তো সেবার বিশাল ওয়াজমাহফিলের আয়োজন করা হলো। প্যান্ডেল শুধু স্টেজের ওপর থাকবে - এই ভেবে সব আয়োজন করলেও বাবা ভাবলেন সকালের দিকে কুয়াশা পড়বে। তাই দক্ষিন দিকটা ঢেকে দেবে আর ওপরে থাকবে প্যান্ডেলের কাপড়। মাঠের ওপর ঈদগাহ থেকে নিয়ে আসা হলো চাটাই। ওয়াজের কথা শুনে সবাই মুক্তহস্তেই সব পাঠিয়ে দিলো। সমস্যা বাধলো কোন কোন ওয়াজীকে আনা হবে। তখন হুজুর ইব্রাহিম, আজহারী, মাঈনুল হোসেনদের বুকিং দিতে হলে ছমাস আগে যোগাযোগ করতে হতো। বাকি যারা আছে তাদেরও অনেক ডিমান্ড। জেলার ভেতর যারা আছেন তারা অনেকেই রাজী হলেন, বাঁধ সাধলো কে কোন পন্থি তা নিয়ে। বাংলাদেশের আলেম সমাজে দাওবন্দী থেকে শুরু করে আহলে হাদিস, চর মোনাই, তাবলীগ জামাত সবারই একটা প্রভাব আছে এবং তাদের ভক্তসংখ্যা পুরো দেশ জুড়ে। এই নিয়ে শুরু হলো নানা রকম আলোচনা। আলোচনা শেষে এমন বাগবিতন্ডায় মোড় নিলো যে ওয়াজ পন্ড হবার জোগাড়। চেয়ারম্যান অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের আলিয়া মাদ্রাসার হুজুর আর সদর মসজিদের ইমামের নাম তুলে বললেন তাদের ওপর যোগ্যতর আর কেউ হবে না। তার চেয়ে বড় কথা আমরা তাদের কুব কাছ থেকে চিনি, জানি।
খুব বেশী তর্ক আর গড়ালো না, এটাও বোঝা গেলো অনেকেই মনোক্ষুন্ন হয়েছেন। ভেবেছিলাম এদের অনেকেই তাদের দেয়া প্যান্ডেল চেয়ার টেবিল ফিরিয়ে নেবে। এমনও হতে পারে তৌহিদী জনতার নামে একটা গন্ডগোলও বেধে বসতে পারে। চেয়ারম্যান সাহেব নিজে ব্যাপারটা দেখবেন বললেও বাবা বুদ্ধি করে পুলিশ সুপারকে দাওয়াত করে বসলেন। কিন্তু পুলিশ সুপার তেমন সময় দিতে পারবেন না জানালেন,৫-১০ মিনিট ভাষন এবং এলাকার আইন শৃঙ্খলা নিয়ে বক্তব্য দিয়ে চলে যেতে চান। পরিস্থিতি এমন হবে ভাবিনি। আমি তখন কক্সবাজারের একটা প্রজেক্টে খুব ব্যাস্ত সময় পার করছিলাম। সেসব কাজ ফেলেই আমি বাসায় চলে আসি, সমবয়সী ছেলে পেলে যারা আছে তাদের বলি একটু দেখতে আর মাদ্রাসার ছেলেরা যাতে কোনো সমস্যায় না পড়ে তাই তাদেরকে রান্না বান্নার কাজে ব্যাস্ত রাখলাম। আর ছোটরা যাতে স্টেজের খুব কাছে বসে নিশ্চিন্তে ওয়াজ শুনতে পারে সেটাও ভেবে রাখলাম।
আগের দিন মাইকিং করার ইচ্ছে থাকলেও অনেকের পরামর্শে সেটা বন্ধ রাখলাম। বাবা একবার ভাবলেন অনুষ্ঠান পন্ড করে দিক। এত বড় ছোয়াবের কাজ কিন্তু তার থেকে যদি এমন বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় তাহলে সেটা না করাই ভালো। বাবা এই কথাটা তুলতেই সব মুরুব্বিরা বলে উঠলেন কেন বন্ধ হবে! হোক অনুষ্ঠান। কিছু হলে সবাই মিলে দেখা যাবে। বাবা খানিক ভরসা পেলেন।
ওয়াজের দিন পুলিশ সুপার কিছু পুলিশকে ডিউটিতে পাঠালেন। সকাল বেলাতে দুটো গরু জবাই দিয়ে দেয়া হলো। দুপুর বেরুতেই দেখি দুটো খাসি সহ আরো চাল ডাল হাজির। এদিকে বাবুর্চি চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করেছে। তার সাথে কথা ছিলো দুটো গরু দিয়ে ২০০ মানুষকে খাওয়ানো হবে। কিন্তু দুটো খাসি আর কয়েক বস্তা চাল দেখে ঘাবড়ে গেলেন। কারন তার কাছে বড় ডেকচি তেমন নাই। ওদিকে দুজন পুলিশ ঘন্টা খানেক আগে বিরানীর প্লেট শেষ করার পর আবার ক্ষুধায় ঘুর ঘুর করছে ডেকচির সামনে। বাবা ছুটলেন সদরে ডেকচির জন্য। ঠিক এমন সময় পাশের ক্বাওমী মাদ্রাসার ছেলেপেলেরা তাদের ডেকচি দুটো নিয়ে এসে নিজেরাই শুরু করে দিলো রান্না। উল্লেখ্য আমাদের মাদ্রাসাটা ক্বাওমী। হুট করে এটগুলো হাত মিলে যাওয়া কয়েক ঘ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ, ওদিকে আছরের ওয়াক্ত এখনো শুরু হয়নি।
সূচী অনুযায়ী সবাই মাগরেবের নামাজ প্যান্ডেলের নীচে গন জামায়েতের আয়োজন করবে। এরপর ওসি সাহেব চেয়ারম্যান স হ এলাকার রাজনৈতিক মুরুব্বীরা তাদের বক্তব্য দিয়ে শুরু হবে ওয়াজ। ৯ টার এশার নামাজ জামাতে পড়ে তারপর রাত দুটো বাজে শেষ হবে। দুপুর তিনটা গড়াতেই দেখি লোকজন আসতে শুরু করেছে। এলাকার মুরুব্বীরা জানালেন তাদের জন্য মাঠেই জামাত করতে। মাদ্রাসার ছেলেপেলেগুলো ঝটপট টাদের পাশে দাড়িয়ে গেলো। এদিকে ক্বাওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা আমাদের ছেলেপেলেদের সাথে জুড়ে গেলো। দেখে মনে হলো এরকম ভয় না পেলেও চলতো। সময় যত গড়াচ্ছে তত লোক বাড়ছে, হাজার ছাড়িয়েছে। আরো অবাক করার বিষয় সবাই নিজ নিজ সারিতে বসে পড়েছে। এর মধ্যে যারা ফেড়কা নিয়ে কথা বলছিলেন তারাও ভীড়ে মিশে গেছে। এর মধ্যে এমনও লোক আছে যারা এই মফস্বলের বাইরে। নারীদের জন্য আলাদা জায়গা করা হয়েছিলো যেটা অনেক আগেই পূর্ন। অনুষ্ঠানের সব চে দুর্বল দিক ছিলো পানির ব্যাবস্থা। মাঠের মাঝখানে একটা গভীর নলকূপ খনন করা হয়েছিলো। ভেবে রেখেছিলাম ৪-৫টা ড্রাম ভরে রাখলেই হবে। কিন্তু মানুষের এত ভীড় যে এখন আর কোনো প্লানই কাজ করবে না। তারপরও ভরসা ছিলো কারন সবাই নিজ দায়িত্বেই কাজ করছিলো। কেউ কাউকে কিছু বলছে না। সবাই অদ্ভুত শ্রদ্ধাভরে মিশে গেছে।
যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। ওসি সাহেবের চলে যাবার কথা থাকলেও তিনি গেলেন না। তার পাশে সবাই লাইনবদ্ধ ভাবে বসে পড়লেন। কে বিএনপি আওয়ামীলীগ জামাত তা কেউ দেখছে না। কার সাথে কার ঘরোয়া বিবাদ তারও ভ্রূকূটি ছিলো না। ওয়াজ শেষ হবার কথা ছিলো রাত দুটো পর্যন্ত। সদর মসজিদের ইমাম সাহেব দ্বিতীয় পর্ব টেনে নিয়ে গেলেন ফজরের আজান পর্যন্ত। খাবারে এতটুকু টান পড়েনি। প্লেট শেষ হয়ে গেলে সবাই অপেক্ষা করেছে। আমি সহ বিশ জনের মতো সারা রাত শুধু প্লেট ধুয়েই পার করেছি।
ফজরের নামাজটা শেষ করে এতটুকু ক্লান্ত অনুভব করছিলাম না। হয়তো এক রাতের জন্য আমরা ভুলে গিয়েছিলেন কে সুন্নী কে আহলে হাদিস, কে দেওবন্দি, কে চরমোনাই।
এটাই কি আমাদের বাংলাদেশ নয়?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৪৫