থানার সীমানা প্রাচীরের ডান পাশে একটা জাম গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এক শান্ত খালের শান্ত জলরাশি। তার পাশেই কূল বরই গাছ। আর অগণিত সব পেয়ারা গাছ এ থানার ক্ষুদ্র এ সীমানাকে শীতল করে আগলে রেখেছে যুগযুগান্তর ধরে । যে মানুষটির হাত ধরেই এর গোড়াপত্তন হোক না কেন , তিনি নিশ্চই একজন পেয়ারা প্রেমী ছিলেন।
ওসি সাহেবের বাসার সামনের কংক্রিটের রাস্তা ধরে রওনক হেটে যাচ্ছে। ওসি সাহেবের বড় ছেলে। প্রতি বছরই জানুয়ারী মাস আসলে বেচারার মন খারাপ থাকে। কারন পুরানো বন্ধুদের ফেলে নতুন স্কুলে নতুন ভাবে শুরু করতে হয়। রওনক এর বাবা নাসিম সাহেব একটু ভিন্ন চিন্তার মানুষ। আর বাকিদের মত টাকা দিয়ে বদলির পিছনে ছোটেন না। ওনাকে যেখানে পাঠানো হয় ওনি সেখানেই যান।
তাই প্রতি বছর বছর বদলি। এরই মধ্যে দুবার খাগড়াছড়ি আর বান্দরবন চাকরি করে ফেলেছেন। যাই হোক ঠান্ডা মাথার ওসি হিসেবে ওনার অনেক খ্যাতি আছে পুলিশ বিভাগে। চাকরী জীবনে কোন গুরু দণ্ড নেই। বেশ সুনামের সাথেই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন এই লম্বা সময় ধরে।
কংক্রিটের রাস্তা ধরে রওনক চলে এসেছে থানা ভবনের সামনে। অনেক পুরানো একটি থানা ভবন। ডান পাশে ওসি সাহেবের কামরা।তার পাশে এস আই দের বসার স্থান।আর শেষ মাথায় কনস্টবলদের ব্যারাক।মূল ভবনের পিছন দিকটায় একটি পুকুর। আর সামনে মসজিদ আর মেইন গেট। মেইন গেটের পাশেই ফাঁকা জায়গা। তার পরেই এ এস পি অফিস এবং ফুলের বাগান আর উপজেলা সদর রাস্তা থেকে থানায় ঢুকার জন্য আর একটি গেট।
রওনক চলে এসছে সেই গেটের সামনে। এবার উপজেলা সদর রাস্তায় নামল। সেখান থেকে স্কুল প্রায় আট -দশ মিনিট হাটা রাস্তা। মফস্বলের রাস্তা নেই কোন জ্যাম,আছে শুধু কিছু রিকশা। মুরাদনগর কুমিল্লার একটি বেশ বড় থানা। বাইশ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ থানা। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুমিল্লার বিখ্যাত গোমতী নদী। বেশ ছিমছাম গোছানো একটি শান্ত শহর। মনে হবে যেন সারাক্ষন উৎসবের রং লেগেই আছে।
গোমতী নদীর তীর ধরে চলে বিশাল এক মাটির রাস্তা।যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে আইল। রওনক কে স্কুলে যেতে মেইন রাস্তা থেকে আইলে উঠতে হয়। আইল থেকে নিচেই স্কুল। মুরাদনগর ডি আর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়। বেশ প্রচলিত একটা ড্রেস কোড, যার সব কিছুই সাদা। রওনক স্কুলে চলে এসছে। স্কুলের মেইন গেট দিয়ে ঢুকেই দেখে পিটি চলছে। সোজা গিয়ে সপ্তম শ্রেনীর পিটির লাইনে দাড়ালো। স্কুল চিনতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি কারন এডমিশন
এর দিনেই রাস্তা চিনা হয়ে গেছে। পিটি শেষ করে ক্লাসে ঢুকল রওনক। সব অপরিচিত নতুন মুখের ওর মলিন মুখটি বড় বেমানান।
ক্লাসরুম জুড়ে হই বেশ হই হুল্লোড়। বুঝাই যাচ্ছে বেশির ভাগ ছাত্র একজন আরেকজন কে চিনে। রওনক দেখলে তার মত আরেকজন বেশ মলিন মুখে বসে আছে।গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় ও এটা বুঝে গেছে যে এই ছেলেটাও ওর মত নতুন। রওনক ওর পাশে গিয়ে বসল।
-হ্যালো, আমি রওনক
-আমি মামুন
-তুমি কি এই স্কুলে নতুন।
-হ্যাঁ
-তুমি কোন স্কুল থেকে এসেছ?
-চট্রগ্রাম
-আমি চাঁদপুর
দুজনের একাকীত্ব খুব দ্রত ওদেরকে বেশ ভালো বন্ধু বানিয়ে দিলো। ওদের স্কুলের বাম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুমিল্লার বিখ্যাত গোমতী নদী। টিফিন এর সময়ে রওনক আর বাসায় গেলাম না। ও মামুনকে বলল চল গোমতী নদীর পাড়ে বসি।জায়গাটা বেশ সুন্দর।
মামুন বলল আগে কিছু খেয়ে নেই। ও যে টিফিন নিয়ে এসেছে তা রওনকের সাথে শেয়ার করল । তারপর ওরা গোমতী নদীর পাড়ে বসল। নদীর পাড় বেশ উঁচু। আর নিচ দিয়ে বয়ে গেছে কল কল নদীর জলরাশি।নদীর দুই পাড়ের দৃশ্য দেখে মনে হবে যেন এখানে একটি ঘর বানিয়ে ফেলে থাকলে বেশ সময় কাটত।
রওনকের মত মামুন এর স্কুল বদলানোর অভ্যাস নেই। এটাই প্রথম। তাই ওর মন টা বেশি খারাপ। রওনক মজা করে ওর মনটা ভালো করার চেষ্টা করল। এর মধ্যে ঘণ্টা বেজে উঠল। ওরা উঠে দাঁড়াল। ক্লাসে ফিরতে হবে।
ওদের বেশ ভালো সময় কাটতে লাগল।প্রতিদিন ওরা একসাথে বসা শুরু করল। এরই মধ্যে ক্লাসের আরও কিছু ছাত্রের সাথে ওদের পরিচয় ।
মহিজ উদ্দিন সায়েম। ওর বাবা এই স্কুলের ই শিক্ষক। ওদের বেশ বড় নার্সারি আছে। ওর রোল নাম্বার এক। একটু দুষ্ট প্রকৃতির।
সাখাওয়াত হোসেন শাকিল।বেশ ভদ্র একটা ছেলে। হাতের লেখা অনেক সুন্দর ।ভালো কবিতা আবৃত্তি করে। রোল নাম্বার দুই।
কাওসার । বেশ দুষ্টু আর চঞ্চল। পড়াশোনার চেয়ে দুষ্টুমি করে বেশি।
মাসুম। বেশ সাহসী।স্কুলের গণিত শিক্ষকের ছেলে।ভালো গান গায়।এই এলাকায় তার বাড়ি।
এছাড়া আর ও অনেকে হাসান, আযিযুল, জালাল, প্রীতম ,যাদের নাম বলে শেষ করা যাবে না।
কিছুদিন না যেতেই সবার সাথেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো রওনক আর মামুনের। ফেব্রুয়ারী র দিকে সপ্তম শ্রেণীর দুই শাখার মধ্যে ক্রিকেট খেলা শুরু। বরাবরের মত রওনক ক্রিকেটে বেশ ভাল।বেশ জম জমাট খেলা চলল। রওনক ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতে নেমে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকল ৩২ রানে। এবং বোলিং এ ও উইকেট নিল ২ টি। তিন ম্যাচ সিরিজে ক শাখা সিরিজ জিতল ২-১।
মামুনের খেলা ধূলার প্রতি তেমন নেশা না থাকায় ও কোন ম্যাচেই খেলে নি। কিন্তু খেলা দেখেছে। রাস্তার পাশেই মাঠ হওয়ায় অনেকেই দাঁড়িয়ে খেলা দেখেছে আর সাধুবাদ জানিয়েছে বিজিত দলকে।রওনকের সাথে এবার সবার বন্ধুত্ব চরম হয়ে উঠল। পুলিশের ছেলে প্রথম প্রথম অনেকেই ওর সাথে মিশতে চায় নি, বন্ধুত্ব তো অনেক পরের ব্যাপার। খেলার ছলে সবার সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।
এমনই একদিন খেলা শেষ করে বাসায় ফিরছিলো রওনক। হঠাৎ ই বাসায় যাবার মাঝপথে এক সিনিয়র ভাই ডাক দিলো। তার নাম হাসান।এর আগে পরিচয় নেই। তবু স্কুলে দুজন দুজন কে দেখেছে।
-এই রওনক
-জী ভাইয়া
-কেমন আছ?
-এইতো
-বাসায় যাচ্ছ?
-জী
-আমাদের বাসা কাছেই
-তাই নাকি
-এসো
-না ভাইয়া আজ দেরী হয়ে যাবে, আরেকদিন
-আরে এসোই না, মজার একটা জিনিস দেখাবো
-আচ্ছা বেশিক্ষন থাকতে পারবো না
-আগে চলো
বাসা টা থানা থেকে বেশ কাছেই। রাস্তার পাশে একটা বিরাটাকায় লম্বাটে টিনশেড বাড়ি। বেশ বড় একটা জায়গা নিয়ে বাড়ীটা বানানো হয়েছে। চারপাশ লতা-পাতা আর বড় বড় কড়ই গাছ দিয়ে ঘেরা।কিছুটা ভুতুড়ে ও বলা যেতে পারে। রওনক যখন তাদের বাসায় ঢুকল তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। হাসান ভাই ওকে ড্রয়িং রুমে না বসতে একে বারে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।
-রওনক, তুই বস
-আমি একটু আসছি-
-আরে হাসান ভাই ,ব্যস্ত হবেন না
-না না তেমন কিছু না
-হাসান ভাই বেরিয়ে গেলেন।
তিন গোয়েন্দার বই পড়ে আর বাবা পুলিশ হওয়ায়, রওনক ছোট বেলা থেকেই একটু গোয়েন্দা টাইপের।কিছুটা পুলিশের ছেলে পুলিশ টাইপের। হাসান ভাইয়ের অতি আগ্রহের কোন কারন ও বুঝে উঠতে পারে নি এখনও।
হয়ত আত্নীয় স্বজন কারো নামে মামলা আছে থানায়। রওনক কে দিয়ে ওর বাবাকে বলাবে। এ কথা চিন্তা করতে করতে রওনক একটু রুমটার চারপাশ এ চোখ বুলিয়ে নিলো। একটা সিঙ্গেল খাট, একটা পড়ার টেবিল জানালার পাশে,আর রুমের আরেকটা পাশ একটু বেশি অন্ধকার। টিনশেড বাড়ি হলেও ,বাড়ির ওয়াল গুলো পাকা ইট আর সিমেন্টের। -
হাসান ভাই ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকলেন।
-কিরে বোর হয়ে গেছিস?
-না হসান ভাই
-আপনার কি কোন কাজ আছে আমার সাথে?
-আমার যেতে হবে
-তা না হলে আম্মু চিন্তা করবে
-আরে মাত্র তো এলি
-নে শরবত খা
-এক গ্লাস ট্যাংকের শরবত না পারতে খেলো রওনক
তারপর রুমের যে পাশ টা অন্ধকার, রওনক কে টান দিয়ে সে পাশে নিয়ে গেলো। পুলিশের ছেলে হিসেবে ভালো সাহস রাখে রওনক। তাই ভয় পেলো না। ঐদিকটায় গিয়ে আরেকটা লাইট অন করল হাসান ভাই। এতক্ষন অন্ধকারে ওয়াল টায় কি আছে দেখা যায় নি। রওনক তাকিয়ে দেখল পুড়ো দেয়াল জুড়ে কাঠ আর স্টিলের তার ,স্টিলের ধারালো প্লেট,রাবার, ধনুক দিয়ে নির্মিত বিভিন্ন আকৃতির অদ্ভুত কিছু ছোট বড় জিনিস ঝুলানো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রওনক। ভাবলো হয়ত কাঠ দিয়ে বানানো বিভিন্ন ঘরের কাজের প্রয়োজনীয় জিনিস। রওনক চিন্তা করল যে, হয়তবা কোথাও হাসান এর উপর ট্রেনিং নিয়েছে। এটা দেখানোর জন্যই ওকে নিয়ে এসেছে। কিছুক্ষন পর নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে হাসান ভাই বলল, এগুলো সব অস্ত্র। আমার বানানো। এগুলো দিয়ে মানুষ তো মারা যাবেই, আর পশু-পাখিতো কিছুই না। এতক্ষন পর রওনক সম্বিত ফিরে পেলো। একটা একটা করে অদ্ভুত ভাবে নির্মিত অস্ত্র গুলো দেখালো হাসান ভাই। রওনক শুধু অবাক হলো না খুব আশ্চর্য হলো তার নির্মিত নিখুঁত কারুকার্য দেখে। অনেক শিল্প দেখার সৌভাগ্য হয়েছে জীবনে অনেকের কিন্তু অস্ত্র শিল্প মনে হয় হাতেগোনা দু-একজন মানুষের। তাদের তালিকায় রওনক সানন্দে ঢুকে গেলো। (চলবে.............।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৭:২৮