somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হৃষ্টপুষ্ট পোষ্ট ফিচারিং মানবিক মিথ্যা

১০ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৩:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেবার বৈশাখি মেলায় সার্কাস বসেছিলো। প্রতিবছরই প্রচন্ড ভীড় হয়। আশেপাশের অনেকেই সওদাগরি করতে আসেন, বছর জুড়ে এমন একটা উৎসব হাতছাড়া করার মানেই হয় না। আমার বয়স আর কত হবে, ১২ কি ১৩। বাবা হাতে ধরে নিয়ে গেলেন। মেলায় গিয়ে দেখি মাদ্রাসার অনেকেই। দল বেশ ভারী হয়ে গেলো। সবাই ছোট বলে কি হবে, নজর কিন্তু ঐ সার্কাস। গোল খাঁচায় মোটর সাইকেল অথবা বিশাল হাতির পা উচিয়ে শূড় বাকা করার দৃশ্য দেখার জন্য বিশাল লাইন। বাবা ঠিকি টিকেট যোগাড় করে সবাইকে নিয়ে ঢুকলেন। তখনকার সার্কাসের একটা প্রধান আকর্ষন ছিলো সং এর কান্ডকারখানা। তারা যাই করে হাসি পায়। নাকের ডগায় রং আর অদ্ভুত কাপড়ে কিম্ভুতকিমাকার সাজ দেখলেই পেটে খিল ধরে যায়। তবে সেবারই আমার শেষ সার্কাস দেখা। কারনটা খুব সাধারন। বয়স হবার পর বুঝি কমেডি, তা সে যেকোনো মিডিয়ার হোক না কেন, নিজেকে ষ্টুপিড বানিয়ে বোকার মত কাজ করে গেলেই মানুষ হাসবে। একজন মানুষ এমন সব বোকার মত কাজ করছে লোকে দেখে দম বন্ধ করে হাসছে। তাকে কেউ পিটিয়েও মারলেও মানুষ সানন্দে হাসবে। তারা যথেষ্ট এক্রোব্যাটিক, তবে অন্যান্য শো এর প্লেয়ারদের মতো দক্ষ নন। তারা ভালো স্টান্টবাজ হওয়ায় অনেক সময় দর্শক চাহিদার জন্য অন্যান্য শোতেও অংশ নেন। একটা খেলা ছিলো অনেক উচুতে দড়ির ওপর হাটা। মেয়েরা হাতে একটা লাঠি নিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে এবং সে এ কোণা থেকে ও কোণা চলে যায়। জোকারও সেটা করতে যায় কিন্তু সে পড়ে যাবে নিশ্চিত। ভয় নেই, নীচে জাল পাতা থাকে। প্রথমবার এত উচু থেকে পড়লে সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু দিনের প্রতিটা শোতে যখন তাকে এভাবে পড়তে হয় তখন দুর্ঘটনা ঘটবেই। সেরকমই কিছু হয়েছিলো এবং জালের ওপর ঝপাং করে পড়ে উনি আর ওঠেননি। তিনি যে উঠছেন না, সেটা নিয়ে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। উনি পড়ে গেছেন, এটাই আনন্দের বিষয়। যদিও তাকে সরিয়ে আনা হয় এবং তারপর গ্রামের কারো কাছে এই বিষয়ে কোনো কিছু শুনিনি। কিন্তু যত দিন যায়, সেই পতনের ছবিটা আমার মানসপটে মাঝে মাঝেই ভেসে ওঠে।

গ্রামে এরপর বহুবার সার্কাস এসেছিলো, যাত্রা এসেছিলো। একসময় ধর্মীয় কারনে গ্রামের মুরুব্বিরা প্রতিবাদ জানালে তাদের আসাটাও বন্ধ হয়ে যায়। আমার তাতে ভ্রুকুটি ছিলো না। শৈশবের ঐ স্মৃতির শেকড় ততদিনে বহুদূর চলে গেছে। তারপরও একবার খুলনা গিয়ে দ্যা গ্রেট রওশন সার্কাসের খোজে গিয়েছিলাম। উনি আর শো করেননা। দারিদ্রতার ভারে তার বয়স বোঝা যায় না। ন্যুয়ে পড়া শতবর্ষী গাছের মতো ঝুকে বসে থাকেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম শো করতে গিয়ে কেউ মারা গেলে তার কি হয়? তার পরিবারের কি হয়?

উনি তখন বা পাটা দেখিয়ে বললেন, মটর মাস্টার হিসেবে তার অনেক খ্যাতি ছিলো। পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন বল ফাকি দেয়া তার বা হাতের খেল। তার মতো মাস্টার পুরো দেশে কেউ ছিলো না। আর তাই এরশাদ সরকারের আমলে যেকোনো অনুষ্ঠানে তাকে ডেকে নিয়ে যেতো। তো সেবার চাপাই নবাবগন্জ্ঞের প্রত্যন্ত গ্রামে শো করতে গেলেন। তার ইনকাম ছিলো শো প্রতি ৮০ টাকা। দিনে ৩-৪ টা শো। মাস ব্যাপী অনুষ্ঠানে কাচা টাকার ভালোই সমাগম হতো। মেলার দুদিন হয়েছে, শো চলছিলো। বাইকটা ছিলো সপ্তমে। দুটো টায়ারে বাতাস একটু কম ছিলো, কিন্তু সেটা সমস্যা না। ওপরে ওঠার সময় চেইনটা ছিড়ে যায়। খাচায় তিন জন ছিলো। ব্রেক হারিয়ে জুনিয়র ছেলেটার মাথার ওপর চাকা উঠিয়ে দেয়। তারপর জ্ঞান হারান।

জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে রাজশাহী সদর হাসপাতালের বেডে একাই দেখতে পান। বা পায়ে অপারেশন হয়, লোহার রড স্ক্রু দিয়ে পা সোজা করতে পারলেও আগের মতো হাটতে বা দৌড়াতে পারবেন না। এই দুঃসময়ে কাকে কি বলবে কিছুই মাথা্য ছিলো না। হাতে একটা টাকাও জমানো নেই। কোনো মতে চেয়ে চিন্তে যখন নিজের ডেরায় ফেরে জানতে পারে সে রাতে জুনিয়র ছেলেটা সেখানেই মারা যায়। পুলিশের কোর্ট কাচারির ঝামেলা থেকে বাচতে তাকে ফেলে চলে আসতে হয়। কিন্তু পায়ের যে অবস্থা তাতে আর আগের মতো বাইক চালাতে পারবে না। ওদিকে ঐ ছেলের বড় ভাই নাকি পাগলের মতো খুজছে। ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তারপর শুরু হয় আসল সংগ্রাম।

এই বলে তিনি থামলেন। এরপর তিনি যা বললেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না,"আমি এখনো সেই গতিটা মিস করি। মটরবাইকের ভো টানে যখন আশেপাশের সবকিছু থেমে যায় তখন নিজেকে অন্য কিছু মনে হয়। জীবনে একটা বার যদি সুযোগ পেতাম...."

মিথ্যার কিছু ধরন আছে। নির্ভর করছে আপনি কি জন্য তথ্যের বিকৃতি করলেন। যদি আপনার ইচ্ছে হয় দর্শকদের আপনি প্রতারিত করবেন তাহলে সেটা মিথ্যা। যদি উদ্দেশ্য হয় আনন্দ দেবার, তাহলে তো সেটা মিথ্যা নয়। কারন দর্শকরা জানে এটা কুহেলিকা। তারা জেনে বুঝেই আপনাকে টাকা দিচ্ছে। তাই আপনার কর্তব্য হয়ে ওঠে তাদেরকে নিখুত ও মজাদার ভঙ্গিতে প্রহেলিকাতে ডুবিয়ে দেয়া। দৈনন্দিন বাস্তবতা রূঢ়। এমনও দেখেছি ঘরে স্ত্রী সন্তান থাকার পরও আরেক গ্রামে বিয়ে করে। সেখানে সংসার করে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়। এদিকে প্রথমা ভাবে তার স্বামী নতুন চাকরী করছে। সন্তান সংসার তো তারও। নিজের বুকে আগলে রাখেন। তারপর হঠাৎ যেদিন সত্যটা জানেন, বুকটা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু কাঁদতে পারেন না।

তারপরও মানুষ হাসে, অপরকে আনন্দ দেয়। অপরকে সুখির করার মাঝে যে আনন্দ তারও একটা নেশা আছে। একসময় জ্বরা, বয়স, রোগ গ্রাস করে। তারপরও সে চেষ্টা করে। এখন আমরা এতকিছুর পরও যদি সত্য মিথ্যা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন করি তাহলে মানবিকতা কোথায় হারাবে!

তারপরও মানুষ প্রতারিত হতে ভালোবাসে, নিজের ভাঙ্গা পায়ে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখে মটরবাইকে খেলা দেখাবার!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ৩:৪২
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×