মন যখন সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়াতে চায় তখন চোখ বুজলেই স্মৃতির পাতায় ভীড় করে সবুজ পাহাড়।পাহাড়ী গা বেয়ে বয়ে চলা ঝর্না, আর অঝর ধারায় বৃষ্টি।কিন্তু শীতের এই প্রারম্ভে বৃষ্টি কোথাও নেই,আছে হেমন্তের হালকা বাতাস।আর সেই বাতাস গায়ে জড়িয়ে ছুটে চলেছে চার চাকার শ্যামলী বাস সার্ভিস।সীতাকুন্ড ছেড়ে বাস ঢুকে পড়ছে বান্দরবানের পাহাড়ি পথে,একটু একটু করে যেন হাওয়া বদলাতে শুরু করল।হীম হীম পরশ ,সাথে বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ আওয়াজ খেলা করছে অনবরত।নীচের দিকে তাকালেই দেখা যায় বিশাল খাদ, চালকের একটু অসর্কতায় হতে পারে অনেক বড় বিপদ।কিন্তু পাহাড়ের মানুষ বেশ দক্ষ এই আঁকা বাঁকা পথ সামলাতে।আমি সর্বক্ষনের ভ্রমণ সঙ্গী অদ্রিকে বুকে চেপে ধরলাম,কিন্তু মেয়ে আমার বানর খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত।ওকে বলেই ফেলেছিলাম –বান্দরবান যাচ্ছি।সে নিজেই কম্বলসহ ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি- তাহলে আমিও বানর দেখতে যাব।তাই সাথে নিলাম কাছের বন্ধুকেও,বান্দরবানে মেয়েকে নিয়ে বানর খোঁজা চারটি খানি কথা না।
এবার আর ভুল করিনি,যাবার আগেই শহরের সব চাইতে অভিজাত হোটেল হিল ভীউতেই বুকিং দিয়েছি।জেনে নিয়েছি এখানকার সব চাইতে দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে ,যদিও ঝর্না দেখা এবারো হবে না।তবুও মেঘলা,ঝুলন্ত সেতু,নীলাচল-টাইগার হিল,শাপলা চত্বর,স্বর্নমন্দির-এই সব বাদ রাখা যাবে না।সময় বাঁচানোর জন্যেই একটি জীপ ভাড়া করে নিলাম সারাদিনের জন্য।হোটেল রুমে পা রেখেইতো আমরা মহা খুশী –এখানেতো ১০ থেকে ১২ জন অনায়াসে থাকা যাবে তাও মাত্র ২০০০ টাকায়।বড় বড় ডাবল বেড প্রতিটি রুমে।এই মুহূর্তে সব চাইতে বেশী মিস করতে আরম্ভ করলাম আমার কলেজের বন্ধুদের,সময় মিলিয়ে এক সাথে হওয়া আসলেও খুব কঠিন।যাই হোক,অদ্রি এত বড় ঘর পেয়েতো ডিগবাজি খেতে লাগলো।আমি ঘরের ভেতর একটা সফেদ বাদর দেখতে পেলাম।
হিল ভীউ থেকে মেঘলা না গিয়ে প্রথমেই গেলাম স্বর্ন-মন্দীরে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে।যারা এস এ অলীকের হৃদয়ের কথা সিনেমাটা দেখেছেন,তারা জায়গাটি নিশ্চই চিনতে পারবেন।এই মন্দিরে আদৌ কোন সোনার প্রলেপ আছে কিনা ,সেটা আমি উদ্ধার করতে পারিনি। মন্দিরটি দেখেতে সোনালী রঙের হওয়ায় সবাই একে স্বর্ণ মন্দির নাম আখ্যায়িত করে।প্রায় ৫০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই মন্দিরে কোন এক বৌদ্ধ এসে উপাসনা করেছিলেন সেই থেকে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।সাদা টাইলস দিয়ে বিছানো পুরো মন্দির,সবাইকেই খালি পায়ে উঠতে হয়।আর মূর্তি গুলোকে ছুঁয়ে দেখা নিষেধ থাকলেও দু’একটার গায়ে হাত লাগানোর লোভ সামলানো সত্যি কঠিন।মন্দিরের বাইরের অংশে ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠে তিব্বত, চীন, নেপাল, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভূটান, মায়ানমার,কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশের শৈলীতে সৃষ্ট ১২টি দন্ডায়মান বুদ্ধ আবক্ষ মূর্তি এখানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।এমন চমৎকার কারুকার্য যারা করতে পারে তাদের মনের ভেতর অসাধারন কল্পনা প্রবনতা আমাকে সত্যি ঈর্ষান্বিত করে।দুপুরের ঠাঁটা পড়া রোদ একদম মাথায় ,তবু আমার ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক থামেনা।এখানে দাঁড়িয়ে পুরো শহরকেই একসাথে ফ্রেমে বাঁধা যাচ্ছে- পূর্বদিকে বান্দরবান শহর ও চারপাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। মায়ানমার থেকে শিল্পী এনে এটি তৈরি করা হয়। এইসব উপাসনালয়ে এলেই মনে কেমন প্রশান্ত হাওয়া বয়ে যায়।প্রত্যেকটা বৌদ্ধ মূর্তিতে আলাদা রকম আবেদন আছে।আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী ফটোসেশন শেষ করে চলতে শুরু করলাম মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের পথে।
প্রায় ১০ কিলোমিটার উথাল পাথাল পথ এক টানে নিয়ে গেল ড্রাইভার বাবু।আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-তোমার ভয় লাগে না,বাঁকে গাড়ি ঘোরানোর সময়?তার নির্লিপ্ত উত্তর-অভ্যাস হয়ে গেছে।আমি চোখ বন্ধ কইরাও চালাইতে পারি।আমি বললাম-থাক,তোমার কারিশমা অন্য দিন দেখাইও,এখন চোখ খুইলাই চালাও।সঙ্গে বাচ্চা আছে।বলতেই হয়,পাহাড়ে যারা উপজাতি তাদের ব্যবহার অনেক শীতল ,কিন্তু পাহাড়ি বাঙ্গালী-এক কথায় ডেঞ্জারাস।
এই ডেঞ্জারাস বাবু এই ডেঞ্জারাস পথ দিয়ে আমাদের নিরাপদেই মেঘলায় নামিয়ে দিল।প্রথমটা মেঘলা সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারনা ছিল না,ঝুলন্ত একটা সেতু আছে তা জানি।কিন্তু আরো আছে একটি মনোরম কৃত্রিম হ্রদ, শিশু পার্ক, সাফারী পার্ক, পেডেল বোট, চিড়িয়াখানা, পিকনিক স্পট ।কিন্তু যতো হাঁটি পথ আর শেষ হয় না,তাও ইট বেছানো রাস্তা,পা একটু পিছলে গেলেই দফা রফা।এই দফা রফার মধ্য দিয়েই আমরা লাফাতে লাফাতেই নামলাম ,কিছু পথ যাই আর দেখি –ঝিল ভরা পানি,রাজ হাঁসের অনাবিল ছুটে চলা,আর নুয়ে পড়া সবুজ গাছের ঝির ঝির পাতা ।সব মিলিয়ে বনের পথে মেঘের আনা গোনা-মেঘলা দিনের কাব্য।আর এই ছো্ট বনেই বাচ্চাদের জন্য ছোট্ট একটা পার্ক বানানো হয়েছে যদিও কলেজ পড়ুয়া বুড়ো শিশুরা তাতে দুলছে।অদ্রি একটা দোলনা পেয়েই মহা খুশি,কে জানে তাকে আর এখান থেকে ফেরানো যাবে কিনা।মেঘলা রেস্ট হাউজে রাত্রিযাপনের জন্য চারটি কক্ষ রয়েছে। প্রতিকক্ষের ভাড়া ২০০০ টাকা ।
শুধু ঘোরঘুরি করলেইতো আর হবে না,পেটের ভেতরতো কিছু দিতে হবে।আমিতো ১০০ % মাছে ভাতে বাঙ্গালী,আর পাহাড়ী চালের গন্ধ আমাকে ভীষন টানে।কিন্তু আশে পাশে এমন কোন হোটেল নেই,কেবল চিপ্স আর চকলেটের দোকান।মেঘলা পেরিয়ে কিছু দূর বাঁয়ে মোড় নিয়েই দেখলাম এদেরই একটা রেস্টুরেন্ট।প্রচন্ড ক্ষিদে নিয়ে অপেক্ষা করছি,কিন্তু ওয়েটারের কোন খবর নেই।খুব ভালো হতো সকালেই হোটেল থেকে খিচুরী করে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লে।খেতে গিয়ে যদি নীলাচলের সূর্যাস্ত মিস করি তাহলে আমার এতো কষ্ট সবটাই মাটি হবে।
“অনেক সাধনার পরে পেলাম ওয়েটারের মন”-তাও কেবল সবজি আর ভাত দিতেই আধ ঘন্টা।বিল করতে আরো বিশ মিনিট,প্রায় ঘন্টা খানেক এই রেঁস্তোরাতে কাটিয়ে পথ শুরু হলো নীলাচলের দিকে।গাড়ি যখন উপর দিকে খাড়া পাহাড়ের পথে উঠতে থাকে তখন মনে হয় কোন এক গহীনে ডুবে যাচ্ছি,হাত বাড়ালেই কাশের ক্ষেত ছোঁয়া যাচ্ছে,ছোঁইয়া যাচ্ছে লজ্জাবতী।এখানে চোখে পড়লো অনেক রকম উপজাতির বসবাস,এতো উঁচুতে কিভাবে তারা ঘর করে থাকে তা সত্যি এক বিরাট বিস্বয়।খুব সিরিয়াস অসুস্থ হলে হাসপাতাল অব্দি পৌঁছুতেইতো জীবন শেষ হবে পথে।অবশ্য এদের যা সংগ্রামী জীবন,তাই হয়তো এমন কোন অবস্থার সম্মুখীন সবাইকে হতে হয় না।যাবার পথে অনেক গুলো স্কুল চোখে পড়লো,বোঝাই যাচ্ছে আমার দেখা ১০ বছর আগের সেই বান্দরবান এখন আর নেই।
নীলগিড়ি গিয়েছিলাম তা প্রায় ছয় বছর ,ওটাতো প্রায় ৩৫০০ ফুট উঁচুতে।কিন্তু নীলাচল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুট উঁচু ,তবুও মনে হচ্ছে সূর্য বুঝি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলেই যাবে।কিন্তু না,ডেঞ্জারাজ বাবু ঠিকি রাইট টাইমেই আমাদের নীল আঁচলে বিছানো পাহাড়ের বুকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্কিং করলো।নিজে্র চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার-এতো সুন্দর।আমাদের দেশ এতো সুন্দর ! যতো দূর চোখ যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড় ,মেঘগুলো যেন নীল শাড়িতে নিজেকে রাঙ্গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে।নিলগিড়ির মতোন এখানে হাত দিয়ে মেঘ ছোঁয়া না গেলেও দেখা যায় আকাশ জুড়ে নানান রঙের খেলা।পড়ন্ত বিকেলের সোনা ঝরা রোদ যেন আলিংগনে ঢেকে রেখেছে পুরো টাইগার হিল,আর শত শত মানুষ বিকেলের রোদ মাখতেই মেতে উঠেছে আড্ডায়।আবার ঈর্ষায় চোখ জ্বলে গেল –কে বানিয়েছে এমন সুন্দর ঝুল বারান্দা?কার মাথায় এলো এমন প্রাকৃতিক পরিকল্পনা-এক কোনায় দাঁড়িয়ে পুরো পৃথিবীটাকে বুকের মধ্যে বন্দী করা যায়।অদ্রিতো অদ্রি,সাথে আমিও যেন হয়ে গেলাম উড়ন্ত প্রজাপতি-এমন স্নিগ্ধতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল স্বপ্নেই ভাবিনি।কিযে শান্ত একটি পাহাড় ,বুকের ভেতর সাজিয়ে রেখেছে অসাধারন সৌন্দর্য।নৈসর্গের অনাবিল মেলবন্ধনে আমার ক্যামেরা বাঁধা পড়ে গেল।পশ্চিম আকাশে ঢোলে পড়া সূর্যটা ক্রমশ আড়ি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে,চারপাশে কোলাহল যেন বেড়েই চলেছে।তবুও মন চায়-সন্ধ্যা না নামুক।এমন করেই কেটে যাক একটি স্বর্গীয় বিকেল।কেউ যদি পূর্নিমায় গা ভাসাতে চান তাহলে পর্যটনের দুটো কক্ষ নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন সারা রাত।
এবার সময়ের অভাবে দেখতে পারলাম না-বগালেক ,রিনুক ঝর্না আর থানছি নাফাকুম ঝর্না।তবে ওই সব জায়গা দেখতে হলে কেবল সময় না,অনেক শক্তি সংগ্রহ করেই যেতে হবে।কারন,এক একটা পাহাড় পাড় হতে হবে পায়ে হেঁটেই,এতো ভিতরে কিন্তু জীপ যাবে না।তাই সময় নিচ্ছি ,অনেক হাঁটা হাঁটির অভ্যেস করতে হবে।নিজের দেশ না দেখে অন্যের দেশ দেখতে চাওয়াটাতো সত্যি বোকামী।আর যেখানে এমন চমৎকার দৃশ্য দেখতে কোন পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না।এটাতো আমারই বাংলাদেশ।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকার পান্থপথের মোড় থেকেই আছে শ্যামলী ,এস আলম আর সেন্টমার্টিনের এসি, নন এসি সার্ভিস।ভাড়া ১৫০০ টাকার মধ্যেই।আর কেউ যদি চট্রগ্রামে একটু ব্রেক নিয়ে নিতে চান তবে সুবর্ন এক্সপ্রেসে যেতে পারেন।ওখান থেকে এক ঘন্টা পর পর পূর্বানী ছাড়ে বান্দরবানের পথে।ভাড়া ১১০ টাকা।বান্দরবান থেকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে যাবার জন্য ভাড়ায় গাড়ী পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের জীপ এবং চান্দের গাড়ী বাস টার্মিনালের কাছেই পর্যটকদের জন্য সার বেধে অপেক্ষমান থাকে সকাল থেকে। একদিনে রাজবাড়ী, মেঘলা, নীলাচল, চিম্বুক, স্বর্ন মন্দির, শৈলপ্রপাত, নীলগিরি ইত্যাদি দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য চার-পাঁচ হাজার টাকায় একটি গাড়ী ভাড়া নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেনঃ শহরের মাঝেই বেশ কিছু ভালো ও মাঝারি মানের হোটেল আছে।আর পর্যটনের মোটেলের সুব্যবস্থাতো থাকছেই।তবে হোটেলে বসে খাওয়া দাওয়ার পর্ব সাড়ার পক্ষ পাতি আমি না।কারন এতে খরচ বাড়ে আর অনেক কিছুই অদেখা রয়ে যায়।রূপসী বাংলার খাবারের মান খারাপ না হলেও অত্যাধিক দাম,আমার পছন্দ হয়েছে তাজিং ডঙ্গের খাবার ,থানার ঠিক পাশেই।আর মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের ভেতরে যে রেস্টুরেন্ট আছে ওইটাতে গেলে সোজা গলা কেটে রাখবে।তাই রেস্টুরেন্ট সিলেকশনের ব্যাপারে খুব সাবধান।
পরিশেষে,যাদের মনের কোনে এখনো দার্জিলিং দেখার অপূর্ন স্বাদ রয়ে গেছে তারা আগে বান্দরবান ঘুরে আসুন।নিজের দেশের সৌন্দর্য গায়ে মেখে তবেই না যেতে হবে পরের বাড়ির মিঠা খেতে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:০১