আমি দুধরনের মানুষ দেখি। একদল পদ্মা সেতুর কথা বলতেই দুর্নীতি নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তিত। আরেকদল উচ্ছ্বসিত যাতায়াত ব্যাবস্থার উন্নতি নিয়ে। অনেক ভেবে দেখলাম দুপক্ষের মানুষ সাথে তর্ক করার চাইতে গুরুত্বপূর্ন আমি কি অনুভব করছি।
ময়মনসিংহ বা সিলেটের মানুষ বুঝবে না ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে ফেরী পার হওয়া অথবা লঞ্চে ডুবে আপনজনের লাশ খুজে না পাওয়ার অমানুষিক কস্ট। তাদের আক্রোধ এত টাকা দিয়ে এই পদ্মাসেতুর কর্মযজ্ঞ সেটা তার কস্টের টাকা। তার ভাবতে খারাপ লাগে দিনের পর দিন কলুরবলদের মতো কস্ট করছে। সামান্য দুটো টাকার জন্য মানুষের যাচ্ছেতাই গালাগালি শুনছে, পেট ভরে বাসার সবাই মিলে কবে যে দুটো ভালো মন্দ খেয়েছে! কবে যে এই অল্পটাকার চাকরীটাও চলে যায়। ইস! হাতে যদি দুটো টাকা থাকতো তাহলে পাড়ি দিতাম ইউরোপে। কেউ যদি বলে একটা সুযোগ আছে অস্ট্রেলিয়া যাবার। একটু সাতার জানলেই চলবে।খুব যে দরকার সেটাও না। লাইফ জ্যাকেট থাকবে, যদি গেমটা ঠিক মতো খেলা যায় তাহলেই চাঁনকপাল। সোজা অস্ট্রেলিয়ার সোনালী বিচে। একবার পা ফেলতে পারলে আর কি লাগে! তাই হাসিনার পিন্ডি চটকাও, পদ্মার চুরি দেশ ধ্বংস করছে, অতএব দেশ ছাড়।
আরেকদল মানুষ দল বেধে পদ্মা সেতু দেখতে যাচ্ছে। পুরো রাতভর পদ্মার বুকে ধূসর সেতুটা দেখতে দেখতে চোখের জল ফেলে। যদিও সে ঢাকায় থাকে তবু তার চোখ ভিজে যায়। যদি সেতুটা আর বিশটা বছর আগে হতো তাহলে বাবার গায়েবী জানাজায় শূন্য কফিন কবর দিতে হতো না। বাবা কি সত্যি বেচে আছে? যে লঞ্চডুবিতে সব পাল্টে গেলো সেটা নাকি তিনমাস পরেই মেরামত করে পদ্মার বুকে আবার দাপিয়ে বেড়ায়। সেবার নাকি ৮০০ মানুষ মরেছিলো। বাবা ফিরে আসেনি, লাশ পাওয়া যায়নি বলে সরকারের দেয়া ছাগল আর ১০,০০০ টাকাও কপালে জুটেনি। সেটা নিয়ে দুঃখ নেই। সেতুটা তখন হলে আজ বাবাকে নিয়ে নিজের গাড়িতে চড়ে এই সেতুটি দেখতো। হয়তো নিজের অনাগত সন্তানকেও একদিন নিয়ে আসবে লং ড্রাইভে।
এরিস্টটলের ভালোবাসার সংজ্ঞাটা ছিলো আত্মকেন্দ্রিক। নিকোমাকিয়ান এথিকসের লেকচার নামে পরিচিত ভালোবাসার গূঢ় কথা। নিকোমাকিয়াস তার সন্তানের নাম। ভালোবাসার কিছু স্তর আছে যার প্রথম স্তরটি হলো ইউডেমিয়ান এথিকস। ইউডেমিয়ান এথিকসের প্রথম শর্ত আত্মার মধ্যে থাকতে হবে এমন গুন। ভালোবাসতে পারার ক্ষমতা মিশে থাকতে হবে আপনার রুহের সাথে। এই ক্ষমতা যার নেই সে যেকোনো ঘৃন্য কাজ করতে পারে। যেকোনো ধর্মের প্রথম শর্তই তো বিশ্বাস, তাই না? যদি বিশ্বাস না থাকে তাহলে সে ধর্ম ধারন করতে পারবেন না। বিশ্বাস থেকেই জন্ম নেবে ভালোবাসা, ভালোবাসাই আপনাকে প্রস্ফুটিত করবে।
অথচ মানুষের ভালোবাসাগুলো বিচিত্র। কেউ কেউ এই পদ্মাসেতুকে ভালোবাসলেও এটা বাহুল্য, অপ্রয়োজনীয়, কিছু মানুষের পকেটভারী করার পথ। তাদের জন্য বর্তমান বাজারের এত উচ্চমূল্যের কারন এই পদ্মা সেতু। এই পদ্মাসেতুর টাকা দিয়ে কতগুলো বেকারের কর্মসংস্থান হতো, কত অনাহারী ঘরে বসে কত বছর পোলাও কোর্মা খেতে পারতো, কে জানে! যারা এই পদ্মাসেতু দেখে আবেগী হয়, তাদের কাছে বুকের এসব হাহাকারের মূল্য শূন্য।
অথচ আমরা সবাই দেশটাকে ভালোবাসি, দিনশেষে ভিন্ন ভিন্ন পথে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ১:৫৪