কয়েক হাজার বছর আগে এক কবিরাজ এমিউলেট হাতে মন্ত্রপুত দাবী করলেন তিনি কঠিন কঠিন রোগের নিরাময় করতে পারেন। মন্ত্র সম্বিলিত চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু বইও লিখে ফেললেন। যার প্রথম মন্ত্রটি,"আমি সৃষ্টির আদেশ দিলাম।" পাগলাটে কোবরেজ কারো অসুখ সারাতে পেরেছিলো কি না জানি না, তবে বলতে হয় তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তার বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় ছিলো, ২০০০ বছর পরও কোনো ম্যাজিসিয়ান তার যেকোনো জাদুর শুরুতেই তার মন্ত্র উচ্চারন করে,"আব্রা কা ডেব্রা!" হিব্রুতে এর অর্থ "আমি সৃষ্টির আদেশ করলাম।" বাইবেল অনুসারে ঈশ্বর বলেছিলেন,"লেট দেয়ার বি লাইট!" ইসলাম অনুসারে আল্লাহ বলেছিলেন,"হও!" কোবরেজের কি পরিমান আত্মবিশ্বাস!
কখনো কখনো ভাবি প্রায় অর্ধ শত বছর আগে যে মানুষটি ততকালীন রেসকোর্স ময়দানে আঙ্গুল উচিয়ে সবার মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বালয়ে দিলেন, তিনি কি সত্যি জানতেন আসলেই স্বাধীনতা আসবে কিনা! যদি আমরা হেরে যেতাম, তার লাশও এদেশে ফিরতো না। সত্যি এটাই হতো যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে এক হাতে গ্রেনেড, আরেক হাতে ভাঙ্গা রাইফেল তুলে এগিয়ে গিয়েছিলেন তাদেরকে এখন গাদ্দার বলে অভিহিত করা হতো। নির্দিস্ট দিনে শেখ মুজিবের নাম মীরজাফরের কাতারে ফেলে স্মরন করিয়ে দেয়া হত এই বাঙ্গালী গাদ্দারী করেছে তাদের ধর্মভাইদের বিরুদ্ধে, এরা রাস্ট্রদ্রোহী। বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে কেরানির পদে চাকরি পেয়ে দু'বেলা ভাত খাওয়ার নিশ্চয়তা পেতাম সেখানে উর্দু জানা কলেজ পাশ কেউ ম্যানেজার হয়ে ছড়ি ঘুড়াতো দিব্যি। অথচ একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে যে স্ফূলিঙ্গ ছড়ালো, তাকে কি বলা যায়?
চায়ের দোকানের আড্ডায় কতশত মানুষ বসে। এসব চা আমার পেটে সহ্য হয় না। এত কড়া মিস্টি, কন্ডেন্সড মিল্কের ছোয়ায় এমন একটা স্বাদ ধারন করে, চায়ের আসল স্বাদ কেমন সেটা ভুলে যাই। আমি চা খাবো, শরবত নয়। মানুষের সাথে কথা বলার লোভ প্রচন্ড আমার। অফিসের কথাগুলো মেকি লাগে। সবার মধ্যে ব্যাস্ততা। প্রেজেন্টেশন শেষ হবার আগেই মোবাইলে ম্যাসেজ দেখার পায়তারা, ৫ টা বাজার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে উবারের জন্য দাড়িয়ে থাকা। এখানে খুজে পাওয়া যায় না স্বতঃস্ফূর্ততা। এরা মুদির দোকানে চা খাওয়াটা একটু তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখে।
"কক্সবাজারটা শেষ কইরা ফেলাইলো। এগুলারে জায়গা দিয়া সর্বনাশ করছে? দেশের মানুষ খাইতে পায় না, রোহিঙ্গা নিয়া পইড়া আছে সবাই", চায়ের কাপটা দিয়েই সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলো। আমি একটু শান্তমত বসলাম। এই সময়টা সবাই ঘরে ফেরে, তাই বেঞ্চগুলো ফাঁকা। সন্ধ্যা যত ঘন হয়, আশেপাশে ভিড়তে থাকে ভ্যান চালক, রিক্সা চালকের দল। তারা খুব একটা কথা বলে না। রিক্সা ভ্যান ফেরত দিয়ে পাউরুটি পুরোটা মুখে চেপে ধীরে ধীরে চায়ের কাপটা শেষ করে। অনেকের জন্য এটাই দিনের প্রথম খাবার, কারো কারো জন্য রাতের শেষ খাবার। কথা বলার ফুরসত কম। কথা বলতে জানে না এটাও ভুল। তারা কথা বলতে ভয় পায়।"চাচা, বাড়ি কই?" আমার প্রশ্নটা শুনে চমকে গেলেন। গলা খাকাড়ি দিয়ে লাজুক হাসিতে,"রাজশাহী।"
খেটে খাওয়া মানুষের এমন লজ্জিত হাসি এত কিউট হয়,"পদ্মা সেতু দেখছেননি?" কি যেনো ভাবলেন উনি,"জব্বর সেতু বানাইছে। দেখতে যাওনের ইচ্ছা আছে।" কথা বলতে বলতেই রুটি চা শেষ করে ফেললেন। সালাম দিয়ে বললেন আসি। সবাই নীড়ে ফিরছে। কেউ ফেরে খালি হাতে, কেউ ফেরে দুটো টাকা নিয়ে। নতুন দিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। এসব মানুষের কাছে স্বাধীনতা, বিজয় দিবস অর্থহীন, অর্থহীন পদ্মাসেতু তৈরী হলো কি হলো না। তারা রাস্তা দেখলেই একটা রিক্সা, ভ্যান নিয়ে নেমে পড়ে। দুটো টাকার জন্য গনগনে রোদে মানুষ টেনে বেড়ায়। আমি রিক্সাতে আরাম করে বসে দেখি চালকের আসনে যিনি প্যাডেল টানছেন শীর্ন দুটি পা দিয়ে, ঘন্টার পর ঘন্টা, সে কস্টটা আমার পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। পুরোটা দিন ঘন্টার পর ঘন্টা রিক্সা টানছে, কখনো দিনের রিক্সা জমা দিয়ে রাতেও বের হতে হয়। হাজার টাকা জমা দিয়ে কোন কোন দিন রিক্সা নিয়েও ফিরতে পারে না। বিনা ঘোষনায় রাস্তা বন্ধ করে মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি এসে রিক্সা গুলো তুলে নিয়ে যায় তখন ঘাড়ে জমা হয় আরও কিছু দেনা। সেই দেনা আর পেটের ক্ষুধা নেভাতে একদিন নেমে পড়ে চুরি ডাকাতি ছিনতাইয়ে। যদি ধরা পড়ে তাহলে ক্রশফায়ার, যদি না পড়ে, কালোজগতের নেশা গ্রাস করে। এভাবেই আমাদের স্বাধীনতা মূল্য হারায়। আজ হতে অর্ধশত বছর আগে যে মানুষটা এব্রাকা ডেব্রার মতো সবার মনে জাদু ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনিও প্রতিদিন লক্ষ কোটি বার হেরে যান।
আমরা সবাই স্টেজে দাড়িয়ে থাকা সঙ সাজা নকল জাদুকর- আব্রা কা ডাব্রা
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৩:০৭