মনের মধ্যেই....

ব্যক্তিগত অনেক যন্ত্রণা বহন করি আমরা। মানুষের জীবনে সুখকর সময় খুব স্বল্প, তখন তারাবাবুর মতো বলি-"জীবন এত ছোট ক্যানে"। আবার হতাশা ভর করে যখন, তখন মনে হয় জীবন এত বড় কেন, এত দীর্ঘ কেন? সে ব্যক্তিগত জ্বলুনি আরো বাড়িয়ে দেয় যখন সমসাময়িক ঘটনাগুলোর খবর দেখি, শুনি। স্বেচ্ছামৃত্যু তখন উপগত হয় মস্তিষ্কের কোষে। আমার জন্ম এদেশে। এদেশ নিয়ে আবেগের কোথাও কমতি নেই। ক্রিকেট দল যখন জেতে তখন আমিও আনন্দে ঘুমাতে পারি না। হারলে স্নায়বিক দুর্বলতা নিয়ে পায়চারি করি। যখন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের খবর শুনি তখন আমিও গর্বিত হই; তনু ধর্ষনের মতো ঘটনাদি আমাকেও মর্মাহত করে। তখন আমার ধর্মানুভুতি নয়, কেবল মানুষানুভূতিতে আঘাত লাগে। ঘুমাতে পারি না। তখন রঞ্জন মামা, মিল্টন, দিলুস্যার এদের কথা মিনে পড়ে। তারাও আমার কাছের, খুব কাছের...

এ দেশে সাংবিধানিকভাবে এদেশে বেঁচে থাকার অধিকার আছে প্রতিটি নাগরিকের। এ দেশে আমার জন্ম। একইভাবে রঞ্জন মামা, দিলু স্যার, মিল্টন, এদের জন্মও এদেশে। জন্মসূত্রে তারাও এদেশের নাগরিক। যে বৌদ্ধ ভিক্ষুর গলাকাটা লাশ পড়ে ছিল এদেশ তারও, যে শিক্ষককে জনসম্মুখে কানধরে ওঠবস করিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়েছে এদেশ তাঁরও। আমার আপনার মতো তাদের উচ্ছ্বাস কোন অংশে কম নয় এদেশকে নিয়ে।

আজ হিন্দুরা সংখ্যায় অবিশ্বাস্য হারে কমে যাচ্ছে, সীমান্তের কাঁটাতার ডিঙিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছে তারও নিশ্চয় কারণ আছে। তার কারণ আমি, আপনারা। এই রাষ্ট্র...

আমরা দেখি ধর্মীয় সংখ্যালঘু হবার কারণে সামান্য ছুঁতোয় কীভাবে হিন্দুবাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ নিজের জন্মস্থান ছেড়ে, ভিটেমাটি ছেড়ে যখন ভিনদেশ যায় তখন তাদের ভিতরের ক্ষতটা দেখতে যদি পেতেন তবে হয়তো বুঝতেন। হিন্দুরা সামান্যকিছু টাকা জমা হলেই ওপারে গিয়ে জমি কেনে। কারণ তারা জানে তাদের নিয়তি কানে ধরে ওঠবস করা। তারা জানে যে কোন ছুঁতোয় তাদের ঘরে, দোকানে অগ্নিসংযোগ ঘটানো হবে।

এদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু নাগরিকের সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্র সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনায়াসে হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রী ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধের দায় চাপিয়ে লেখক ও ব্লগার হত্যাকে পরোক্ষভাবে জায়েজ করে দেন। এটাও আমাদের দেশ, নাগরিকের ভালোবাসার দাম এভাবেও দেয়া হয়....

যাদের ক্ষমতা আছে তারা অভিমানে দেশ ছেড়ে চলে যায়। আমি খুব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে বালিশের তলায় হাত দিয়ে দেখি চাকরিটা আছে কি না! আমার মতো যারা তাদের অনেকের দেশ ছেড়ে যাবার ক্ষমতা নেই; শুধু প্রত্যাশা আছে দেশটায় শান্তি আসবে, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব। যারা দেশ ছেড়ে যায় তারাও মনে মনে ভাবে দেশে শান্তি এলে তারাও একদিন স্বদেশে ফিরে আসবে। এই প্রত্যাশা দেশকে ভালবাসার তুলনায় অতি সামান্য।
অনেক হল, ধর্মান্ধতার, এর-ওর ঘাড়ে দায় চাপানোর রেলগাড়িটা এবার থামান। এবার অন্তত খুনিদের বিচার করেন, শিক্ষক লাঞ্ছনাকারীদের শাস্তি দিন। মানুষদের শান্তিতে ঘুমাতে দিন, স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিন। এমন হলে আপনাকে গদি থেকে নামাবে এ সাধ্য কার!
নইলে সবকিছুর শেষ আছে জানি। কোথাও থামতে তো হবেই। নয়তো কেউ না কেউ থামিয়ে দেবে! আপনি থামাবেন না কি অন্য কেউ (সমষ্টিগত) থামাবে সিদ্ধান্ত আপনার.....


রিমঝিম আহমেদ

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৬ রাত ২:০১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×